'ম্যানেজ' জাদুতে তিনি মাদকসম্রাজ্ঞী

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ১৪ জুলাই ২২ । ০১:৪০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সাজ্জাদ রানা, কুষ্টিয়া

কুষ্টিয়া শহরের অতিপরিচিত মুখ কামিনী খাতুন। চৌড়হাস ফুলতলা মোড়ে কামিনী স্টোর নামে একটি মুদি দোকান আছে। পাশেই তাঁর স্বামী আজাদ সরদারের খড়ির আড়ত। এসব সাইনবোর্ড মাত্র, তাঁদের মূল 'ব্যবসা' মাদকের। নানা পণ্য ও লাকড়ির আড়ালে দিব্যি চলছে গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্যের কারবার। আর এসব নির্দি্বধায় চলে তাঁর 'ম্যানেজ' জাদুতে। দোকানে অভিযান ঠেকাতে পুলিশকে নিয়মিত মাসোহারা, গ্রেপ্তার হলে টাকা দিয়ে মামলা হালকা করা, দ্রুত বের হতে দক্ষ আইনজীবীর সহায়তা এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন মাদকসম্রাজ্ঞী।

পারিবারিকভাবে মাদকের কারবার করছেন কামিনী ও আজাদ, কিন্তু পুলিশ চেনে একজনকে। নারী হিসেবে কামিনী পান বিশেষ সুবিধা, তাই ঝামেলা হলে নিজেই ম্যানেজ করেন নেতা থেকে পুলিশ- সব। এ জন্য থানায় স্থান পেয়েছেন মোস্ট ওয়ান্টেডের তালিকায়। বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হয়ে ২৫টি মামলা খেয়েছেন। কখন কারাগারে থাকেন আর কখন বাইরে থাকেন- তা জানা মুশকিল। এভাবে তাঁর কলঙ্কময় জীবনের বড় একটা সময় জেলে কেটেছে। কারাগারে যেতে হয়েছে তাঁর স্বামী-দুই ছেলেসহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে। তবে তাঁদের বেশি দিন থাকতে হয় না। কোনো না কোনোভাবে সবকিছু 'ম্যানেজ' হয়ে যায়। সর্বশেষ তিনি গত মাসের ১৯ তারিখ ধরা খান। বিপুল পরিমাণ ফেনসিডিল, গাঁজাসহ গ্রেপ্তার হলেও জেলে থাকতে হয়নি ১৫ দিনও। গত ৫ জুলাই জামিনে বের হয়ে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছেন প্রায় এক যুগের পুরোনো কারবার।

পুলিশের খাতায় কামিনীর বর্তমান বসয় ৪৪ বছর। কুষ্টিয়া শহরের মানুষ তাঁকে এক নামে চেনে। প্রায়ই শিরোনাম হন খবরের পাতায়। স্থানীয় এক রাজনীতিক বলেন, এলাকায় অনেক নেতা আছেন, যাঁরা সরকারদলীয় হওয়ার কারণে বেশ প্রভাবশালী। এর মধ্যে একজন স্থানীয় কাউন্সিলর। তিনি সম্পর্কে কামিনীর আত্মীয়। তাঁদের এবং থানা পুলিশকে সন্তুষ্ট করেই মাদকের রমরমা কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন কামিনী। তাঁর কারণে নেশাজাতীয় দ্রব্য সহজেই মেলে, এমনকি ফোন করলেও সংশ্নিষ্ট ব্যক্তির বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয় গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক। এতে তরুণ ও যুবসমাজ ধ্বংস হচ্ছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন ব্যক্তি মাদকাসক্ত হচ্ছেন, বিঘ্নিত হচ্ছে সমাজের শৃঙ্খলা। তবে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর উপায় নেই। কেউ প্রতিবাদ করলে কামিনীর পোষা নেতা ও গডফাদাররা তাঁকে ফাঁসিয়ে দেন, হয়রানি করেন।

সর্বশেষ কামিনীকে গ্রেপ্তার করেন কুষ্টিয়া মডেল থানার এসআই রফিকুল ইসলাম রফিক। তিনি বলেন, এই নারী অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির। সোর্সের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েও অভিযানের শুরুতে তাঁর দোকানে কোনো মাদক পাওয়া যায়নি। এ সময় বিভিন্ন গোপন ড্রয়ারে গাঁজা ও ফেনসিডিল মেলে।

জানা গেছে, পুলিশ মাদকসহ আটক করে জেলে পাঠালেও কিছুদিন পরই বের হয়ে যান। জামিন পাওয়া তাঁর কাছে খুবই সহজ কাজ। তথ্যের গরমিলের কারণে কয়েকটি মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন, অনেক মামলায় চার্জশিট হলেও সাক্ষীর অভাবে অচল হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত কোনো মামলায় সাজাও হয়নি তাঁর। সবই কামিনীর মাদকের টাকার খেলা। স্থানীয় কাউন্সিলর মীর রেজাউল ইসলাম বাবু বলেন, কামিনী সমাজ নষ্ট করছেন। এলাকার তরুণ ও কিশোররাও নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। তাঁকে কোনোভাবেই এই কারবার থেকে নিবৃত করা যাচ্ছে না।

কামিনী খাতুন বলেন, মুদি দোকান করি। আগে মাদকের কারবার থাকলেও এখন নেই। তারপরও পুলিশ পেছনে ঘোরে, টাকা চায়। চাঁদা না দিলে ফাঁসিয়ে দেয়। এভাবে ভালো হতে চাইলেও কেউ সে সুযোগ দিচ্ছে না। আবার কারবার করলে পুলিশ ও নেতাদের নিয়মিত টাকা দিতে হয়; না দিলে হয়রানি করে, জেলে পাঠায়।

কুষ্টিয়া মডেল থানার ওসি সাব্বিরুল আলম বলেন, কামিনীরা সুযোগসন্ধানী। তাঁরা সুযোগ পেলেই মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন। আগে তাঁকে পুলিশের কেউ কেউ সহযোগিতা করতে পারে। তবে এখন কেউ তাঁকে সাহায্য করছে- এমন তথ্য নেই। যদি কোনো পুলিশ সদস্য তাঁকে সহযোগিতা করে বা মাসোহারা নেয়, তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ মাদক প্রতিরোধ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হাসিবুর রহমান রিজু বলেন, কারও সহযোগিতা ছাড়া কামিনী এত বড় হতে পারত না। বারবার গ্রেপ্তার হয়, আবার ছাড়াও পায়। তার সংশোধনের জন্য রাষ্ট্রের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও ভূমিকা রাখতে হবে।



© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com