
সমাজ
গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তাহীনতা
প্রকাশ: ২৪ জুন ২২ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সেলিনা হোসেন

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ঢাকায় গণপরিবহনে যৌন হেনস্তার শিকার ৪৭ শতাংশ নারী। 'ঢাকা শহরে গণপরিবহনে হয়রানি :কিশোরী এবং তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব' শিরোনামে এক জরিপ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ৩ জুন ভার্চুয়াল মাধ্যমে আঁচল ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে একটি জরিপ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। এর আগেও ব্র্যাকসহ কয়েকটি সংগঠন পরিচালিত জরিপে জানা গিয়েছিল, দেশের গণপরিবহন নারীবান্ধব তো নয়ই; কখনও কখনও চরম বৈরী ঘটনা সভ্যতা-মানবতার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেয়।
এবার জরিপে জানা গেছে, গণপরিবহনে চলাচল করা কিশোরী, তরুণী ও নারীদের ৬৩ শতাংশ নানা ধরনের হয়রানির শিকার। এর মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার। আমাদের স্মরণে আছে, এর আগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপরিবহনে কয়েকজন নারী ধর্ষণের শিকার হন এবং ধর্ষণ শেষে হত্যার মতো বীভৎস ঘটনাও ঘটেছে। ঢাকার গণপরিবহনে নারীর জন্য কিছু আসন সংরক্ষিত থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ শোনা যায়, এই সংরক্ষিত আসনও অরক্ষিত হয়ে পড়ে। নারীর এই আসন সংরক্ষণের ব্যাপারে বাগ্বিতণ্ডায় জড়ানোর খবরও সংবাদমাধ্যমে জানা গেছে অনেকবার। তা ছাড়া ঢাকায় নারীর জন্য আলাদা বাসেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে ক্ষুদ্র পরিসরে।
নারীর জন্য ঢাকায় কেন আলাদা বাস চালু করতে হলো- এ প্রশ্নের উত্তরে শুনেছিলাম, গণপরিবহনে নারীর হয়রানি-বিড়ম্বনা কমানোই এর উদ্দেশ্য। ঢাকায় গণপরিবহনে নারীর জন্য যে আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে তা আনুপাতিক হারে যথেষ্ট তো নয়ই; যেটুকু করা হয়েছে সেটুকুও যথাযথভাবে নারীর জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। এ ব্যাপারে অতীতে ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালিত হতে দেখা গেছে। তবে এর সুফল দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আর নারীর জন্য পৃথক যে সংখ্যক বাস ঢাকায় চালু করা হয়েছে তা যেন সিন্ধুর মাঝে বিন্দু। সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে এবং এর হার ঢাকাতে তুলনামূলক অনেক বেশি। তাঁদের বেশিরভাগকেই গণপরিবহনে কর্মস্থলে যাতায়াত করতে হয়।
ঢাকা বা অন্যান্য শহরে নারীরা শুধু কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার জন্যই ঘর থেকে বের হন না; পারিবারিক নানা প্রয়োজনেও তাঁদের বাইরে যেতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে- গণপরিবহনে নারীর জন্য আসন সংরক্ষণ কিংবা আলাদা পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হয় কেন? কেন নারী-পুরুষ এক কাতারে বসে একত্রে গণপরিবহনে যাতায়াত করতে পারবেন না? আমরা একদিকে সভ্যতার বড়াই করছি, অন্যদিকে দেখছি অন্ধকার ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। গণপরিবহনে নারীর জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা কিংবা আলাদা বাসের ব্যবস্থা করে আলোচ্য সমস্যার সমাধান হবে কি? সর্বাগ্রে পরিবর্তন আনতে হবে মানসিকতায়।
নারীর জন্য এই বিকশিত সমাজেও নিরাপত্তাহীনতা জেঁকে বসে আছে। তা ভাবতেও বিস্ময় লাগে। শুধু গণপরিবহনেই নয়; নানা ক্ষেত্রে নারী নির্যাতন-নিপীড়ন-যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছেই। গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার নারীর হেনস্তার প্রতিকারে সুনির্দিষ্ট আইন না থাকলেও অতীতে দেশে ধর্ষণ উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় চূড়ান্ত দণ্ডের বিধান করে আইন করা হয়। এর পরও ধর্ষণের অনেক ঘটনা ঘটেছে। নারী নির্যাতন-নিপীড়ন রোধে কঠোর আইন আছে। তারপরও কি দূর হয়েছে অন্ধকার? প্রযুক্তি আমাদের অনেক রকম সুযোগ এনে দিয়েছে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ের সুফলও মানুষ পাচ্ছে। যে কোনো বিপদ-আপদ, সমস্যা-সংকটে সাহায্য-সহযোগিতার জন্য চালু করা হয়েছে হেল্পলাইন। এর মাধ্যমে বিপদগ্রস্ত যে কেউ সাহায্য-সহযোগিতা চাইতে পারেন। কিন্তু অভিযুক্তকে হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে।
এর আগে এই কলামেই লিখেছিলাম, দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে বলতে হয়, ক্ষয়ের ভাগ বেশি; নির্মাণের অংশ কম। কয়েক দিন আগে একটি পত্রিকায় দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী নির্যাতন-নিপীড়নের সাতটি খবর ছাপা হয়েছে। এই বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না- সব খবরই সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে না। খবরের আড়ালেও খবর থেকে যায়। নারী নির্যাতনের যে বহুমাত্রিক চিত্র দেখা যাচ্ছে, তা সভ্যতা-মানবতার কলঙ্ক।
কয়েক দিন আগে একটি সমীক্ষায় প্রকাশ, ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত গণপরিবহনে ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ৩৮টি। সমীক্ষায় আরও উঠে এসেছিল, এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার ১৩ শতাংশ নারীকে হত্যা করা হয়। গণপরিবহন বিশেষ করে বাসে নারী নির্যাতন ও হত্যার ঘটনাগুলো থেকে খুব সহজেই আঁচ করা যায়, একজন কর্মজীবী নারীর জন্য তাঁর যাতায়াতের পথ কী ভয়াবহ, বিপৎসংকুল হয়ে উঠেছে! আমাদের অজানা নয়- এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর 'নিরাপদ হেফাজতে'ও অনেক নারীর জীবন বিপন্ন
হয়ে পড়েছিল। ইয়াসিমন, সীমাসহ এমন আরও নাম বলা যাবে।
তবে এ কথাও স্বীকার করতে হবে- আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে মানবিক-দায়িত্বশীল কর্মকর্তা-সদস্যের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু এর মধ্যে যারা হীনমন্যতার বীজ ধারণ করে আছে, তাদের চিহ্নিত করা, সতর্ক নজরদারিতে রাখা জরুরি। অস্বীকার করা যাবে না, আমাদের সংস্কৃতিতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বিদেশি সংস্কৃতির অনেক কিছু, যা আমাদের সংস্কৃতির বিপরীত; যেসব সুস্থ সংস্কৃতির আল ভেঙে দিচ্ছে। পরিতাপের বিষয়, অবক্ষয়ের তোড়ে ভেসে যেতে চাইছে মানবিকতার বোধ। এ অবস্থায় কঠোর আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি সমাজ সচেতন সবাইকে যূথবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে। এই অন্ধকার দূর করতেই হবে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখেছি, অপরাধীর সঙ্গে ক্ষমতাবান কারও কারও কত সখ্য! কখনও কখনও ওরা কোনো কোনো রাজনীতিকের আশীর্বাদও পেয়ে থাকে। এই আঁতুড়ঘর ভাঙতে হবে। শুধু গণপরিবহন কেন; সর্বত্র নারীর মর্যাদা ও অধিকার যাতে সমুন্নত থাকে এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল সবাইকে তো বটেই; সমাজের সচেতনদেরও নিজ নিজ ক্ষেত্রে সামাজিক দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠ হতে হবে। সমাজ যদি দুর্বৃত্তদের অভয়ারণ্য হয়ে পড়ে তাহলে মানুষের বসবাস কঠিন হুমকির মুখে পড়বে। এমনটি তো কাম্য হতে পারে না।
আমরা জানি, নারীর ওপর নির্যাতন-সহিংসতা কিংবা ধর্ষণের মতো ঘটনা অনেক ক্ষেত্রেই আদালত পর্যন্ত গড়ায় না। আবার যেগুলোর মামলা হয় সেখানেও অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল কারও কারও যথাযথ ভূমিকা পালন না করার কারণে অভিযুক্তরা পার পেয়ে যায়। এমন নজির অনেক আছে। আদালত বিচার করবেন অভিযোগপত্র, সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে। কাজেই এসব যথাযথভাবে করা যাঁদের দায়িত্ব তাঁরা নিষ্ঠ না হলে আদালতেরই বা কী করার আছে? বিচার প্রক্রিয়া গতিশীল করার পাশাপাশি মানুষরূপী দানবদের সব আস্তানা গুঁড়িয়ে দিতে হবে।
ফিরে ফিরে গণপরিবহনে নারী নিপীড়নের যে চিত্র উঠে আসছে, এর নিরসন ঘটাতে কার্যকর প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমও চালানো প্রয়োজন। এই সমস্যার সমাধান করতে হবে দ্রুত এবং সমাজের বৃহত্তর স্বার্থ ও প্রয়োজনেই। এমন দুস্কর্ম শুধু নারীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্তই করবে না; নারীর অগ্রগতির পথেও বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। যার বিরূপ ফল বহুমুখী। নষ্টদের তো বটেই; প্রতিকারমূলক কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে তাদের বিরুদ্ধেও, যারা ওই নষ্টদের ছায়া দেয়। কোনোভাবেই এই গুরুতর ব্যাধি যাতে জিইয়ে না থাকে সে রকম ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেই হবে। শুধু গণপরিবহন নয়; নারীর পদচারণা সর্বক্ষেত্রে হোক নির্বিঘ্ন।
সেলিনা হোসেন: কথাসাহিত্যিক ও সভাপতি, বাংলা একাডেমি
এবার জরিপে জানা গেছে, গণপরিবহনে চলাচল করা কিশোরী, তরুণী ও নারীদের ৬৩ শতাংশ নানা ধরনের হয়রানির শিকার। এর মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার। আমাদের স্মরণে আছে, এর আগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপরিবহনে কয়েকজন নারী ধর্ষণের শিকার হন এবং ধর্ষণ শেষে হত্যার মতো বীভৎস ঘটনাও ঘটেছে। ঢাকার গণপরিবহনে নারীর জন্য কিছু আসন সংরক্ষিত থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ শোনা যায়, এই সংরক্ষিত আসনও অরক্ষিত হয়ে পড়ে। নারীর এই আসন সংরক্ষণের ব্যাপারে বাগ্বিতণ্ডায় জড়ানোর খবরও সংবাদমাধ্যমে জানা গেছে অনেকবার। তা ছাড়া ঢাকায় নারীর জন্য আলাদা বাসেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে ক্ষুদ্র পরিসরে।
নারীর জন্য ঢাকায় কেন আলাদা বাস চালু করতে হলো- এ প্রশ্নের উত্তরে শুনেছিলাম, গণপরিবহনে নারীর হয়রানি-বিড়ম্বনা কমানোই এর উদ্দেশ্য। ঢাকায় গণপরিবহনে নারীর জন্য যে আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে তা আনুপাতিক হারে যথেষ্ট তো নয়ই; যেটুকু করা হয়েছে সেটুকুও যথাযথভাবে নারীর জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। এ ব্যাপারে অতীতে ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালিত হতে দেখা গেছে। তবে এর সুফল দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আর নারীর জন্য পৃথক যে সংখ্যক বাস ঢাকায় চালু করা হয়েছে তা যেন সিন্ধুর মাঝে বিন্দু। সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে এবং এর হার ঢাকাতে তুলনামূলক অনেক বেশি। তাঁদের বেশিরভাগকেই গণপরিবহনে কর্মস্থলে যাতায়াত করতে হয়।
ঢাকা বা অন্যান্য শহরে নারীরা শুধু কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার জন্যই ঘর থেকে বের হন না; পারিবারিক নানা প্রয়োজনেও তাঁদের বাইরে যেতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে- গণপরিবহনে নারীর জন্য আসন সংরক্ষণ কিংবা আলাদা পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হয় কেন? কেন নারী-পুরুষ এক কাতারে বসে একত্রে গণপরিবহনে যাতায়াত করতে পারবেন না? আমরা একদিকে সভ্যতার বড়াই করছি, অন্যদিকে দেখছি অন্ধকার ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। গণপরিবহনে নারীর জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা কিংবা আলাদা বাসের ব্যবস্থা করে আলোচ্য সমস্যার সমাধান হবে কি? সর্বাগ্রে পরিবর্তন আনতে হবে মানসিকতায়।
নারীর জন্য এই বিকশিত সমাজেও নিরাপত্তাহীনতা জেঁকে বসে আছে। তা ভাবতেও বিস্ময় লাগে। শুধু গণপরিবহনেই নয়; নানা ক্ষেত্রে নারী নির্যাতন-নিপীড়ন-যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছেই। গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার নারীর হেনস্তার প্রতিকারে সুনির্দিষ্ট আইন না থাকলেও অতীতে দেশে ধর্ষণ উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় চূড়ান্ত দণ্ডের বিধান করে আইন করা হয়। এর পরও ধর্ষণের অনেক ঘটনা ঘটেছে। নারী নির্যাতন-নিপীড়ন রোধে কঠোর আইন আছে। তারপরও কি দূর হয়েছে অন্ধকার? প্রযুক্তি আমাদের অনেক রকম সুযোগ এনে দিয়েছে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ের সুফলও মানুষ পাচ্ছে। যে কোনো বিপদ-আপদ, সমস্যা-সংকটে সাহায্য-সহযোগিতার জন্য চালু করা হয়েছে হেল্পলাইন। এর মাধ্যমে বিপদগ্রস্ত যে কেউ সাহায্য-সহযোগিতা চাইতে পারেন। কিন্তু অভিযুক্তকে হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে।
এর আগে এই কলামেই লিখেছিলাম, দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে বলতে হয়, ক্ষয়ের ভাগ বেশি; নির্মাণের অংশ কম। কয়েক দিন আগে একটি পত্রিকায় দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী নির্যাতন-নিপীড়নের সাতটি খবর ছাপা হয়েছে। এই বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না- সব খবরই সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে না। খবরের আড়ালেও খবর থেকে যায়। নারী নির্যাতনের যে বহুমাত্রিক চিত্র দেখা যাচ্ছে, তা সভ্যতা-মানবতার কলঙ্ক।
কয়েক দিন আগে একটি সমীক্ষায় প্রকাশ, ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত গণপরিবহনে ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ৩৮টি। সমীক্ষায় আরও উঠে এসেছিল, এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার ১৩ শতাংশ নারীকে হত্যা করা হয়। গণপরিবহন বিশেষ করে বাসে নারী নির্যাতন ও হত্যার ঘটনাগুলো থেকে খুব সহজেই আঁচ করা যায়, একজন কর্মজীবী নারীর জন্য তাঁর যাতায়াতের পথ কী ভয়াবহ, বিপৎসংকুল হয়ে উঠেছে! আমাদের অজানা নয়- এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর 'নিরাপদ হেফাজতে'ও অনেক নারীর জীবন বিপন্ন
হয়ে পড়েছিল। ইয়াসিমন, সীমাসহ এমন আরও নাম বলা যাবে।
তবে এ কথাও স্বীকার করতে হবে- আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে মানবিক-দায়িত্বশীল কর্মকর্তা-সদস্যের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু এর মধ্যে যারা হীনমন্যতার বীজ ধারণ করে আছে, তাদের চিহ্নিত করা, সতর্ক নজরদারিতে রাখা জরুরি। অস্বীকার করা যাবে না, আমাদের সংস্কৃতিতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বিদেশি সংস্কৃতির অনেক কিছু, যা আমাদের সংস্কৃতির বিপরীত; যেসব সুস্থ সংস্কৃতির আল ভেঙে দিচ্ছে। পরিতাপের বিষয়, অবক্ষয়ের তোড়ে ভেসে যেতে চাইছে মানবিকতার বোধ। এ অবস্থায় কঠোর আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি সমাজ সচেতন সবাইকে যূথবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে। এই অন্ধকার দূর করতেই হবে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখেছি, অপরাধীর সঙ্গে ক্ষমতাবান কারও কারও কত সখ্য! কখনও কখনও ওরা কোনো কোনো রাজনীতিকের আশীর্বাদও পেয়ে থাকে। এই আঁতুড়ঘর ভাঙতে হবে। শুধু গণপরিবহন কেন; সর্বত্র নারীর মর্যাদা ও অধিকার যাতে সমুন্নত থাকে এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল সবাইকে তো বটেই; সমাজের সচেতনদেরও নিজ নিজ ক্ষেত্রে সামাজিক দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠ হতে হবে। সমাজ যদি দুর্বৃত্তদের অভয়ারণ্য হয়ে পড়ে তাহলে মানুষের বসবাস কঠিন হুমকির মুখে পড়বে। এমনটি তো কাম্য হতে পারে না।
আমরা জানি, নারীর ওপর নির্যাতন-সহিংসতা কিংবা ধর্ষণের মতো ঘটনা অনেক ক্ষেত্রেই আদালত পর্যন্ত গড়ায় না। আবার যেগুলোর মামলা হয় সেখানেও অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল কারও কারও যথাযথ ভূমিকা পালন না করার কারণে অভিযুক্তরা পার পেয়ে যায়। এমন নজির অনেক আছে। আদালত বিচার করবেন অভিযোগপত্র, সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে। কাজেই এসব যথাযথভাবে করা যাঁদের দায়িত্ব তাঁরা নিষ্ঠ না হলে আদালতেরই বা কী করার আছে? বিচার প্রক্রিয়া গতিশীল করার পাশাপাশি মানুষরূপী দানবদের সব আস্তানা গুঁড়িয়ে দিতে হবে।
ফিরে ফিরে গণপরিবহনে নারী নিপীড়নের যে চিত্র উঠে আসছে, এর নিরসন ঘটাতে কার্যকর প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমও চালানো প্রয়োজন। এই সমস্যার সমাধান করতে হবে দ্রুত এবং সমাজের বৃহত্তর স্বার্থ ও প্রয়োজনেই। এমন দুস্কর্ম শুধু নারীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্তই করবে না; নারীর অগ্রগতির পথেও বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। যার বিরূপ ফল বহুমুখী। নষ্টদের তো বটেই; প্রতিকারমূলক কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে তাদের বিরুদ্ধেও, যারা ওই নষ্টদের ছায়া দেয়। কোনোভাবেই এই গুরুতর ব্যাধি যাতে জিইয়ে না থাকে সে রকম ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেই হবে। শুধু গণপরিবহন নয়; নারীর পদচারণা সর্বক্ষেত্রে হোক নির্বিঘ্ন।
সেলিনা হোসেন: কথাসাহিত্যিক ও সভাপতি, বাংলা একাডেমি
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com