সাক্ষাৎকার: জি এম কাদের

জনপ্রিয়তা কমছে সরকারের, নির্বাচন এবার কঠিন হবে

রওশনের সঙ্গে কেউ নেই, রাঙ্গা বিভ্রান্ত

প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২২ । ০৮:৩১ | প্রিন্ট সংস্করণ

--

জাতীয় পার্টি (জাপা) হঠাৎ বেসুরো। সরকার ও নির্বাচন ব্যবস্থার সমালোচনায় মুখর দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের। 'প্রকৃত' বিরোধী দল হওয়ার কথা বলছেন। দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রওশন এরশাদের সঙ্গে চলছে আধিপত্যের লড়াই। এসব বিষয়ে বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদেরের সঙ্গে কথা বলেছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রাজীব আহাম্মদ

সমকাল :জাতীয় পার্টি হঠাৎ বেসুরো হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, জাতীয় পার্টি চাইলে অন্য জোটে যেতে পারে। আবার আওয়ামী লীগের দরজাও সবার জন্য খোলা।


জি এম কাদের :প্রধানমন্ত্রী ঠিক কথাই বলেছেন। জাতীয় পার্টি আলাদা দল। চাইলে আওয়ামী লীগের জোটে যেতে পারে; আবার বেরিয়েও যেতে পারে। নির্বাচনের সময়েই দেখা যাবে, কার সঙ্গে জোট করব। এখন নির্বাচনের অনেক দেরি। নির্বাচনের সময় জনগণ ও দলের নেতাকর্মী যেদিকে চাইবেন, জাতীয় পার্টি সেদিকেই যাবে।

সমকাল :রওশন এরশাদকে সরিয়ে আপনাকে বিরোধীদলীয় নেতা করতে স্পিকারকে ১ সেপ্টেম্বর চিঠি দিয়েছেন। এত দিনেও বিরোধীদলীয় নেতার স্বীকৃতি পেলেন না। এটা কি একটি বার্তা নয়?

জি এম কাদের :স্পিকার দেশে ছিলেন না। প্রধানমন্ত্রীও বিদেশে ছিলেন। সংসদ নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি জানাতে হবে স্পিকারকে। আশা করছি, তিনি দেবেন (বিরোধীদলীয় নেতার স্বীকৃতি)। স্বাভাবিকভাবে এখানে না দেওয়ার কিছু নেই।


সমকাল :যে কথাটি প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনেও উঠেছে এবং রাজনীতিতেও স্বীকৃত- জাতীয় পার্টি হঠাৎ বেসুরো। ধারণা করা হচ্ছে, সরকারের সঙ্গে জাতীয় পার্টির দূরত্ব বাড়ছে। গৃহপালিত বিরোধী দলের তকমা মুছতে চাইছেন; নাকি আসলেই পথ আলাদা হয়ে গেছে?


জি এম কাদের :
সরকারের সঙ্গে কখনোই শত্রুতা ছিল না। বন্ধুত্বও ছিল না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতা ছিল। রাজনৈতিক কারণে কখনও কখনও এক হয়েছিলাম। শাসন পদ্ধতিতে সরকার ও বিরোধী দল- দুটি পক্ষ। সরকারে যেহেতু নেই, আমরা বিরোধী দল। যখন আওয়ামী লীগের জোটে ছিলাম, তখন এক সুরে কথা বলেছি। গত নির্বাচনে জাতীয় পার্টির পক্ষে কাজ করেছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করেছেন। নির্বাচনের পরপরই- ১০ দিন, এক মাসে সখ্য চলে যাওয়ার বিষয় না। কাজেই সেই সখ্য ছিল। এখনও শত্রুতা নেই। তারপরও সময়ের সঙ্গে বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করছি। সরকারের দোষ-ত্রুটি তুলে ধরা আমাদের দায়িত্ব।

সমকাল :দোষ-ত্রুটি তুলে ধরতে গিয়ে বলছেন, সরকারের জনসমর্থন নেই। সরকার জনবিচ্ছিন্ন। নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে ভোটে জিততে চাইছে।


জি এম কাদের :
মানুষের মনে যা আসছে, আমাদের মনেও তা আসছে। তা আমরা বলছি। মানুষ আমাদের সমর্থন করছে।

সমকাল :জাতীয় পার্টিও তো ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের অংশীদার। কিন্তু হঠাৎ নির্বাচন ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনকে ধুয়ে দিচ্ছেন। কমিশনকে সরকারের দোসর বলছেন। তাদের সক্ষমতা, সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। কমিশনের নির্বাচনী রোডম্যাপকে মূল্যহীন বলছেন।

জি এম কাদের :আসল গন্ডগোল নির্বাচনেই। বাংলাদেশে গণতন্ত্র দীর্ঘ দিন নেই। ভোটের দিনে, এক দিনের গণতন্ত্র ছিল। যার জন্য পাঁচ বছর পরপর ভোটের মাধ্যমে জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহি ছিল। মানুষের পছন্দ না হলে ভোট দিয়ে সরকার পরিবর্তন করতে পারত। সরকারকেও চিন্তা করতে হতো- ভোটের মুখোমুখি হতে হবে। নির্বাচনই একমাত্র রক্ষাকবচ ছিল। নির্বাচন ঠিক হলে গণতন্ত্রের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক করা যাবে। নির্বাচন ভালো না হলে কিছুই করা যাবে না।

সমকাল :৪ সেপ্টেম্বর বলেছেন, 'যেনতেন নির্বাচন করে আর পার পাওয়া যাবে না।'


জি এম কাদের :আমি মনে করি, এবার সরকারের জন্য কঠিন হবে। আমরা জরিপ করিনি। মানুষের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি- মানুষ এক সরকারকে বেশি দিন দেখতে চায় না। এ কারণে ধারণা করছি, সরকারের জনপ্রিয়তা অনেক কম।


সমকাল :আপনার বক্তব্যের মানে কিন্তু অতীতে যেনতেন নির্বাচন হয়েছে।

জি এম কাদের :১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত মোটামুটি ভালো ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে। শতভাগ ভালো না হলেও, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সব জায়গায় গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে।


সমকাল :
শেষ দুই নির্বাচনকে যেনতেন বলেছেন?

জি এম কাদের :২০১৪ সালের পর থেকে নির্বাচনের মান খারাপ হয়েছে।

সমকাল :গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে অংশ নেবে জাতীয় পার্টি?

জি এম কাদের :অবশ্যই। নির্বাচন বর্জন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। নির্বাচন বর্জন করে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যাবে কিনা, তা ভাবতে হয়। অংশ নিলে কী অর্জন হবে, তা দেখতে হয়। অঙ্ক কষে মন্দের ভালো যেটা, সেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসেনি। এককভাবে নির্বাচন বর্জনের দিকে যেতে পারব না। ৩২ বছর জাতীয় পার্টি ক্ষমতার বাইরে। নির্বাচনের বাইরে চলে গেলে দল অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।

সমকাল :নির্বাচন কমিশনের এত সমালোচনা করেও তাদের অধীনে নির্বাচনে যাচ্ছেন!

জি এম কাদের :আস্থা নেই, তবুও গিয়ে দেখি কী হয়। দেখতে চাই তারা (নির্বাচন কমিশন) কী করে। কারচুপি হলে মানুষ জানবে এই নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে। আমরা তো জানতাম না- ইভিএমেও কারচুপি হয়। নির্বাচনে অংশ নিয়েছি বলেই জেনেছি। জনগণও জেনেছে। নির্বাচনে অংশ নিয়ে দেখাতে চাই নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে।


সমকাল :
তাহলে আগামী সংসদ নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি অংশ নিচ্ছে?

জি এম কাদের :না, না, না। তা বলব না। জাতীয় পার্টি নির্বাচনমুখী দল- এ কথা বলব না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এবং ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছিলাম। জাতীয় পার্টির নির্বাচন বর্জনের ইতিহাস রয়েছে। অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেব। এমন কিছু করব না, যা করতে গিয়ে আমাদের সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে।

সমকাল :বিএনপির নিখোঁজ নেতা ইলিয়াস আলীর ছেলের বিয়েতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে এক টেবিলে বসার ছবি নিয়ে তো আলোচনা চলছে। বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক হতে পারে?

জি এম কাদের :রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শত্রু নয়। সে যারই ছেলে হোক, মানুষ হিসেবে দাওয়াত করেছে। মানুষ হিসেবে গিয়েছি। রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী শত্রু হওয়াতেই আজকের এ অবস্থা। ভয় পায়- নির্বাচনে হারলে তাকে মেরে ফেলা হবে। তার দল শেষ করে দেওয়া হবে। এ কারণে কেউ নির্বাচনে হারতে চায় না। যে কোনোভাবে ক্ষমতায় থাকতে চায়। তা করতে গিয়ে যে কোনো খারাপ কাজ করে। যুক্তরাজ্যে একজন প্রধানমন্ত্রী চলে যাচ্ছেন, আরেকজন আসছেন। অসুবিধা তো নেই।

সমকাল :জাতীয় পার্টিতে ফিরি। ২০১৯ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর আপনার ও রওশন এরশাদের বিরোধ হয় বিরোধীদলীয় নেতার পদ নিয়ে। তারপর সমঝোতা হয়। আপনি রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতা পদে মেনে নেন। তিনি আপনাকে দলের চেয়ারম্যান পদে মেনে নেন। সমঝোতা ভাঙল কেন?


জি এম কাদের :
রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরানোর চেষ্টা ছিল না। তাঁর অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে কিছু লোক তাঁকে ব্যবহার করছে। যে কারণে দলে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। রওশন এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা। তাঁর নামে কোনো বক্তৃতা, বিবৃতি, বার্তা দিলে জাতীয় পার্টির রাজনীতির ধারাবাহিকতা ধাক্কা খায়। সে কারণেই সংসদীয় দল এবং প্রেসিডিয়াম সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়েছে- রওশন এরশাদকে যেহেতু অপব্যবহার করা হচ্ছে, তাই তাঁকে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া ভালো।

সমকাল :সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের কথা বলছেন। কিন্তু মসিউর রহমান রাঙ্গা পরে ঘুরে গেলেন।

জি এম কাদের :রাঙ্গা বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ হিসেবে সভার কার্যবিবরণী লিখেছেন। নিজেও স্বাক্ষর করেছেন। পরে যে কথা বলেছেন, তা আগের কাজের সঙ্গে মিল নেই। এ ধরনের লোককে রাখলে দল সম্পর্কে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। কাজী ফিরোজ উপনেতা হওয়ার শর্তে সই দেননি। তিনি বলেছিলেন, এরশাদ সাহেব জীবদ্দশায় তাঁকে উপনেতা করতে চেয়েছিলেন। উপনেতার পদ খালি; তিনি প্রার্থী হতে চান। এটা ছিল কথার কথা।

সমকাল :গুঞ্জন রয়েছে, রওশন এরশাদের পক্ষে সরকারের সমর্থন রয়েছে, যা আপনার পছন্দ নয়।

জি এম কাদের :রওশন এরশাদ অনেক দিন অসুস্থ। তাঁর সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ রয়েছে, এমন কিছু শুনিনি। তিনি ছাড়া সবাই তো একসঙ্গেই আছি। রাঙ্গাও ছিলেন। সবকিছুতেই তাঁর সম্মতি ছিল। কারও প্ররোচনায় তিনি বিভ্রান্ত হয়েছেন।

সমকাল :রওশন এরশাদ গত জুনে দেশে ফিরে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকার তাঁর খবর নিয়েছেন। জাতীয় পার্টির কেউ খোঁজ নেয়নি। তার মানে তো, রওশন এরশাদের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ আছে।

জি এম কাদের :এটাও তাঁকে দিয়ে বলানো হয়েছে। আমরা প্রতিদিন খোঁজ নিয়েছি। এখন তিনি অনেকটাই সুস্থ। মাঝেমধ্যে খবর নিই।

সমকাল :জাতীয় পার্টি এর আগে সাতবার ভেঙেছে। বিরোধীদলীয় নেতার পদ নিয়ে আবার ভাঙবে?

জি এম কাদের :দল ভাঙার কোনো আশঙ্কাই নেই।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com