শ্রীলঙ্কার দুর্দশার নেপথ্যে

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২২ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সমকাল ডেস্ক

শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের সরকারি অফিসের সামনে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে বুধবার হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করে। এ সময় বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস ছোড়ে পুলিশ। রাজধানী কলম্বো থেকে তোলা ছবি এএফপি

শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটই শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাচ্যুত করে ছাড়ল প্রবল পরাক্রমশালী প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসেকে। জনরোষের মুখে বুধবার দিনের আলো ফোটার আগেই রাজাপাকসে মালদ্বীপে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

এ জন্য অবশ্য দেশটির সামরিক বাহিনী সাহায্য করেছে তাঁকে। এর আগে শনিবার বিক্ষোভকারীরা কলম্বোর প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের দখল নিলে এবং প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দিলে পার্লামেন্টের স্পিকার ইয়াপা আবেবর্ধনে জানান, প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া বুধবারই পদত্যাগ করবেন।

বিদ্যুৎবিভ্রাট, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি ও মূল্যস্ম্ফীতিতে ক্ষিপ্ত সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা অনেক দিন ধরেই গোটাবায়ার পদত্যাগ দাবি করে এসেছেন। তবে অবসরপ্রাপ্ত এ সামরিক কর্মকর্তা জরুরি অবস্থা জারিসহ নানান উপায়ে নিজের গদি রক্ষা করে গেছেন। শেষ পর্যন্ত সেসব চেষ্টা বিফলে গেছে।

শ্রীলঙ্কাকে ভয়াবহ সংকটের মুখে ফেলে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন প্রতাপশালী রাজাপাকসে। তাঁর পলায়ন এমন এক সময়ে ঘটল, যখন সোয়া দুই কোটি জনসংখ্যার দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে বেইলআউট নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে এবং সার্বভৌম ঋণ পুনর্বিন্যাস নিয়ে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছিল। এখন প্রেসিডেন্টের পলায়নকে ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতা ও রাজনৈতিক নৈরাজ্য উত্তরণের আলোচনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

শ্রীলঙ্কার বর্তমান এ অবস্থার পেছনে জাতীয় আয়ের তুলনায় বেশি ব্যয়, রপ্তানিযোগ্য পণ্য ও সেবার উৎপাদন পর্যাপ্ত মাত্রায় উন্নীত না করাসহ টানা কয়েকটি সরকারের নানান অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন বিশ্নেষকরা। একসময় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাথাপিছু আয় ছিল শ্রীলঙ্কার।

২০১৯ সালে কলম্বোয় তিনটি হোটেল ও তিনটি গির্জায় হামলা হয়, যে হামলায় দেশি-বিদেশি ২৫০ জন নিহত হন। এ একটি ঘটনাই ধস নামিয়ে দেয় শ্রীলঙ্কার পর্যটন শিল্পে। এই ধাক্কা গিয়ে লাগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। ওই একই সময়ে ক্ষমতায় এসে রাজাপাকসে সরকার ব্যাপক হারে কর কমিয়ে দেয়।

এর ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে চলে যায়। এই ক্ষতি সামাল না দিতেই আঘাত হানে কভিড-১৯ মহামারি। এসবের কারণে শ্রীলঙ্কার রাজস্ব আয়ের বেশিরভাগ উৎসই নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে। বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আসাও কমে যায়। বৈদেশিক মুদ্রার জটিল বিনিময় পদ্ধতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।

দেশটির সরকারের আয় কমে যাওয়া এবং বিদেশি ঋণের বড় বড় কিস্তি পরিশোধে সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে রেটিং সংস্থাগুলো। ফলে ২০২০ সাল থেকে শ্রীলঙ্কার ক্রেডিট রেটিং পড়তে থাকে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশাধিকার কঠিন হয়ে পড়ে কলম্বোর জন্য। ওই অবস্থায় দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে শ্রীলঙ্কার সরকার।

যে কারণে মাত্র দুই বছরে তাদের রিজার্ভের ৭০ শতাংশের বেশি খরচও হয়ে যায়। বিদেশি মুদ্রার এই সংকটই এক সময় উন্নয়নশীল অর্থনীতির মডেল হিসেবে পরিচিত শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে পুরোপুরি পঙ্গু করে দেয়। তীব্র জ্বালানি ঘাটতিতে ফিলিং স্টেশনগুলোতে গাড়ির লাইন দীর্ঘ হতে শুরু হয়। বিদ্যুৎ বিভ্রাট ক্রমাগত বাড়তে থাকে, হাসপাতালে ওষুধ ফুরিয়ে যায়। ওষুধের অভাবে থেমে থাকে জরুরি অপারেশন ও চিকিৎসা।

শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি গত মাসে ছিল ৫৪ দশমিক ৬ শতাংশ, সামনে এটি ৭০ শতাংশ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থনৈতিক সংকটের শুরুর দিনগুলোতে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনায় তেমন আগ্রহী ছিল না রাজাপাকসে সরকার। বিরোধী দলের নেতা ও বিশেষজ্ঞরা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছিলেন; কিন্তু সরকার তাতে কান দেয়নি।

সরকারের নীতিনির্ধারকরা আশা করেছিলেন, পর্যটন খাত শিগগিরই চাঙ্গা হয়ে যাবে, রেমিট্যান্সের প্রবাহও বাড়বে। মহামারির কারণে সেটি না হওয়ায় টনক নড়ে রাজাপাকসে সরকারের। এর পরপরই তারা ভারত ও চীনের মতো অনেক দেশের সাহায্য চাওয়া শুরু করল। শ্রীলঙ্কায় প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে দুই প্রভাবশালী দেশ ভারত ও চীনও দুইভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। কিন্তু সেই সাহায্য আশানুরূপ না হওয়ায় পরে বাধ্য হয়ে আইএমএফের সঙ্গেও আলোচনা শুরু করে শ্রীলঙ্কা।

বর্তমান শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট পদ শূন্য হওয়ায় নতুন করে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা শুরু হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এ সংকট থেকে উত্তরণে সংবিধান বিশেষজ্ঞ জয়দেবা উয়ানগোদা বলেন, প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব না নিলে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্ধনকেই এই দায়িত্ব চালিয়ে নিতে হবে। তিনিই ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত, গোটাবায়ার বাকি মেয়াদে দায়িত্ব পালন করবেন।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com