
চাপ আছে, সমাধানও সম্ভব
'অভ্যন্তরীণ ব্যাপার' বলে চাপমুক্ত হওয়া যাবে না: ড. শাহ্দীন মালিক
প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ১৯ আগস্ট ২২ । ০১:৪৪ | প্রিন্ট সংস্করণ
-

ড. শাহ্দীন মালিক, বিশিষ্ট আইনজীবী
বাংলাদেশে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট। তিনি এ ধরনের অভিযোগের পক্ষপাতহীন, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্তের জন্য সরকারকে তাগিদ দিয়েছেন। চার দিনের সফরে এসে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নানা পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন মিশেল ব্যাচেলেট। তাঁর পর্যবেক্ষণের বিষয় নিয়ে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন মন্ত্রীসহ দেশের বিশিষ্টজন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আবু সালেহ রনি ও তাসনিম মহসিন
সমকাল :জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটের পরামর্শের যৌক্তিকতা কতটুকু?
ড. শাহ্দীন মালিক :এটা অবশ্যই যৌক্তিক। যখনই কোনো গুরুতর অপরাধের অভিযোগ ওঠে, তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব হলো সেই অভিযোগের তদন্ত করা; পরে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনা। মিশেল ব্যাচেলেটের সুপারিশের কারণও স্পষ্ট। গত কয়েক দিনে সরকার বা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা মন্ত্রী- সবাই একযোগে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা প্রকারান্তে অস্বীকার করেছেন; যেটা মিশেল ব্যাচেলেটের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে প্রতীয়মান হয়নি।
সমকাল :এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন কিনা?
ড. শাহ্দীন মালিক :১৯৩ দেশ বর্তমানে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত। কোনো দেশ যদি সর্বজনস্বীকৃত মানবাধিকার বা আইনের শাসন লঙ্ঘন করে, তাহলে জাতিসংঘের ওপর দায়িত্ব বর্তায় সংশ্নিষ্ট দেশকে তাদের এই গাফিলতির কথা মনে করিয়ে দেওয়া; আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। যেমন- কোনো দেশ যদি নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচনের আয়োজন না করে, কোনো শাসক যদি দশকের পর দশক দেশ শাসন করতে থাকে, তাহলে জাতিসংঘ সংশ্নিষ্ট দেশকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তাগিদ দেয় এবং চাপ প্রয়োগ করে থাকে। সব দেশের ব্যাপারে জাতিসংঘ সব সময়ই সফল হয়- সেটা দাবি করা যাবে না। তাই বলে জাতিসংঘকে নির্বাচনের জন্য চাপ ও প্রভাব প্রয়োগ থেকে অভ্যন্তরীণ ব্যাপারের অজুহাতে বিরত রাখা যাবে না। জাতিসংঘ যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন, আইনের শাসন, বৈষম্য, নারীর সমঅধিকার এবং অন্য সংশ্নিষ্ট বিষয়ে যদি কিছু বলতে না পারে, তাহলে জাতিসংঘের অস্তিত্ব মূল্যহীন হয়ে পড়বে। এ কারণেই বাংলাদেশের মানবাধিকার ইস্যুতে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের পর্যালোচনা ও সুপারিশকে অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বলে মনে করার সুযোগ নেই।
সমকাল :সরকার পরামর্শগুলো গ্রহণ করবে বলে মনে করেন কিনা?
ড. শাহ্দীন মালিক :আমাদের সবার, অর্থাৎ দেশ, জনগণ ও সরকারের জন্য ভালো হবে, যদি সরকার সুপারিশগুলো আমলে নেয়। অন্যথায় এর বিভিন্ন ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি আমাদের সম্মুখীন করতে পারে। যেমন- বিনিয়োগের আগে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আমাদের মতো দেশের মানবাধিকার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, আইনের শাসন এবং বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতার ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়। এতে যদি দেশের নেতিবাচক চিত্র ফুটে ওঠে, তাহলে ছোট-বড় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হন না। তাই সুপারিশগুলো উপেক্ষা করলে প্রথমত, আমাদের উন্নয়নযাত্রা সংকটে পড়তে পারে। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের গ্রহণযোগ্য এবং ভাবমূর্তি প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। তৃতীয়ত, অপরাধীদের বিচার না হলে দেশের মানুষ অশান্তি, অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। তাই সব দিক বিবেচনা করে মিশেল ব্যাচেলেটের সুপারিশগুলো সরকারের আমলে নেওয়া উচিত।
সমকাল :অনেকে বলছেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী করা হলে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের পরামর্শ অনুযায়ী স্বাধীন তদন্ত সংস্থা গঠন করার প্রয়োজন নেই। আপনি কী মনে করেন?
ড. শাহ্দীন মালিক :মানবাধিকার আর অপরাধ এক বিষয় নয়। অপরাধ হলো ফৌজদারি আইনে হত্যা, অপহরণ, বেআইনিভাবে আটকে রাখা, মারধর, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি। আইনে এসব সংজ্ঞায়িত করা থাকে এবং তার শাস্তির বিধান থাকে। এসব অপরাধ ঘটলে তদন্ত, সাক্ষ্য-প্রমাণ, সাক্ষী ইত্যাদি সংগ্রহ করে বিচারের আওতায় নেওয়ার জন্য সব দেশেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তৈরি করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আর মানবাধিকার লঙ্ঘন হলো, অপরাধ না করে কোনো জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা লিঙ্গের প্রতি বৈষ্যম্যমূলক আচরণ না করা; বিচারের জন্য পর্যাপ্ত বিচারক ও আদালত স্থাপন না করা; কোনো গোষ্ঠী বা দলকে বিচারের সম্মুখীন না করা ইত্যাদি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, জোর করে অপহরণ, গুম ইত্যাদি হলো ফৌজদারি অপরাধ; যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি নিরপেক্ষ ও সঠিক পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে থেকেই কিছু দক্ষ, যোগ্য, নিরপেক্ষ ও সৎ ব্যক্তিকে এ ধরনের ফৌজদারি অপরাধের তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া। আর বিশেষ ক্ষেত্রে এ দেশে গত কয়েক বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ইত্যাদির ব্যাপারে উল্লিখিত বিশেষ তদন্ত দলের সঙ্গে নিরপেক্ষ ও যোগ্য কিছু আইনজীবী, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী এবং অন্য পেশার মানুষকে সার্বক্ষণিকভাবে যুক্ত করা। এতে তদন্তের ফলাফলে যদি কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপরাধের আলামত বা আসামিকে চিহ্নিত বা খুঁজে পাওয়া নাও যায়, তাহলে সেটা জনগণের কাছে এবং আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণ ও বিশ্বাসযোগ্য বলে প্রতীয়মান হবে।
সমকাল :রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে বক্তব্য না দিয়ে মিশেল ব্যাচেলেট মানবাধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশকে স্বাধীন তদন্ত সংস্থা গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন। এটাকে কীভাবে দেখছেন?
ড. শাহ্দীন মালিক :রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন নির্ভর করবে মিয়ানমারে তাদের নিরাপদ, স্বাধীন ও অধিকারসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে বসবাসের নিশ্চয়তার ওপর। এই নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য জাতিসংঘ এবং এর বিভিন্ন সংস্থা নানা সময়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। তবে চীন, রাশিয়াসহ আরও কিছু দেশের সহায়তা ও সমর্থনে মিয়ানমার এখনও এই দাবিগুলো উপেক্ষা করে চলছে। তাই এ মুহূর্তে মিশেল ব্যাচেলেটের মিয়ানমারের পরিস্থিতি পাল্টে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এটা চলমান প্রক্রিয়া। আমরা সবাই আশা করি, মিয়ানমার সেই দেশের সব জাতি, গোষ্ঠী, গোত্র ও ধর্মের মানুষের জন্য একটা নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে উঠবে। তখনই আমাদের এখানকার রোহিঙ্গারা নিজ দেশে নিশ্চিন্তে ফেরত যাবেন।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com