দামি সরঞ্জাম থাকলেও অভাব প্রশিক্ষণের

তদন্তে স্বতন্ত্র টিম করবে পুলিশ

প্রকাশ: ০৭ জুন ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ০৭ জুন ২২ । ১১:১৩ | প্রিন্ট সংস্করণ

সাহাদাত হোসেন পরশ

বারবার লাগে আগুন। মানুষ পোড়ে, হয় প্রাণক্ষয়। দিন কয়েক আহাজারি, চোখে জমে নোনাজল। এর পর সবাই ভুলে আগুন-স্মৃতি। প্রতিটি অগ্নিদুর্ঘটনায় শুরু হয় তদন্ত। কেন, কীভাবে লাগল আগুন, কী ধরনের গাফিলতি- তা রহস্যভেদের চেষ্টা চলে। তবে দেশে একের পর এক রাসায়নিক থেকে আগুনের সূত্রপাত ও বিস্ম্ফোরণের ঘটনায় বহু হতাহতের প্রেক্ষাপটে একটি বড় প্রশ্ন জোরালো হয়ে আবার সামনে এসেছে- রাসায়নিকের বিস্ম্ফোরণ ও দুর্ঘটনা তদন্তে কতটা প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী; এ ধরনের ঘটনা তদন্তের সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ আছে কিনা।

একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বছরখানেক আগেই পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের পক্ষ থেকে পুলিশ সদরদপ্তরে স্বতন্ত্র টিম অনুমোদনের প্রস্তাব পাঠানো হয়। প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, এই টিম শুধু রাসায়নিক দুর্ঘটনা ও বিস্ম্ফোরণের ঘটনা তদন্ত করবে। নীতিগতভাবে এই টিমের কার্যক্রম শুরুর অনুমোদন দেওয়া হয়। মাঠপর্যায়ে কাজ করতে তাঁদের জন্য কেনা হচ্ছে বিভিন্ন সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি। এসব ব্যবহার করে যে কোনো ধরনের রাসায়নিক বিস্ম্ফোরণের ঘটনা ঘটলে সেখানে দ্রুত উপস্থিত হয়ে নির্বাপণমূলক কাজ করবে পুলিশ। এই বিশেষ টিমের জন্য একটি মানসম্মত অপারেশনাল পদ্ধতি বা 'এসওপি' তৈরি করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে সিটিটিসির প্রধান ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বিশেষ এই টিমের কার্যক্রম শুরু হলে রাসায়নিক বিস্ম্ফোরণ ও দুর্ঘটনা-সংক্রান্ত মামলার তদন্ত নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করার পথ খুলবে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমেও পুলিশের কিছুসংখ্যক সদস্যকে এ ব্যাপারে দক্ষ করে তোলা হবে।

একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বিস্ম্ফোরণ, অগ্নিকাণ্ড ও জঙ্গি হামলার পর গুরুত্ব বিবেচনায় অনেক ঘটনার ছায়া তদন্ত করে সিটিটিসির বোমা নিষ্ফ্ক্রিয়করণ দল। নানা সময় বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালাতে গিয়েও বিস্ম্ফোরকজাতীয় দ্রব্য জব্দ করেছে তারা। বছরতিনেক আগে গাজীপুরে একটি আস্তানায় জঙ্গিরা পুলিশ সদস্যদের ওপর উচ্চ মাত্রার দাহ্য পদার্থ ছুড়েছিল। এর পর থেকে রাসায়নিক বিস্ম্ফোরণ ও দুর্ঘটনায় স্বতন্ত্র টিম গঠনের বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। কেমিক্যাল বায়োলজিক্যাল রেডিওলজিক্যাল নিউক্লিয়ার (সিবিআরএন) টিম নামে তারা কাজ করবে। এরই মধ্যে টিমের জন্য বিশেষ পোশাক ও সরঞ্জাম কেনার প্রক্রিয়া শেষ।

পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন সময় জঙ্গিদের কাছ থেকেও হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড জব্দ করা হয়েছে। বোমা তৈরিতে এ ধরনের কেমিক্যাল উগ্রপন্থিরা ব্যবহার করে। এ ছাড়া পুরান ঢাকার বেশ কিছু রাসায়নিকের মার্কেট রয়েছে। সেখানকার অনেক বাসায় রাসায়নিকের অননুমোদিত গুদামও আছে। যারা রাসায়নিক ব্যবহার করে হাতবোমা বা অন্য বিস্ম্ফোরকজাতীয় দ্রব্য তৈরি করতে চায়, তাদের কাছে পুরান ঢাকার মার্কেট হলো বড় সোর্স। সম্প্রতি একটি বিদেশি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ পুলিশকে রাসায়নিকের ওপর ঢাকায় প্রশিক্ষণ দেয়। একজন বিদেশি প্রশিক্ষক ক্রেতা সেজে পুরান ঢাকা থেকে নানা ধরনের রাসায়নিক কিনে প্রশিক্ষণার্থীদের দেখান। তিনি এটা বোঝাতে চেয়েছেন, কেউ চাইলে যে কোনো ধরনের বাধা ও প্রশ্নের মুখোমুখি না হয়েই উচ্চ মাত্রার দাহ্য পদার্থ কিনতে পারেন। যদিও বিস্ম্ফোরক বিক্রেতা তার ক্রেতার কাছে জানতে চাওয়া বাধ্যতামূলক- কেন কী কাজে এসব দ্রব্য কেনা হচ্ছে।

পুলিশের বোমা নিষ্ফ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, রাসায়নিক-সংক্রান্ত দুর্ঘটনার তদন্তের গভীরে পৌঁছার জন্য স্বতন্ত্র টিমের বিকল্প নেই। উন্নত বিশ্বের জন্য তাল মেলাতে হলে এসব সেক্টরে দক্ষতা অর্জন জরুরি। তা না করলে অনেক পিছিয়ে থাকতে হবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরেক কর্মকর্তা জানান, রাসায়নিক-সংক্রান্ত যে কোনো দুর্ঘটনার মামলার তদন্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক সময় সংশ্নিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও মতামত নিয়ে থাকে। তবে তদন্তে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় প্রকৃত ঘটনায় অনেক সময় আড়ালে থাকার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

রাসায়নিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অগ্নিনির্বাপণে কোনো ধরনের ঝুঁকি থাকলে উন্নত বিশ্বে রোবট ব্যবহার করা হয়। অগ্নিনির্বাপণের জন্য তিনটি বিষয় গুরুত্বসহকারে মানা জরুরি। তা হলো- সেফ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, ফায়ার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ও ইমার্জেন্সি রেসপন্স প্রসিডিউর। আবার রাসায়নিকের আগুন থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হলে তা মোকাবিলা ও প্রাথমিকভাবে সোর্স নির্ণয়ের জন্য উন্নত সরঞ্জামও দরকার। একটি সূত্র জানায়, ফায়ার সার্ভিসের কাছে বেশ কিছু আধুনিক সরঞ্জাম থাকলেও প্রশিক্ষণ ও বিশেষজ্ঞের অভাবে তা ব্যবহার করতে বেগ পেতে হচ্ছে।

ফায়ার ইনভেস্টিগেটর ও বুয়েটের প্রকৌশলী আল ইমরান হোসেন বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলেই হবে না, তা ব্যবহারের জন্য দক্ষ জনবল প্রশিক্ষণ জরুরি। ফায়ার সার্ভিসের জন্য যন্ত্রপাতি কিনেছে এমন একাধিক প্রতিষ্ঠান তাদের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কৌশল শেখাতে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দিয়েছে আমাদের।

সহকারী বিস্ম্ফোরক পরিচালক (চট্টগ্রাম) মুহাম্মদ মেহেদী ইসলাম খান বলেন, পেট্রোলিয়াম আইন, ২০১৬ ও বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী রাসায়নিকের লাইসেন্স দেওয়া হয়। তবে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড আমদানি, তৈরি, লাইসেন্স নবায়ন ও মজুতের অনুমতি দেওয়ার এখতিয়ার বিস্ম্ফোরক অধিদপ্তরের নেই। চট্টগ্রামের আল-রাজী নামে কোনো প্রতিষ্ঠানকে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের জন্য লাইসেন্স আমাদের কার্যালয় থেকেও দেওয়া হয়নি। তবে বাংলাদেশে আরও কিছু সংস্থা বিভিন্ন রাসায়নিকের লাইসেন্স দেয়। আল-রাজী তাদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে পারে।

মেহেদী ইসলাম আরও বলেন, বাপেক্স, কয়লা প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকাসহ আরও কিছু জায়গায় রাসায়নিক ব্যবহার হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য কেউ রাসায়নিক আমদানি করলে আগে 'এনওসি' নিয়ে পুলিশের পাহারায় তা পাঠানো হয়।

জানা গেছে, দেশে প্রায় সব ধরনের শিল্প খাতে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে গার্মেন্ট, ওষুধ, অটোমোবাইলস, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, অটোমোবাইল খাত রয়েছে। এমনকি বেসরকারি কনটেইনার ডিপো ছাড়াও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম, মোংলা বন্দর, বেনাপোল স্থলবন্দর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে রাসায়নিক গুদাম আছে।





© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com