নতুন সম্ভাবনার অন্বেষণে: জাভেদ আখতারের জীবনের প্রেরণার কথা

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২২ । ১১:১১ | আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২২ । ১১:২৯

অনলাইন ডেস্ক

ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি, দ্রুত শিল্পায়ন ও সামষ্টিক জনসংখ্যার আদর্শগত পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ বিনিয়োগের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দেশের প্রবৃদ্ধির পথে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে তৈরি পোশাক খাত, টেলিযোগাযোগসহ রিটেইল ইন্ডাস্ট্রি যেমন ফাস্ট-মুভিং কনজ্যুমার গুডস্ (এফএমসিজি) খাত। একটি স্থিতিশীল ও দ্রুত বর্ধনশীল শিল্প গড়ে ওঠায় ভোক্তার জীবনধারা এবং আচরণগত পরিবর্তনে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এফএমসিজি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কয়েক দশক ধরে দেশের ভোক্তা বাজারে প্রতিষ্ঠিত বহুজাতিক কোম্পানি এবং বৃহৎ দেশীয় কর্পোরেটদের আধিপত্য গড়ে উঠেছে।

প্রেরণার কথা’র তৃতীয় সিজনের তৃতীয় পর্বে অতিথি হয়ে এসেছেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি তার পেশাদার ক্যারিয়ারের দুই দশক এফএমসিজি শিল্পে অবদান রেখে আসছেন। বাংলাদেশের কর্পোরেট জগতের একজন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব তিনি। যিনি নিজ কর্মনিষ্ঠা, অধ্যাবসায় ও মেধার মাধ্যমে এ প্রজন্মের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি আর কেউ নন, ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও জাভেদ আখতার। প্রেরণার কথা’র এ পর্বে, জাভেদ আখতার বলেছেন তার জীবনের সাফল্য ও প্রেরণার গল্প, জানিয়েছেন নতুন সম্ভাবনার অন্বেষণে তার অবিরাম পথচলার কথা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে স্নাতক অর্জনের পর তিনি একটি স্বনামধন্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মজীবন শুরু করেন। তারপর ২০০০ সালে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ নিত্যব্যবহার্য পণ্য উৎপাদনকারী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড, তৎকালীন লিভার ব্রাদার্স লিমিটেড-এ সিনিয়র ব্রান্ড ম্যানেজার হিসাবে যোগদান করেন। ক্যারিয়ারের পরবর্তী দুই দশকের বেশি সময়ে তিনি দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় ইউনিলিভারের হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ভিন্ন কর্ম-পরিবেশে, ভিন্ন কর্ম-সংস্কৃতিতে কাজের সুবাদে তিনি বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পান। এসব অভিজ্ঞতাই পরবর্তীতে তার ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড-এর সিইও হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পথ সুগম করেছে। এ বিষয়ে জাভেদ আখতার বলেন, “আমি অনেক সৌভাগ্যবান, কারণ ইউনিলিভারে দুই দশকের ক্যারিয়ারে অনেকগুলো ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসাইনমেন্টে গিয়েছিলাম। প্রথম অ্যাসাইনমেন্টে যখন আমি যাই সেটা ছিল ২০০৪ সালে। আমি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে মার্কেটিং-এ ইনোভেশনের একটা দায়িত্বে, রিজিওনাল রোলে গিয়েছিলাম।”

সাক্ষাৎকারে তিনি এফএমসিজি ব্যবসা, বাংলাদেশে এ খাতের ক্রমোন্নতি, কনজ্যুমার লাইফস্টাইলে পরিবর্তন এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এ খাতের ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ অবস্থা- এ সকল কিছু নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন।

“এফএমসিজি ব্যবসার বেস্ট পার্ট হচ্ছে, এটা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত, বিবর্তিত হতে থাকে। ২০ বছর আগে যদি বলি, যেমন বাংলাদেশে আমরা তখন লন্ড্রী সাবান বিক্রি করতাম, সেখান থেকে আস্তে আস্তে আমরা ডিটারজেন্ট পাউডারে চলে এলাম। তখন আমরা ছাই দিয়ে বাসন মাজতাম। সেখান থেকেই আস্তে আস্তে মানুষ ভিম বারে চলে এসেছে। এবং এখন তারাই ভিম লিক্যুইড ব্যবহার করছে। ২০০০ সালের দিকে আমি তখন ওরাল কেয়ারের ব্রান্ড ম্যানেজার ছিলাম। বাংলাদেশের প্রতি ৫ জনের মধ্যে ১ জন টুথপেস্ট ব্যবহার করতো। সে অবস্থা থেকে এখন লক্ষ্য করলে আমাদের দেশে টুথপেস্টের ব্যবহার প্রায় সর্বজনীন। এই রুপান্তর সম্ভব হয়েছে কারণ দেশের মানুষের ডিসপোজেবল ইনকাম বেড়েছে। তার সাথে শিক্ষার মান, জীবনধারা ইত্যাদিতেও পরিবর্তন এসেছে। এই ট্রান্সফরমেশনের ফলেই, আমাদের কনজ্যুমার বেসিক প্রোডাক্ট থেকে আরেকটু ইভল্ভড প্রোডাক্ট বেছে নিয়েছে। এর পরের ধাপেই তাদের মাঝে প্রিমিয়াম প্রোডাক্টের চাহিদা তৈরি হয়,” জাভেদ আখতার বলেন।

বাংলাদেশে এফএমসিজি বাজারে ‘স্যাচুরেশন’ শব্দটি প্রায়ই শোনা যায়। এ প্রসঙ্গে জাভেদ আখতার বলেন, “আমার নিজের মতে, ‘স্যাচুরেশন’ শব্দটি ইনএফিশিয়েন্ট মার্কেটিং-কেই ইঙ্গিত করে মাত্র। অর্থাৎ আমরা মার্কেটের ফুল পোটেনশিয়াল আনলক করতে পারছি না। এবং আমি এ মতবাদে  বিশ্বাস রাখি না। বাংলাদেশে অ্যাভারেজ পার ক্যাপিটা কনজাম্পশন প্রায় ২০-২৩ মার্কিন ডলার। সে তুলনায়, ভারতে সেটা ৪০ মার্কিন ডলার এবং ফিলিপাইনে ১০০ মার্কিন ডলার। তো আপনি যদি দেখেন, ফিলিপাইনে প্রায় ১১ কোটি মানুষের বসবাস, আর এদিকে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি। সেক্ষেত্রে আমার পার ক্যাপিটা কনজাম্পশন কেন কম হবে? অবশ্যই এখানে একটি বিশাল অপর্চুনিটি আছে।”

ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরিতে ইউনিলিভারের মতো প্রতিষ্ঠানের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করেন জাভেদ আখতার। তিনি বলেন, “আজকের বিশ্বে, ট্যালেন্ট ডেভলপমেন্টের ক্ষেত্রে ডাটা অ্যানালাইটিকস্ এর দক্ষতা তৈরির একটি বড় সুযোগ রয়েছে। সারা বিশ্বে, আজ আমরা যে পরিমাণ ডাটা বা তথ্য নিয়ে কাজ করছি, ডাটা অ্যানালাইটিকস্-এর দক্ষতা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে।”

অনেকেই আছেন যারা দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করেছেন মাল্টিকালচারাল পরিবেশে এবং সফলতার সাথে ফেরত এসেছেন বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বজায় রেখে। আমাদের লোকাল ট্যালেন্টরা যদি বাইরে যেতে চায় তাহলে তাদের কী ধরনের প্রস্তুতি প্রয়োজন, এ বিষয়ে জাভেদ আখতার বলেন, “আমাদের ক্যারিয়ার যখন শুরু হচ্ছিল, সেসময়ের তুলনায় এখন লোকাল ট্যালেন্টদের অনেকেই বাইরে যাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে  বাইরে যাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মার্কেটের স্ট্যান্ডার্ড খুব ডিফারেন্ট। শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট ফ্রেমওয়ার্কের ভেতর থেকে  পড়াশোনা করে যাওয়া কখনই পর্যাপ্ত নয়। আমাদেরকে ওই জিনিসগুলার জন্য আরো  বাড়তি জ্ঞান সংগ্রহ করতে হবে। আমি সবসময়ই বলি যে, নেক্সট জেনারেশন মার্কেটারদের অ্যানথ্রোপোলজিস্ট হতে হবে . . . কনজ্যুমার বিহেভিয়ারের চেয়ে সাইকোলজি আরও ভালো বুঝতে হবে। কারণ, কনজ্যুমার বিহেভিয়ারের স্কোপ কিন্তু লিমিটেড। আমাদের আরও বড় পরিসরে, বিগার ইম্প্যাক্ট নিয়ে ভাবতে হবে। আমাদের কাজের এনভাইরনমেন্টাল ফুটপ্রিন্ট নিয়ে চিন্তা করতে হবে।”

বিজনেস স্কুল থেকে মার্কেটিং এ স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করে জাভেদ আখতার তার ক্যারিয়ারের অধিকাংশ কাটিয়েছেন একজন মার্কেটিং প্রোফেশনাল হিসেবে। একজন সিইও হওয়ার জন্য বা কোনো প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য মার্কেটিং ব্যাকগ্রাউন্ড থাকা কতটা জরুরি এ বিষয়ে জাভেদ আখতার বলেন, “আমি মনে করি না যে মার্কেটিং-ই হতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে আমি নিজে মার্কেটিং ব্যাকগ্রাউন্ডের। সিইও হতে হলে যে জিনিসটা দরকার সেটা হচ্ছে যে পুরো ভ্যালু চেইনের একটা বড় অ্যাপ্রিসিয়েশন। যদিও আমি মার্কেটিং পড়েছি কিন্তু  আমার বিভিন্ন ভূমিকায় এন্ড-টু-এন্ড এক্সপোজার হয়েছিল। আমার সর্বশেষ ভূমিকা ছিল ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন। ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনে কিন্তু আমার পুরো এন্ড-টু-এন্ড ভ্যালু চেইনে কাজ করতে হয়েছিল।”

আলোচনায় জাভেদ আখতার আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে নিজের ভাবনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশের জন্য পরিবেশগত সংকট সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। এর সমাধান নির্ভর করে আমরা কি করে এই সংকটকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি, এবং আমার ধারণা এই জায়গাটায় আমরা সকলেই একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারি। আমার জায়গা থেকে আমি চেষ্টা করছি প্লাস্টিক কনজাম্পশন নিয়ে কাজ করার, কারণ এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ সমস্যার একটি টেকসই সমাধান বের করা আমাদের সকলেরই ব্যক্তিগত দায়িত্ব হওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি। আমাদের দেশের জন্য আরেকটি বড় ইস্যু হচ্ছে পানি। ভূগর্ভস্থ পানি এবং সেচকাজে ব্যবহৃত পানি, দুই ক্ষেত্রেই আমাদের চ্যালেঞ্জ আছে। ওয়াটার হার্ভেস্টিং বিষয়টি একটি চিন্তার ব্যাপার আমাদের জন্য। একজন সিইও হিসেবে, আমি এই দুটি বিষয়ে কাজ করে যেতে আগ্রহী। আমার কাজের মাধ্যমে যদি দেশের জন্য কোন অবদান রেখে যেতে পারি, তা অবশ্যই হবে এ দুটি ক্ষেত্রে- প্লাস্টিকের সাস্টেইনেবল সার্ক্যুলার ইকোনমি এবং ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট।”

প্রেরণা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রেরণার কথা’র অংশ হিসেবে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর অধ্যাপক ড. মেলিতা মেহজাবিন। প্রেরণার কথা’র পুরো পর্বটি দেখা যাবে প্রেরণা ফাউন্ডেশনের ইউটিউব চ্যানেলে।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com