উন্নয়ন

করিম সাহেবের দরিদ্র হওয়ার গল্প

প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২২ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী

বাংলাদেশের যে উন্নয়ন হয়েছে- এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। পদ্মা সেতু থেকে মেট্রোরেল; ধারাবাহিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি থেকে রপ্তানিতে ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক- অনেক ক্ষেত্রেই উন্নয়ন দৃশ্যমান। কথা হলো এই উন্নয়নের ফলাফল আসলে কী? এই উন্নয়ন কি বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে সুষম বণ্টন হয়েছে? জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জীবনকে এই উন্নয়ন আসলে কতটা উন্নত করেছে? কাল্পনিক অথচ আশপাশেই বিভিন্ন নামে বাস্তব করিম সাহেবের জীবনের গল্প দিয়ে বিচার করা যাক।

করিম সাহেব বাংলাদেশের বেশিরভাগ মধ্যবিত্তের মতো বেসরকারি চাকরিজীবী। ঢাকা শহরের বাসিন্দা এই ব্যক্তির মাসিক আয় ২০১৭ সালে ছিল ৫০ হাজার টাকা। বেশিরভাগ বেসরকারি চাকরির মতো তাঁরও পেনশন বা গ্র্যাচুইটির ব্যবস্থা নেই। ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাই ২০১৭ সালে করিম সাহেব অনেক কষ্টে জমানো ৫ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন পাঁচ বছরের জন্য। চিন্তা করেছিলেন, পাঁচ বছর পরে এ সঞ্চয়ের মুনাফা তাঁর জীবন সহজ করবে। গ্রামের দিকে এক টুকরো জমি কিনতে পারবেন; সন্তানদের শখ পূরণ করতে পারবেন।

২০২২ সালে করিম সাহেবের সঞ্চয়পত্র ম্যাচিউর হয়েছে। তাঁর ৫ লাখ টাকা মুনাফাসহ ৭ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ টাকা হয়েছে। তিনি বেশ খুশি; পাটিগণিত করতে বসলেন- গত পাঁচ বছরে তিনি কতটা ধনী হয়েছেন। দেখলেন, ২০১৭ সালে ৫ লাখ টাকা দিয়ে করিম সাহেব অন্তত ৫ হাজার ৮১৪ ডলার কিনতে পারতেন (৮৬ টাকা দরে)। সাড়ে ৭ লাখ টাকা দিয়ে এখন তিনি ৬ হাজার ৮৪০ ডলার কিনতে পারবেন (১১০ টাকা ডলার ধরে)। তিনি প্রায় ১ হাজার ২৭ ডলার বেশি কিনতে পারছেন। সংখ্যাটা দেখে একটু দমে গেলেন। ৫ বছরে মাত্র ১ হাজার ২৭ ডলার বেশি! তার মানে, বছরে মাত্র ২০৫ ডলার? ৫ লাখ টাকার বিনিয়োগে প্রতিবছরে মাত্র ২২ হাজার ৫৫০ টাকা?

করিম সাহেব ভাবলেন, ডলারের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে হয়তো সঞ্চয়ের লাভ কম দেখাচ্ছে। চিন্তার কিছু নেই। তিনি তো ডলার কিনতে যাচ্ছেন না। কিনবেন চাল, তেল, খাবার। আবার ক্যালকুলেটর নিয়ে বসলেন। তিনি বাসায় নাজিরশাইল চাল খান। ২০১৭ সালে তিনি প্রতি কেজি নাজিরশাইল চাল কিনতেন ৪৭-৪৮ টাকা কেজি দরে। ৫ লাখ টাকা দিয়ে তিনি প্রায় ১০ হাজার ৪১৭ কেজি চাল কিনতে পারতেন তখন। ২০২২ সালে ৮০ টাকা কেজিতে সাড়ে ৭ লাখ টাকা দিয়ে তিনি কিনতে পারছেন ৯ হাজার ৪০৬ কেজি চাল। তার মানে, পাঁচ বছর ধরে ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে তিনি এখন মুনাফার টাকাসহ আগের চেয়ে ১ হাজার ১১ কেজি চাল কম কিনতে পারছেন!

নিজের হিসাবকে করিম সাহেব বিশ্বাস করতে পারছেন না; দ্রুত তেলের অঙ্কে চলে গেলেন। ২০১৭ সালে তিনি তাঁর ৫ লাখ টাকা দিয়ে বোতলজাত তেল কিনতে পারতেন প্রায় ৫ হাজার ১০৩ লিটার (৯৮ টাকা লিটার)। আর এখন সাড়ে সাত লাখ টাকা দিয়ে কিনতে পারেন ৪ হাজার ১৮০ লিটার (১৮০ টাকা লিটার)। প্রায় ৯২৩ লিটার কম! এভাবে গরুর মাংস, সবজি, ওষুধের দাম, বাস ভাড়া সবকিছুতেই করিম সাহেব দেখতে থাকলেন, আগে ৫ লাখ টাকায় যে পরিমাণ জিনিস পেতেন; এখন ৭ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ টাকায় তার চেয়ে কম পাচ্ছেন। অবাক হয়ে আবিস্কার করলেন- রক্ত পানি করে জমানো টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে আসলে তিনি গরিব

হয়ে গেছেন!

করিম সাহেবের মতো অবস্থা বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত মানুষের। কীভাবে আমরা এসব মানুষের জীবনমান উন্নত করতে না পারি; অন্তত আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিতে পারি?

প্রথমেই স্বীকার করে নিতে হবে, আমাদের মুদ্রাস্টম্ফীতি অনেক বেড়ে গেছে। আমরা রিজার্ভ রক্ষায় টাকাকে অবমূল্যায়িত করছি। জ্বালানির দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়িয়েছি। ব্যাংক সুদের হার ৬-৯-এ বেঁধে রেখেছি। এতে মুদ্রাস্টম্ফীতি আরও বেড়েছে।

মুদ্রাস্টম্ফীতি কমানোর বেশ কিছু বিশ্বস্বীকৃত পদ্ধতি আছে। প্রথমটি হলো ব্যাংকের সুদ বাড়িয়ে দেওয়া। এটি যদিও ঋণ খরচ বাড়িয়ে দিয়ে বিনিয়োগ খরচ বাড়িয়ে দেবে। তার পরও আমাদের এটি করতে হবে। এটা না বাড়ানোর অর্থ হলো, সঞ্চয়কারীকে 'শাস্তি' দিয়ে ঋণগ্রহীতাকে ভর্তুকি দেওয়া। মুদ্রাস্ম্ফীতিকালে এটা কাম্য নয়।

একই সঙ্গে আমাদের অর্থনীতি যেন স্থবির হয়ে না পড়ে, সে জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি কমাতে হবে। পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, 'আউট অব দ্য বক্স' পদক্ষেপ নিলে অর্থনীতি সঠিক পথে চলে আসবে। এই আউট অব দ্য বক্স পদক্ষেপ শুরু হোক পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার মধ্য দিয়ে।

পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- আমাদের এক টুকরো জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না। সেটা করতে হবে। বিশ্বরাজনীতি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। কিন্তু নিজের শস্য উৎপাদন করতে পারব। সেটা করতে হবে। সারে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। সরকারকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেবা বা পণ্য উৎপাদনমূল্যে সরবরাহ করতে হবে। ব্যবসা বা মুনাফা করার সময় এখন নয়।

এসব করতে পারলে করিম সাহেব তাঁর সঞ্চয়পত্রের টাকা দিয়ে অন্তত বিনিয়োগের সময়কার সমপরিমাণ জিনিসপত্র কিনতে পারবেন। তা না হলে করিম সাহেবরা গরিব থেকে গরিবতর হতে থাকবেন। প্রয়োজনে উন্নয়ন মডেল বদলিয়ে করিম সাহেবদের চুরি হয়ে যাওয়া ক্রয়ক্ষমতা ফেরত দিতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশের সত্যিকারের উন্নয়ন হবে।

রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী :সহকারী অধ্যাপক, ফিন্যান্স, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com