
চাপ আছে, সমাধানও সম্ভব
বার্তা বুঝলে ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব: এম হুমায়ুন কবির
প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ১৯ আগস্ট ২২ । ০১:৪২ | প্রিন্ট সংস্করণ
-

এম হুমায়ুন কবির, সাবেক রাষ্ট্রদূত
বাংলাদেশে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট। তিনি এ ধরনের অভিযোগের পক্ষপাতহীন, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্তের জন্য সরকারকে তাগিদ দিয়েছেন। চার দিনের সফরে এসে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নানা পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন মিশেল ব্যাচেলেট। তাঁর পর্যবেক্ষণের বিষয় নিয়ে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন মন্ত্রীসহ দেশের বিশিষ্টজন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আবু সালেহ রনি ও তাসনিম মহসিন
সমকাল : জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটের বাংলাদেশ সফরটিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
এম হুমায়ুন কবির : তাঁর সফর বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গত বছর বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে আলোচনা হয়েছে, এসেছে সুপারিশও। মানবাধিকারের বিভিন্ন মাত্রা নিয়ে বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সামনের বছর সংসদ নির্বাচন রয়েছে। সেই নির্বাচন সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও স্বচ্ছ হওয়া বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি এমন নয় যে, নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়া। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্প আয়ের দেশের কাতার থেকে বের হয়ে আসবে। ফলে আগামী নির্বাচনে যে সরকার আসবে, তাদের এ বিষয়টিতে ব্যবস্থাপনা করতে হবে। স্বল্প আয়ের দেশের কাতার থেকে বের হয়ে আসা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্যতার বিষয় রয়েছে। সেসঙ্গে অভ্যন্তরীণভাবে সক্ষমতা দেখানোর বিষয়টিও আছে। ফলে নির্বাচনের আগে অনেকগুলো শক্ত সিদ্ধান্ত আমাদের নিতে হবে। বাংলাদেশ স্বল্প আয়ের দেশের কাতার থেকে বের হয়ে আসতে হলে ৫০ বছর ধরে আমাদের জীবনযাত্রা, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, মানবাধিকার, সক্ষমতা, দক্ষতা, প্রতিযোগিতার মতো বিষয়গুলো পুনর্বিন্যাস করতে হবে। সেই বিবেচনায় মিশেল ব্যাচেলেটের সফরটি বেশ গুরুত্ব বহন করে।
সমকাল : কী বার্তা দিয়ে গেলেন তিনি?
এম হুমায়ুন কবির : আগামী নির্বাচন শুধু গ্রহণযোগ্য নয়, কিছু মৌলিক বিষয়ে একটি ঐকমত্যের জায়গায় বাংলাদেশকে আসতে হবে। মিশেল ব্যাচেলেট সংবাদ সম্মেলনে সবার জন্য অংশগ্রহণের বিষয়টি বলেছেন। এ জন্য অভ্যন্তরীণভাবে কিছু বিষয় সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। এ সংস্কারের একটি জায়গা হচ্ছে মানবাধিকার। এ বিষয়ে বাংলাদেশকে মনোযোগী হতে বলেছেন তিনি। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেন সরকার ক্ষমতায় আসার পর জঙ্গিবাদ দমনের অগ্রাধিকার পাল্টে মানবাধিকার বৈশ্বিক অগ্রাধিকার পেয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন ও বিবর্তন হচ্ছে। এগুলো অনেক ক্ষেত্রে সহিংস হচ্ছে, আবার সহিংসতার দিকে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের মানবাধিকার রক্ষায় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্ব পাচ্ছে। মিশেল ব্যাচেলেট খুবই ভারসাম্যপূর্ণ একটি বার্তা দিয়েছেন। সব পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে সবার মতামত শুনেছেন। আর তাঁর বক্তব্যে সেই বিষয়টিই উঠে এসেছে। বাংলাদেশের মানবাধিকারের বিষয়গুলোতে যে নেতিবাচক জায়গাগুলো রয়েছে, মানবাধিকার নিয়ে যে বাংলাদেশে সমস্যা রয়েছে, সেটির স্বীকৃতি যেন বাংলাদেশ মনোযোগ দিয়ে চিন্তা করে- সেই কথায় তিনি জোর দিয়েছেন। কারণ কোনো বিষয়ে সমাধান চাইলে রোগ জানতে হবে, রোগ জানলেই তার ওষুধ দেওয়া যায়। সবাইকে নিয়ে বাংলাদেশ গড়তে হবে। তা ইতিবাচক জায়গায় নেওয়ার বার্তাই তিনি দিয়েছেন।
সমকাল : মিশেল ব্যাচেলেট যে সুপারিশগুলো করেছেন, তা মানার বাধ্যবাধকতা বাংলাদেশের রয়েছে কি?
এম হুমায়ুন কবির :মিশেল ব্যাচেলেট নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কারের সুপারিশ করেছেন। বিষয়টি বাংলাদেশকে মনোযোগ দিতে হবে। কারণ বাংলাদেশে যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁদের ক্ষমতা ব্যবহারের প্রবণতা থাকে। এ ক্ষমতার ব্যবহার যদি আইন অনুযায়ী হয়, সাধারণ মানুষের কল্যাণে যাতে হয়- সেটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনাগুলো সুনির্দিষ্টভাবে তদন্তের জন্য তিনি নিরপেক্ষ একটি তদন্ত দল গঠনের কথা বলেছেন। এখানে তিনি সমস্যা শুধু চিহ্নিত করেননি, সেই সমস্যা সমাধানের বিষয়েও পরামর্শ দিয়েছেন। এখানে তাঁর করা সুপারিশ বা পরামর্শ মানা বা না মানার বাধ্যবাধকতার বিষয় নেই। কারণ বাংলাদেশ যখনই জাতিসংঘের সদস্য পদ নিয়েছে, তখনই জাতিসংঘের সনদগুলোর দায় বাংলাদেশ নিয়েছে। আমাদের সংবিধানেও বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ। তিনি নতুন কিছু বলেননি, বাংলাদেশের অঙ্গীকারের কথা মনে করিয়েছেন।
সমকাল : বাংলাদেশ যদি পরামর্শ ও সুপারিশ না মানে?
এম হুমায়ুন কবির : জাতিসংঘের সুপারিশ মানবে কী মানবে না, সেটার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তাদের হাতে অস্ত্র আছে। বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে তারা সেটি প্রয়োগ করে। আমি তো সে জায়গায় যেতে চাই না। আমার সংবিধানের আওতায়, জাতিসংঘের সনদের আওতায় আমার মানবাধিকার রক্ষায় যে অঙ্গীকার রয়েছে, তাতে আমার সন্মান জানাতে হবে।
সমকাল : এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে বলে মনে করছেন কি?
এম হুমায়ুন কবির :এটিকে বাইরের চাপ হিসেবে দেখতে চাই না। আমি এটাও চাই না, বাইরের মানুষ এসে আমাদের মানবাধিকারের কথা বলবে। বাংলাদেশের মানবাধিকার সুরক্ষাকে আমি নিজেদের দায় হিসেবে দেখছি। জাতিসংঘ এ দায় সম্পাদনে সহযোগিতা করতে চায় এবং কী কী ভাবে করতে চায়, সেটিই তারা জানিয়েছেন।
সমকাল : রোহিঙ্গা নিয়ে মিশেল ব্যাচেলেটের বক্তব্য কীভাবে দেখছেন?
এম হুমায়ুন কবির :আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য যতটুকু প্রতিবেদন করা হয়েছে, সেটি জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল করেছে। আমাদের কথার থেকে জাতিসংঘের প্রতিবেদন আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ বাংলাদেশের সঙ্গে শুধু নয়, আমরা যেভাবে চাই, তার থেকে সামনে গিয়ে তারা সহযোগিতা করছে। মিশেল ব্যাচেলেট তাঁর বক্তব্যে এটাই বলেছেন যে, যতক্ষণ রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে রয়েছেন, তাদের প্রতি সদয় থাকতে। তবে জাতিসংঘকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে সেখানে আরও সক্রিয় হতে হবে।
সমকাল : এ সফর মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরকার যে অবস্থা নিয়েছে, তা কীভাবে দেখছেন?
এম হুমায়ুন কবির :এটির দুটি দিক রয়েছে। একটি সরকার যেটি বাইরে বলেছে, আর আরেকটি যেটি ভেতরে চিন্তা করেছে। আমার উপলব্ধি, চিলির সাবেক এ প্রেসিডেন্ট যখন একটি কথা বলেন, সেটি হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। সরকার গণমাধ্যমে যেটি বলেছে, সেটি মূলত রাজনৈতিক কারণে। সরকার দুর্বল হচ্ছে, বিরোধীরা যাতে সুযোগ না পায়, সে জায়গা সুরক্ষা দেওয়ার জন্য মন্ত্রীরা বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। কিন্তু ভেতরে যখন আলোচনা হয়েছে, সরকারের মধ্যে এতটুকু উপলব্ধি এসেছে, মানবাধিকার নিয়ে সমস্যাগুলো আমলে নেওয়া দরকার। আমি মনে করি, সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com