আগামী

নৈতিক মূল্যবোধ

প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২২ । ১০:৩৫ | প্রিন্ট সংস্করণ

মো. আখতারুজ্জামান

বাংলাদেশ বিশ্বে আজ উন্নয়নের রোল মডেল, একটি অনুকরণীয় দেশ। এটি সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে, বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে; যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তোরণ ঘটেছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতি-সংক্রান্ত কমিটি (সিডিপি) গত ১৫ মার্চ এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক এ তিনটি সূচকের যে কোনো দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদণ্ডেই উন্নীত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর গতিশীল নেতৃত্ব, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গসমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাক শিল্প, ওষুধ শিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক যেমন পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পগুলো। দেশ আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বপ্টেম্নর মানবিক, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হওয়ার পথে অনেক দূর এগিয়েছে।

ক্ষুদ্র আয়তনের একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়েও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সারাবিশ্বের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্রঋণের ব্যবহার এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে তার ভূমিকা, বৃক্ষায়ন ও সবুজায়ন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকের ইতিবাচক পরিবর্তন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে জন্ম নেওয়া এই বাংলাদেশকে আজকের অবস্থানে আসতে অতিক্রম করতে হয়েছে হাজারো প্রতিবন্ধকতা। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আটটি লক্ষ্যের মধ্যে শিক্ষা, শিশুমৃত্যুহার কমানো এবং দারিদ্র্য হ্রাসকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে। নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের করা মন্তব্য এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, 'কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেওয়ার মতো সাফল্য আছে বাংলাদেশের। বিশেষত শিক্ষা সুবিধা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার ও জন্মহার কমানো, গরিব মানুষের জন্য শৌচাগার ও স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান এবং শিশুদের টিকাদান কার্যক্রম অন্যতম।'

নারী বঞ্চনার তিক্ত অতীত পেরিয়ে বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে অনেকদূর এগিয়েছে। পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ দেশ। আর এই শিল্পের সিংহভাগ কর্মী হচ্ছেন নারী। ক্ষুদ্রঋণ বাংলাদেশে গ্রামীণ উন্নয়নে ও নারীর ক্ষমতায়নে অভূতপূর্ব অবদান রেখেছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্র ও পরিধি সম্প্রসারণ করতে পারলে বিশ্বে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ হবে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দৃষ্টান্ত।

প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ স্বপ্টম্নকে বাস্তব রূপ দিতে বঙ্গবন্ধু দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরামর্শ ও পরিকল্পনায় বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে যুগান্তকারী সব পদক্ষেপ। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সেবা পৌঁছে দেওয়ার অভিপ্রায়ে দেশের ৪৫৫০টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এ পোর্টালের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। দেশের সব কটি উপজেলাকে আনা হয়েছে ইন্টারনেটের আওতায়। কৃষি খাতে অভূতপূর্ব কিছু সাফল্যের জন্য বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ বারবার আলোচিত হয়েছে। প্রায় ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষি উৎপাদন ও উন্নয়নের কারণেই অনেক দেশের ক্ষুধা পীড়িত কঠিন সদয় ও ভঙ্গুর অর্থনীতির বিপরীতে বাংলাদেশ আজ আত্মমর্যাদায় অবস্থান করছে দৃঢ়ভাবে।

গত এক দশক ধরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় ও বিভিন্ন খাতে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। বর্তমান মেয়াদের অবশিষ্ট সময়ে সরকারের উচিত শাসন প্রক্রিয়া-সংক্রান্ত বিভিন্ন সূচকে উন্নতির জন্য আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের একার পক্ষে সব বিষয়ে সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয়। সরকারের পাশাপাশি সব রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠন ও দল, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির দায়িত্ব হলো দেশের উন্নতির জন্য সরকারকে সহায়তা করা।

শিক্ষক হলেন শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার মূল শক্তি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের কাজের পরিধি অনেক বেড়েছে। বেড়েছে অনেক চ্যালেঞ্জও। বর্তমান সমস্যা মোকাবিলা করে আগামীর সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য দক্ষ, আধুনিক ও সময়োপযোগী শিক্ষক তৈরি করতে হবে। ডিজিটাল রিসোর্স তৈরি করার জন্য এবং এডুকেশন টুলস ব্যবহার করার জন্য প্রশিক্ষিত শিক্ষকের বিকল্প নেই। তাই শিক্ষক প্রশিক্ষণের সব ব্যবস্থা নিতে হবে। গতানুগতিক চিন্তা থেকে বের করে বিশ্বায়নের সব সুযোগ যেন আমাদের শিক্ষকরা গ্রহণ করতে পারেন, তার জন্য নানা কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সব সহায়ক উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও এর গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু এর অপব্যবহারে তরুণ প্রজন্ম দিন দিন বইবিমুখ হয়ে যাচ্ছে। দেশের গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে পারে না। অথচ তারা ইচ্ছা করলে যে কোনো সৃজনশীল চর্চায় মনোনিবেশ করতে পারে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একাকী স্মার্টফোনের সঙ্গে অনেক সময় অপচয় করছে। মানবীয় সম্পর্ক ও মূল্যবোধে ঘাটতি পড়ছে। এখান থেকে তরুণদের বের করে আনতে হবে। মনে রাখতে হবে, আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। সময়ের সঙ্গে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য আমাদের শিক্ষার্থীদের একুশ শতকের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতায় প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা, সহযোগিতামূলক ও দলগত দক্ষতা, নৈতিকতা ও সহমর্মিতা, সক্রিয়তা নিয়ে আরও ভাবতে হবে। এ দক্ষতাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সূক্ষ্ণ বহুমাত্রিক নানা জটিল চিন্তা বোঝার এবং সে আলোকে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন এখন অত্যাবশ্যক। যুগের চাহিদা ও আগামীর কথা মাথায় রেখেই কারিকুলাম পুনঃসংস্করণ করা জরুরি। প্রয়োজন কমিউনিটি বেজড জীবনমুখী শিক্ষাক্রম। এর মাধ্যমে শিক্ষা বৈষম্য কমিয়ে আনা সম্ভব। এ শিক্ষাক্রম প্রস্তুতিতে অবশ্যই শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষা-সংশ্নিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমন্বয় করতে হবে। জীবনমুখী ও প্রাকৃতিক শিক্ষা টেকসই হয়। দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রাকৃতিক বাস্তবমুখী নানা কার্যক্রমও এ শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ভাষা দক্ষতা মারাত্মকভাবে থুবড়ে পড়েছে। বাংলা ভাষাও নানাভাবে আক্রান্ত; হারাচ্ছে সুর, মাধুর্য আর গাম্ভীর্য। হয়ে পড়ছে দ্ব্যর্থবোধক, স্পষ্টতার ঘাটতি। জন্ম দেয় ভুল বোঝাবুঝির, ঘটে মানবীয় সম্পর্কের অবনতি। শুদ্ধ প্রমিত বাংলা চর্চা ও আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজির ব্যবহার খুবই জরুরি। আন্তর্জাতিক ভাষা না জানলে দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থান হারাতে হবে; নীচু গ্রেডের কাজে থাকতে হবে সন্তুষ্ট। সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও সামগ্রিক অবদান রাখার ক্ষমতা হয়ে যাবে ক্ষীণ। সর্বোপরি শিক্ষার সব স্তরেই মানবিক ও নৈতিক শিক্ষার সংশ্নেষণ অপরিহার্য। তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি বিভিন্ন কাজ ও উদ্যোগের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করে মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ চর্চার প্রায়োগিক কর্মপ্রয়াসের বিকল্প নেই। আগামীর বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য অন্যান্যের মধ্যে বিক্ষিপ্ত এসব ধারণার বাস্তবায়ন বোধ করি অপরিহার্য।

লেখক
উপাচার্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com