আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রাণপুরুষ

প্রকাশ: ৩০ মে ২২ । ১৯:৩৩ | আপডেট: ৩০ মে ২২ । ১৯:৪০

হীরেন পণ্ডিত

একুশের অমর গান 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি'র রচয়িতা, প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ দেশের ইতিহাসের বিভিন্ন সন্ধিক্ষণের সাক্ষী তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। তিনি ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে অংশ নেন।

স্বাধীনতার কয়েক বছর পর স্ত্রীর চিকিৎসাজনিত কারণে তিনি যুক্তরাজ্যে প্রবাসী হলেও বাংলাদেশের শীর্ষ দৈনিকগুলোতে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ কলাম লিখেছেন। রাজনীতি, সমসাময়িক ঘটনা ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি নিয়ে লেখা তাঁর কলামগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। তিনিই ছিলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কলাম লেখক।

জনগণের ভাষা, তাদের চাহিদা গাফ্‌ফার চৌধুরী সুদূর লন্ডনে বসেও বুঝতেন। আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী আসলে শুধু সাংবাদিক হতে চেয়েছিলেন। তিনি তাঁর সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেন। তাঁর নাম মানেই এক কলম সৈনিকের নাম। এক যোদ্ধার নাম, একজন সৃষ্টিশীল মানুষের নাম। তিনি গঠনমূলক সমালোচনাও করতে সামান্য দ্বিধা করতেন না। যাঁর নাম দেখলে কলামটা পড়ত মানুষ, তিনি হলেন আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। তাঁর পাঠক ছিল ভুবন জোড়া। এত পাঠক বোধ করি কারও ছিল না। 

বাংলাদেশ নামের এই রাষ্ট্রের আজ তার একান্ন বছর পেরিয়ে শতবর্ষের অভিমুখে ধাবিত। এই রাষ্ট্রসত্তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা যাদের চিন্তা-চেতনায়, তাদের অন্যতম একজন আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। তাঁর মহাপ্রয়াণ পরবর্তী প্রজন্মের কাঁধে দিয়ে গেল প্রগতিশীল চেতনার উত্তরাধিকার বহনের অনিবার্য দায়িত্ব। সন্দেহ নেই, তাঁর মৃত্যু আমাদের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। বাংলাদেশ আপনার মতো কালজয়ী সন্তানকে ভুলবে না। 

মৃত্যুর কয়েকদিন আগ পর্যন্ত তিনি দেশের বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রে নিয়মিত কলাম লিখেছেন। শুধু সংবাদপত্রের কলাম নয়, তাঁর বেশকিছু উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম রয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও স্মৃতিকথা। তিনি দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে বাঙালি জাতি একজন মহান দেশপ্রেমিক ও গুণী অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রাণপুরুষকে হারাল। আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর শারীরিক মৃত্যু হলেও তিনি বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে, বিশেষ করে একুশের অমর গানের মধ্য দিয়েই তিনি অমর হয়ে থাকবেন। 

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি এবং রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত অধ্যায় ২১ ফেব্রুয়ারির সঙ্গে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি ছিলেন এর একটি অক্ষয় অধ্যায়। যত দিন বাঙালি জাতি থাকবে, বাংলা ভাষা থাকবে, ততদিন আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর নামটি প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসবেই।

দীর্ঘকাল ধরে সাংবাদিকতার ভুবনে তাঁর অবস্থান ছিল প্রধানত গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, জাতীয়তাবাদী মতাদর্শকে কেন্দ্র করে। এ ধারাতেই স্বদেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর খ্যাতি। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তিনি তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসে ধারণ করেছিলেন এবং এ দুই উৎস থেকে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক শক্তিতে ঋদ্ধ হয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব নীতিতে অটল থেকেছেন। বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সাহিত্য-সংস্কৃতিকে চেতনার মর্মমূলে ধারণকারী এক খাঁটি বাঙালি আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। 

সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসেবে পরিণত হন কিংবদন্তিতে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সরব ছিলেন প্রগতিশীলতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে; অসাম্প্রদায়িকতা, পশ্চাৎপদতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা দেখলেই তিনি ক্ষুরধার এগিয়ে এসেছেন। জোরালো যুক্তি, ইতিহাসের তথ্য ও বাস্তব অভিজ্ঞতার বয়ানে আঁধার ঠেলে জাতিকে আলোর পথে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে মাথার খুলি উড়ে যাওয়া ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিনের রক্তাক্ত দেহ দেখে তাঁর স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখতে রচনা করেছিলেন একুশের অমর সংগীত 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি', যেটি স্বীকৃতি পেয়েছে প্রভাতফেরির অমর সংগীত হিসেবে। 

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ছিলেন ইতিহাস-ঐতিহ্য সচেতন, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঋদ্ধ। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প যখনই বাঙালি জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে, তখনই তিনি কলম হাতে তুলে নিয়েছেন।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর চিন্তা-চেতনা বাঙালিকে উজ্জীবিত করে অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাঙালি জাতীয়তাদের দীপ্তিতে করে ভাস্বর। তাঁর কলাম ও সাহিত্য জাতির চেতনায় প্রজ্বালিত করে বাঙালিত্বের চিরায়ত অগ্নিমশাল। 

একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি 'জয় বাংলা', 'যুগান্তর' ও 'আনন্দবাজার' পত্রিকায় কাজ করেছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তাঁর লেখা 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো' গানটি তাঁকে শুধু খ্যাতি নয়, অমরত্ব এনে দেয়। প্রথমে তিনি নিজেই গানটিতে সুর করেছিলেন। পরে শহীদ আলতাফ মাহমুদ এ গানে সুরারোপ করেন এবং বর্তমান সেই সুরেই গানটি গীত হয়। 

গাফ্‌ফার চৌধুরী একটা গীতি কবিতা লেখার পরে আর না লিখলেও তাঁর আয়ু বাংলা ও বাঙালির সমান। তাঁর জীবন ও সংগ্রামের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ক্ষুরধার লেখনী তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com