চামড়ার দরপতন: শুধুই সিন্ডিকেটবাজি নয়

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২২ । ২০:৩৯ | আপডেট: ১৬ জুলাই ২২ । ২০:৩৯

সাইফুর রহমান তপন

ছবি: সমকাল

কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নিয়ে এবারও অসন্তোষ দেখা গেল। ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিশেষ করে বড় গরুর চামড়ার দাম গতবারের চেয়ে একটু বেশি পাওয়া গেলেও, দেশের অন্য এলাকাগুলোর অবস্থা ছিল আগের মতোই। সমকালের খবর অনুসারে, গতবার ঢাকায় যে চামড়ার দাম ছিল ৬০০-৭০০ টাকা, এবার তা মাঠ পর্যায়ে বিক্রি হয়েছে ১০০০-১২০০ টাকায়। আর গ্রামাঞ্চলে ও মফস্বল শহরে ওই চামড়া বিক্রি হয়েছে কোথাও ২০০, কোথাও ৫০০ টাকায়। ছাগলের চামড়ার অবস্থা ছিল গতবারের মতোই। 'চাহিদা না থাকায়' অনেক জায়গায় তা ২-৩ টাকায়ও বিক্রি হয়েছে; কোথাও কোথাও বিক্রি না করতে পেরে বিক্রেতাকে তা বাজারেই ফেলে যেতে হয়েছে। গত দু'বছর করোনা অতিমারির কারণে পশু কোরবানি যেমন কম হয়েছিল, তেমনি চামড়া বিক্রির দীর্ঘদিনের পদ্ধতিটাও এলোমেলো হয়ে পড়েছিল। ফলে বিশেষ করে চামড়ার মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। কিন্তু এবার তো অর্থনীতি, জীবনযাত্রাসহ সবকিছু প্রায় স্বাভাবিক, তার পরও চামড়ার দাম খুব একটা উঠল না কেন?

প্রশ্নটার উত্তর খোঁজার আগে বলে নেওয়া দরকার, ইসলাম ধর্মীয় বিধান অনুসারে কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থের পুরোটারই হকদার সমাজের অসচ্ছল-গরিব মানুষ। সেই রীতি মেনে কোরবানিদাতারা সাধারণত চামড়ার টাকাটা গরিব আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের মাঝে বিলিয়ে দেন। অনেকে টাকা বণ্টনের এ ঝক্কি এড়ানোর জন্য কাঁচা চামড়াটাই বিভিন্ন এতিমখানা ও মাদ্রাসায় দিতে দেন। সেদিক থেকে চামড়ার দরের এ দুরবস্থা সমাজের ওই প্রান্তিক মানুষদেরই বঞ্চিত করল। তবে বাংলাদেশে বছরে যে পরিমাণ চামড়া ব্যবহূত হয় এর অর্ধেকেরও বেশি সংগৃহীত হয় কোরবানির ঈদের সময়। সেই হিসাবে জলের মতো দামের কারণে বিক্রেতা কর্তৃক পথে-ঘাটে পরিত্যক্ত হয়ে চামড়াগুলো যে নষ্ট হলো, তা গোটা জাতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করল।

সমস্যাটার মূল খুঁজতে গিয়ে বরাবরের মতো এবারও অনেকে চামড়া ব্যবসায়ীদের কথিত সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, নিজেদের পকেট ভারী করার লক্ষ্যে এ ব্যবসায়ীরা আগের মতো ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করায় এবারও চামড়ার দাম মাঠ পর্যায়ে হতাশাজনক ছিল। চামড়া ব্যবসায়ীদের দিক থেকে এবার এমন কোনো উদ্যোগ একেবারেই ছিল না, এমনটা কেউ দাবি করতে পারবেন না। কারণ, খোদ শিল্প সচিব বলেছেন, এবার তাঁরা অন্তত এক সপ্তাহের আগে কোনো কাঁচা চামড়া ঢাকায় ঢোকা বা ঢাকার বাইরে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন চামড়া ব্যবসায়ীদের ওই কারসাজি ঠেকানোর জন্য এবং তিনি দাবি করেছেন, এতে তাঁরা সফলও হয়েছেন। তাছাড়া এবার ঈদের আগে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ট্যানারিসহ বিভিন্ন চামড়া কারবারিদের মুখ দিয়ে বারবার প্রচার করা হয়েছে, জনগণ যাতে কোরবানির পশুর চামড়া ছিলার সঙ্গে সঙ্গে তাতে পর্যাপ্ত লবণ লাগান। তাদের পক্ষ থেকে এমনও বলা হয়, এটা করা হলে কাঁচা চামড়া বিক্রেতা নিজের মতো করে বিক্রি করতে পারবেন, চামড়া ব্যবসায়ী বা আড়তদারের কাছে তাঁকে জিম্মি হতে হবে না। বাস্তবেও যেসব এলাকায় এ পরামর্শ অনুসরণ করা হয়েছে, সেসব এলাকায় যেমন- চট্টগ্রামে চামড়ার বেশ ভালো দাম পাওয়া গেছে।

তবে চামড়ার দাম কম হওয়ার বিষয়ে নানা আলোচনায় এবার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে, যার প্রতি সংশ্নিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া জরুরি বলে মনে হয়েছে। বিষয়টি হলো, হাজারীবাগ থেকে যুক্তিসংগত কারণেই ট্যানারি সাভারে সরিয়ে নেওয়া হলেও নতুন ট্যানারি পার্কটি মোটেই কাঙ্ক্ষিত মানসম্পন্ন নয়। বিশেষ করে সেখানে যে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার বা সিইটিপি স্থাপন করা হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক মানের নয়। প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ তরল বর্জ্য শোধন করতে পারলেও কঠিন বর্জ্য শোধনের কোনো ব্যবস্থা এতে নেই। ফলে ট্যানারি বর্জ্যে সেখানকার আশপাশের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েই চলেছে। আবার একই কারণে বাংলাদেশের ট্যানারিগুলোর কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট নেই বলে বিশ্ববাজারে তাঁদের পণ্যের ন্যায্য দাম মিলছে না। তৈরি পোশাকের মতোই চামড়ার বাজারেও বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ড এখন পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনার মানকে গুরুত্ব দিয়ে পণ্য ক্রয় করে। শুধু চামড়ার প্রক্রিয়াকরণ নয়, যে-গরু থেকে চামড়াটি সংগৃহীত হয়েছে, সেটি পরিবেশসম্মতভাবে লালিত-পালিত হয়েছে কিনা তাও তারা দেখে।

বিশ্নেষকদের মতো হলো, সরকার যদি তার ব্যবস্থাপনাধীন ট্যানারি পার্কে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করে, তাহলে ট্যানারি মালিকরাও ব্যবসায়ের স্বার্থেই পণ্যের আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করার দিকে নজর দেবেন। বিষয়টি খুব জরুরি; কারণ আমাদের চামড়ার মান ভালো- এ কথা সবাই স্বীকার করেন, শুধু কমপ্লায়েন্সের অভাবেই এখন আমরা ভালো ক্রেতা পাচ্ছি না। শুধু তা নয়, মাঝখান থেকে মজা লুটে নিচ্ছে ভারত ও চীনের নন-কমপ্লায়েন্ট কারখানাগুলো। দেশে ভালো দাম না পেয়ে অনেকে, বিশেষ করে সীমান্ত এলাকার চামড়ার কারবারিরা অনেক বিধিনিষেধ সত্ত্বেও ভারতে কাঁচা চামড়া পাচার করে দিচ্ছেন। অন্যদিকে, চামড়া রপ্তানিকারকরা অনেকটা জলের দামে চীনা কোম্পানিগুলোর কাছে চামড়া বেচে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

বর্তমানে বিশ্ববাজারে ২৪০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের চামড়ার ও চামড়াপণ্যের চাহিদা আছে। অথচ চামড়ার মান ও সরবরাহ ভালো থাকার পরও এ খাত থেকে ১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় আনতে জান বেরিয়ে যাচ্ছে। অনেকের মতে, চামড়া খাতে এখন অনেক ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা নিজেরাই পরিবেশসম্মত বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনে আগ্রহী, প্রয়োজন শুধু সরকারের নীতি-সহায়তা। আমাদের রপ্তানি খাত বহু বছর ধরে শুধু তৈরি পোশাকনির্ভর, যা শুধু লেনদেনের ভারসাম্যের জন্য নয়, বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার, কর্মসংস্থান তথা গোটা অর্থনীতির জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই রপ্তানিপণ্যের বৈচিত্র্যকরণের বিষয়টি বারবারই আলোচনায় আসছে। এ ক্ষেত্রে পরিবেশসম্মত চামড়া খাত একটা উপায় জোগাতে পারে বলে আমাদের ধারণা।

লেখক: সাংবাদিক

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com