নারী নির্যাতন

সমস্যাটি শুধু লালসা সম্পর্কিত নয়

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২২ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আলা উদ্দিন

গত ৫ আগস্ট রাতে গাজীপুরের শ্রীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে তাকওয়া পরিবহনের একটি চলন্ত বাস থেকে স্বামীকে নামিয়ে দিয়ে এক নারীকে চোখ-মুখ বেঁধে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয় (সমকাল, ৬ আগস্ট)। এর মাত্র তিন দিন আগে, ২ আগস্ট রাতে কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল এক্সপ্রেসের চলন্ত বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বর্বরোচিত কায়দায় ডাকাতির পাশাপাশি পাশবিক নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে (সমকাল, ৪ আগস্ট)। এর আগে, জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক ছাত্রী দলবদ্ধ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এসব অপকর্ম সভ্যতার মাপকাঠিতে মধ্যযুগীয়; কিন্তু সাম্প্রতিক বাংলাদেশে প্রায় সর্বত্র ঘটে চলেছে। রাস্তাঘাট, বাস-ট্রেন, কর্মক্ষেত্র এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

মাত্রা, ধারা, স্থান, ধর্ষকের পরিচয় ইত্যাদি বিবেচনায় যৌন নির্যাতন যেন সবচেয়ে বড় অপরাধে পরিণত হয়েছে সাম্প্রতিক বাংলাদেশে। যৌন সহিংসতার বিস্তার ও প্রতাপ এতটাই প্রকট; করোনা পরিস্থিতিতেও এর হার কমেনি। বরং সবাইকে অবাক করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তোয়াক্কা না করে, সমাজের প্রচলিত বিধিনিষেধকে অবজ্ঞা করে ক্রমেই তা বেড়ে চলেছে। যৌন নিপীড়নের প্রকৃতি ও প্রাদুর্ভাব যেভাবে সমাজের রল্প্রেব্দ রল্প্রেব্দ প্রবেশ করেছে, তা যেন সমাজকে পুরোপুরি পঙ্গু না করা অবধি চলতেই থাকবে, যদি অনতিবিলম্বে এর লাগাম টেনে ধরা না হয়।

যৌন নির্যাতন মোকাবিলা শুধু বিচার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এর সঙ্গে মনোজাগতিক চিন্তাভাবনা, পুরুষতান্ত্রিক মনোবৃত্তি, পুঁজিবাদী দৃষ্টিকোণ, শোষণমূলক সমাজ এবং সমাজে প্রচলিত ভোগবাদী ধ্যান-ধারণার সম্পর্ক বিদ্যমান। অপরিচিত শুধু নয়; কেন নারীরা তার নিকটাত্মীয়েরও যৌন লালসার শিকার হবে? সমস্যাটি শুধু লালসা সম্পর্কিত নয়। কেন একজন পুরুষ নারীর প্রতি হিংস্র হয়ে ওঠে; কেন মনে মানবতাবোধ বা পাপবোধ কাজ করে না; কেন তারা পরিণতি ভাবে না; কিংবা কীভাবে তারা নিশ্চিত থাকে তাদের কিছু হবে না- এ বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা প্রয়োজন।

এটা ঠিক, মাঝেমধ্যে যৌন নির্যাতনের আসামি গ্রেপ্তার হয়। কিছুদিন পর তারা বেরিয়ে এসে আবার যৌন নির্যাতন করে। গ্রেপ্তার হলেও শক্তি বা ক্ষমতার বলে কখনও কখনও অপরাধীরা নির্যাতনের শিকার বা তাদের স্বজনদের বা সংবাদকর্মীর ওপর চড়াও হয়। সাম্প্রতিক সময়ে যেমন দেখা গেছে বরিশালে। ধর্ষণের অভিযোগে আটক ব্যক্তি সাংবাদিকদের বলেছে- 'শোন, সারাজীবন জেলে থাকমু না। কী হইছে? তাতে এত নিউজ করার কী আছে? আমি জেল থেইকা বাইর হইয়্যা লই। ব্যাপারটা দেখমু আনে।' (প্রথম আলো, জানুয়ারি ১৫, ২০২২)।

উদ্বেগের বিষয়, নিজ ঘর, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, থানা, সড়ক, কর্মক্ষেত্র- সমাজের সর্বস্থানে নারীরা বিকৃত মানসিকতার পুরুষের যৌন লালসার শিকার। নির্যাতনকারীদের পরিচয় বিশ্নেষণ করে দেখতে পাই, সমাজের সর্বস্তর ও শ্রেণির পুরুষ এই ঘৃণ্য অপরাধে জড়িত। ফলে কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির পুরুষ নিজেকে আর অপরাধী মনে করে না। এমতাবস্থায় কেউ কাউকে ভয় পায় না, তোয়াক্কা করে না। সুযোগ পেলেই তারা নারী নির্যাতনের চেষ্টা এবং ধর্ষণের সুযোগ খোঁজে। ফাঁদ পাতে বা সুযোগ তৈরি করে।

অথচ কাগজে-কলমে এ দেশে নারীর সার্বিক বিকাশের মাত্রা এশিয়ার মধ্যে অন্যতম। ৯০ দশক থেকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ তথা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নারীদের অবস্থান অত্যন্ত সুদৃঢ়। সেখানে নারী নির্যাতন; নির্দিষ্ট করে যৌন নির্যাতনের হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়া ক্ষমতা ও প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে নারীর অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এমন অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য নারী-পুরুষ সবাইকে মতাদর্শ বদলের মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি-বেসরকারি, আধা-সরকারি, স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সম্প্রদায়, জনপ্রতিনিধি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্মিলিত প্রয়াসে যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সংবাদমাধ্যম এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

নারী নিপীড়ন শুধু নারীর জন্যই ক্ষতিকর নয়; নারীদের নিগৃহীত অবস্থায় ও যৌন নির্যাতনের আতঙ্কের মধ্যে রেখে পুরুষরা তাদের মেধা ও প্রজ্ঞা যথাযথ

ব্যবহার করতে পারবে না। অর্থাৎ সমাজে তাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। একজন নারীকে যদি সর্বক্ষণ তার শরীর নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত থাকতে হয়- তার আশপাশের পুরুষদের কুরুচিকর ভাবনা নিয়ে ক্লাসরুম, স্কুল-কলেজে যাতায়াত, কর্মক্ষেত্র, রাস্তা, বাস, ট্রেন, নিকটাত্মীয়ের বাসা এমনকি আন্দোলনে; তবে সমাজে তাদের সক্ষমতার স্বাক্ষর রাখার সুযোগ কোথায়!

দিনের পর দিন, বছরের পর বছর নারী নিপীড়ন অব্যাহত থাকলে উন্নয়নমূলক ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে নারীর অবদান ও অংশগ্রহণ থেকে দেশ বঞ্চিত হবে। বিপরীতে সবার জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত হলে দেশের উন্নয়ন কয়েক গুণ বেগবান হবে। এই সত্যটি উপলব্ধি করে সংশ্নিষ্ট সবার সজাগ ও সোচ্চার পদক্ষেপ গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। নারী-পুরুষ সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে অবশ্যই এই যৌন নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান হার থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। দৃশ্যমান কয়েকটি উন্নয়নসূচক (শিক্ষার হার, চাকরি কিংবা বাসে বসার আসন) দিয়ে নারীর এই নাজুক অবস্থার অবসান সম্ভব নয়।

ড. আলা উদ্দিন: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
alactg@gmail.com

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com