বন্যায় মজুত খাদ্যশস্যের ৫০ ভাগ নষ্টের শঙ্কা

২৭টি সরকারি গুদামে পানি

প্রকাশ: ২৪ জুন ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ২৪ জুন ২২ । ০২:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দেলওয়ার হোসেন

ছাগনাইয়ার সরকারি খাদ্যগুদামের চারপাশে বৃষ্টির পানি-সমকাল

ভয়াবহ বন্যায় সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের আট জেলার ২৭টি সরকারি খাদ্যগুদামে পানি ঢুকেছে। এতে কয়েক লাখ টন ধান, চাল ও গম নষ্টের আশঙ্কা করা হচ্ছে। একইভাবে সিলেট বিভাগের সব মিল এবং ময়মনসিংহের নেত্রকোনা, শেরপুর ও জামালপুরের বেশিরভাগ মিলে বন্যার পানি প্রবেশ করায় মজুত খাদ্যশস্য নষ্ট হতে পারে। বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় খাদ্যশস্য নষ্টের পরিমাণ এখনও নির্ধারণ করা যায়নি। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কমিটি গঠন করেছে খাদ্য বিভাগ। সংশ্নিষ্টদের ধারণা, বন্যায় মজুত খাদ্যশস্যের ৫০ শতাংশ নষ্ট হতে পারে।

কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ময়মনসিংহ বিভাগে চলতি বোরো মৌসুমে টার্গেট অনুযায়ী চাল উৎপাদন হয়েছিল ২৮ লাখ ২২ হাজার ৩৬২ টন। সিলেট বিভাগে উৎপাদন হয়েছিল ১৯ লাখ ৬২ হাজার টন চাল। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ চাল নষ্ট হতে পারে। কারণ, সিলেট বিভাগের সব মিলে এবং ময়মনসিংহ বিভাগের তিনটি জেলার বেশিরভাগ মিলে বন্যার পানি ঢুকেছে। কৃষকের বাসাবাড়ি ও ব্যবসায়ীদের দোকানের ধান-চালের বেশিরভাগ নষ্ট হয়েছে। গরিব কৃষকরা ভেজা ধান শুকিয়ে চাল তৈরির চেষ্টা করছেন।

দেশের চালকল মালিকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম লায়েক আলী সমকালকে বলেন, এবারের বন্যায় সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের মিল মালিকরা নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন।

খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক বদরুল হাসান বলেন, বন্যার এ ক্ষতি পূরণে কৃষিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করা জরুরি। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারিভাবে পর্যাপ্ত আমদানি করতে হবে।

২৭টি সরকারি খাদ্যগুদামে পানি :খাদ্য বিভাগের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সিলেট বিভাগের চার জেলায় ৪৭টি খাদ্যগুদাম রয়েছে। এর মধ্যে ৮০ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুত রাখা যায়। ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলায় খাদ্যগুদাম রয়েছে ৪৫টি। এতে ১ লাখ ৩০ হাজার টন ধান, চাল ও গম মজুত রাখা যায়। এবারের বন্যায় সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের মজুতকৃত এসব খাদ্যশস্যের মধ্যে প্রায় অর্ধলাখ টন নষ্ট হয়ে গেছে। সিলেট জেলার সদর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা খাদ্যগুদামে পানি ঢোকার পর ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা পাম্প মেশিন দিয়ে পানি সরিয়েছেন। তবে এসব গুদামের নিচের দিকে থাকা ধান, চাল ও গম নষ্ট হয়েছে। বালাগঞ্জ উপজেলা খাদ্যগুদামে এখনও পানি রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা পানি সরানোর জন্য কাজ করছেন। সিলেটে ২০ হাজার টন ধান, চাল ও গম মজুত রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ খাদ্যশস্য বন্যার পানিতে নষ্ট হয়েছে গেছে। এখন কিছু ভেজা চাল শুকিয়ে বানভাসি মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে। সুনামগঞ্জের মল্লিকপুর খাদ্যগুদামে বেশি পানি ঢোকায় কয়েক টন খাদ্যশস্য নষ্ট হয়েছে। একইভাবে নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরী, কলমাকান্দা উপজেলাসহ পাঁচটি খাদ্যগুদামে পানি ঢুকে কয়েক টন খাদ্যশস্য নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া শেরপুরের একটি ও জামালপুরের দুটি খাদ্যগুদামের খাদ্যশস্য নষ্ট হয়েছে বলে জানা গেছে। রংপুর বিভাগের গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট এবং ঢাকা বিভাগের টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জ জেলার কয়েকটি খাদ্যগুদামের ভেতরে পানি প্রবেশ করেছে।

সিলেটের জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নয়ন জ্যোতি চাকমা সমকালকে বলেন, সিলেটের তিনটি উপজেলার খাদ্যগুদামে পানি ঢুকেছিল। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের সহায়তায় পানি সরানো হয়েছে। এখন ভেজা চাল শুকিয়ে বিতরণ করা হচ্ছে। তবে নিচের অংশের চাল কিছু নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া বালাগঞ্জ উপজেলা খাদ্যগুদামে নতুন করে পানি ওঠায় ঝুঁকির মধ্যে আছি।

জানা যায়, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের যেসব খাদ্যগুদামে পানি প্রবেশ করেছে, সেখানকার খাদ্যশস্য অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কয়েকটি খাদ্যগুদামের চাল শুকিয়ে ওএমএস, ভিআর, ভিজিএফ, ভিজিডি হিসেবে বিতরণ করা হচ্ছে।

সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মাইন উদ্দিন সমকালকে বলেন, সম্প্রতি খাদ্যগুদামগুলো সংস্কার করায় যে পরিমাণ খাদ্য ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল, সে পরিমাণ ক্ষতি হয়নি। গুদামের দরজায় বাফেল ওয়াল আছে। ভেতরের মেঝেগুলো তিন থেকে চার ফুট উঁচু আছে। এর পরও নিচের অংশে কিছু ক্ষতি হতে পারে।

ময়মনসিংহ বিভাগের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ আমিনুল এহসান সমকালকে বলেন, বন্যায় কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। আগামী সপ্তাহে প্রতিবেদন পাওয়া যেতে পারে।

বাসাবাড়ির ও দোকানের মজুতও নষ্ট :সিলেটে বিশ্বনাথ উপজেলার কুমারপাড়া গ্রামের কৃষক আইনা মিয়া তাঁর গোলাভর্তি ২০০ মণ ধানের মধ্যে রক্ষা করতে পেরেছেন মাত্র ২০ মণ। এই ২০ মণ ধানও পচে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন। কারণ চার-পাঁচ দিন পানিতে ডুবে থাকার ফলে তাতে চারা গজিয়েছে। কিছু অংশ পচেও গেছে। সেই চারা গজানো পচা ধানও রাস্তায় শুকাতে দিচ্ছেন তিনি। সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় তাঁর মতো অনেকেই বন্যার পানি কমার সঙ্গে ভেজা ধান ও চাল শুকানোর চেষ্টা করছেন। আইনা মিয়া বলেন, নষ্ট ধান কাজে লাগবে না। তারপরও এগুলো শুকিয়ে গরুর খাবার বা অন্য কিছু করার জন্য চেষ্টা করছি। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার গৌরিনগর এলাকার বাসিন্দা কৃষক শফিক উদ্দিনের ক্ষেতের ধান যখন আধাপাকা, তখন পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যায়। সেটা গত মে মাসের কথা। তখনই ধান প্রায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এরপর পানি কমে যায়। সেই ধান কেটে মাড়াই করে ঘরে তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু এবারের বন্যায় আর শেষ রক্ষা হয়নি। ঘরের ভেতর কেটে রাখা ধান পানির নিচে ডুবে ছিল পাঁচ দিন। গতকাল বৃহস্পতিবার শফিক উদ্দিন ওই ধানই রাস্তায় শুকাতে দিয়েছিলেন। শফিক উদ্দিন বলেন, 'ই ধান হুকাইয়া যতখান বালা পাইমু, ওইটাই আল্লার কাছে শুকরিয়া।' গত মে মাসে ময়মনসিংহ বিভাগের হাওর অঞ্চলে ২৮২ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছিল। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের দোকানও পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মজুত খাদ্যশস্য নষ্ট হয়েছে। অনেক ব্যবসায়ীর পুঁজি শেষ হয়ে যাওয়ায় এখন খালি হাতে দোকানে বসেছেন।

সিলেট বিভাগের বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণের অতিরিক্ত পরিচালক মোশাররফ হোসেন খান বলেন, বন্যার পানিতে মিল মালিক, ব্যবসায়ী, কৃষকসহ সবার মজুত খাদ্যশস্য তলিয়ে গেছে। কয়েকদিন পানিতে ডুবে থাকায় অধিকাংশ ধান, চাল নষ্ট হতে পারে।





© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com