বায়ুদূষণ রোধে চাই আইনের কঠোর প্রয়োগ ও সম্মিলিত উদ্যোগ

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২২ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

--

দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন গাজীপুরের আয়তন ৩২৯ বর্গকিলোমিটার। গাজীপুর ও টঙ্গী এলাকা মিলিয়ে ৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকা দীর্ঘদিন ধরে ধুঁকছে বায়ুদূষণে। পুরো নগরের রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো এখন ধুলোমাখা। কেউ কারখানার বর্জ্য নদীতে ফেলছে, কেউ ময়লা আবর্জনা রাস্তায় ফেলছে। ধুলাবালু ওড়াচ্ছে। নেই কোনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। চলছে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ। দূষণ ছড়াচ্ছে কলকারখানাও। দূষণ বাড়াতে থেমে নেই সরকারি প্রকল্পও। এমন পরিস্থিতিতে গত ২১ সেপ্টেম্বর গাজীপুরে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সম্মেলন কক্ষে 'বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব এবং আমাদের করণীয়' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক থেকে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ জোরদার, সচেতনতা বাড়ানো, আইন প্রয়োগে কঠোর হওয়াসহ নানা প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। বায়ুদূষণ রোধে সম্মিলিত উদ্যোগের পাশাপাশি গাজীপুরকে পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণার প্রস্তাবও উঠে আসে এতে। সমকাল ও ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ যৌথভাবে বৈঠকের আয়োজন করে

আসাদুর রহমান কিরন

সারাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন গাজীপুর। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, দেশের মধ্যে গাজীপুর সবচেয়ে দূষিত নগর। এখানে তিন হাজারেও বেশি শিল্পকারখানা আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রতিষ্ঠান আছে এখানে। প্রধানমন্ত্রী গাজীপুরের মানুষকে সেবার মান বাড়াতে সিটি করপোরেশন উপহার দেন। বরাদ্দও দিয়েছেন সর্বোচ্চ। এ শহরে অনেক মেগা প্রকল্প চলছে। অন্যান্য কারণের পাশাপাশি গাজীপুরে আরেকটি প্রকল্পও দূষণের জন্য বেশি দায়ী। মেগা প্রকল্পগুলো শেষ হলে বায়ুদূষণ একটু কমবে। আমাদের জনবল সংকট আছে। তবে অল্প সময়ের মধ্যে গাজীপুরকে পরিবেশবান্ধব নগরী উপহার দিতে পারব। আমাদের একটি প্রকল্প এ বছর শেষ হবে। আরেকটি আগামী বছরের জানুয়ারিতে শেষ হবে। নাগরিকদের প্রধান সেবা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। অথচ এখানে ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল। ডাম্পিং স্টেশনের জন্য জমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম শেষ করতে পারলেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিক হবে। মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন হলে নগরীতে দূষণ কমবে।

আনিসুর রহমান

গাজীপুর শহর অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। ৫২৭টি কারখানায় ইটিপি স্থাপন করা হয়েছে। আমরা এগুলোকে মনিটর করতে পারি না। এগুলোর বর্জ্য খাল-নদীতে যাচ্ছে। দুর্বল আইনের কারণে অনেক সময় তাদের ধরা যায় না। আইনের ফাঁক গলিয়ে অনেকেই রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন। আমরা কঠোর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছি। আগামী দুই-এক মাসের মধ্যে যেসব শিল্পকারখানা দূষণ ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গাজীপুরকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণার প্রস্তাব করছি। গাজীপুরকে বলা হয় জিডিপির শহর। কিন্তু পরিবেশের যে ক্ষতি করা হচ্ছে, তার হিসাব আমরা করছি না। জীববৈচিত্র্য নিয়েই আমাদের উন্নত দেশ হতে হবে। গাজীপুরকে বসবাস উপযোগী করতে সবাইকে নিয়ে বসতে হবে। শিল্পপতিরা এখানে বসবাস করেন না। তাঁরা শুধু এখান থেকে আয় করেন। দূষণের জন্য যিনি দায়ী, তাঁকে চিহ্নিত করতে হবে। আমরা নীরবে-নিভৃতে গাজীপুরকে মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী করে ফেলছি। এ শহরের মানুষ যে শ্বাস নিচ্ছে তা বিষ। আমাদের সবাইকে সচেতন হওয়া দরকার। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভাবতে হবে। কারণ এই প্রজন্মই আগামীর বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে।

আবু সাঈদ খান

আমরা পরিকল্পিত নগর চাই। জনবান্ধব নগর গড়তে দরকার নানা পদক্ষেপ। দূষণ প্রতিরোধের জন্য আইন আছে। আইনের প্রয়োগ নেই। আইন প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার। গাজীপুরকে দূষণমুক্ত করতে দরকার জনসচেতনতা। দরকার নাগরিক উদ্যোগ। প্রয়োজন নাগরিক আন্দোলন। যে আন্দোলনের চাপের মুখে সংশ্নিষ্ট প্রশাসন সতর্ক হয়ে উঠবে। এ আলোচনার মধ্য দিয়ে খানিকটা হলেও সচেতনতাবোধ জেগেছে। এবারই শেষ নয়। এমন আলোচনা অব্যাহত থাকবে।


মো. আকবর হোসেন

আমি ৩৩ বছর ধরে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে কর্মরত। গাজীপুরে দুটি পৌরসভা ও একটি সিটি করপোরেশন রয়েছে। গাজীপুর সিটিতে শিল্পায়ন হয়েছে অত্যন্ত অপরিকল্পিতভাবে। আমরা চেষ্টা করছি পরিকল্পিত নগর গড়তে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কারণে ইউনিয়ন পরিষদগুলো অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে। এ নগরে ড্রেনেজ ও রাস্তাঘাট সেভাবে হয়নি। প্রতিটি এলাকায় প্রচুর কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানা সিটি করপোরেশন হওয়ার আগেই হয়েছে। বর্তমানে বায়ুদূষণ কমাতে আমরা অনেক প্রকল্প হাতে নিয়েছি। দীর্ঘদিনের এ সমস্যা সমাধানে একটু সময় লাগবে। বড় একটি সিটি করপোরেশনের এত বড় সমস্যা তা সহজে সমাধান সম্ভব নয়। আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করতে পারিনি। আমাদের প্রতিদিন আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। আমাদের জনবলের সংকট আছে। আছে জমির স্বল্পতা। গাজীপুর পৌরসভার ডাম্পিং বন বিভাগের জমিতে করতাম। সিটি করপোরেশনের নিজস্ব কোনো জমি নেই ডাম্পিংয়ের জন্য। ডাম্পিং স্টেশনের জন্য ইতোমধ্যে ১০০ বিঘা জমি কেনার জন্য প্রকল্প একনেকে পাস হয়েছে। অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। প্রশাসনিক কাজ শেষ হয়েছে। সব প্রক্রিয়া শেষ করে জমি পাওয়ার পরই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য নিজস্ব জমি হবে। বাসাবাড়িতে পয়ঃনিস্কাশনও সঠিকভাবে না হওয়ার কারণে বায়ুদূষণ হয়। পয়ঃনিস্কাশনের জন্য ট্রিটমেন্ট প্লান্টের জন্য আমরা কাজ করছি। প্রকল্পগুলো ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। আমাদের যতটুকু করণীয় ততটুকু করে যাচ্ছি। বায়ুদূষণ
রোধে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকসহ সব মহলকে সজাগ থাকতে হবে।

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

বায়ুদূষণ কমাতে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এখানে গবেষণারও বিষয় আছে। গাজীপুরে অনেক কারখানা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার তীর্থস্থান। আমরা অনেক গবেষণা করছি। কিন্তু দূষণ রোধে অনেক সময় এসব গবেষণাকে কাজে লাগানো হয় না। গাজীপুরের দূষণ রোধে কারখানা কর্তৃপক্ষ ও সিটি করপোরেশনকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। পরিবেশ দূষণ নিয়ে আমরা অনেক গবেষণা করছি। এ গবেষণার মাধ্যমে আমরা অনেক সফলতা অর্জন করেছি। বায়ুদূষণ রোধে নবায়নযোগ্য উৎসের ব্যবহার বাড়াতে হবে। এ টেকনোলজিগুলো সবার জানা আছে, কিন্তু যাদের এগুলো গ্রহণ করার কথা তারা সেগুলো গ্রহণ করছে না। আমাদের কাছে সিটি করপোরেশনও যায় না, জেলা প্রশাসনও যায় না। গবেষকদের কেউ মূল্যায়ন করে না। ক্ষমতার চেয়ে সৃজনশীলতাকে কম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে।

অ্যাডভোকেট আনোয়ার সাদাত

গাজীপুরকে নিয়ে আমাদের এখন নতুন করে চিন্তা করতে হচ্ছে। শিল্পকারখানাগুলো মনিটর করার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা একসময় ছিল না। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পেছনে গাজীপুরের শিল্পকারখানা ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। এখন বায়ুদূষণ নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে। আমরা মনে করি, অল্প কিছুদিনের মধ্যে গাজীপুর সিটি নতুন আঙ্গিকে সাজবে। এখন আমাদের ওয়াশিং, ডায়িং ও কেমিক্যালের জন্য একটি নির্দিষ্ট এলাকা দরকার। শিল্পকারখানা যদি বায়ুদূষণ করে তাহলে আমরা সব কারখানা ওই এলাকায় স্থানান্তর করব। বিক্ষিপ্তভাবে এখন কারখানা গড়ে ওঠায় বায়ুদূষণ বাড়ছে। শিল্পকারখানাগুলো পরিকল্পিতভাবে হওয়া দরকার। সচেতনতা বাড়াতে হবে। যার যার অবস্থান থেকে লড়তে হবে। সবাইকে এক সুরে কথা বলতে হবে। আমরা ব্যবসায়ীরা বায়ুদূষণ কমাতে সক্রিয় থাকব। কারখানার মালিক ও সিটি করপোরেশনকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। দূষণ কমাতে সবার অংশগ্রহণ প্রয়োজন। পরিবেশ দূষণ নিয়ে আমরা অনেক গবেষণা করছি। এ গবেষণার মাধ্যমে আমরা অনেক সফলতা অর্জন করেছি। গাজীপুরের দূষণ কমাতে গবেষকদেরও কাজে লাগাতে হবে।

মো. আলমগীর হোসেন

গাজীপুরে বিআরটি প্রকল্প ২০ কিলোমিটারজুড়ে দূষণ ছড়াচ্ছে। এ দূষণের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী ট্রাফিক পুলিশ। গাজীপুরকে দূষণমুক্ত রাখতে আমরা নানা উদ্যোগ নিয়েছি। এর মধ্যে কালো ধোঁয়া ছড়ানো গাড়ি ও ব্যাটারিচালিত যানবাহন নির্মূলে আমরা কাজ করছি। আমরা যানজট নিরসনে কাজ করছি। ট্রেন ব্যবস্থা উন্নত করা গেলে যানজট ও দূষণ কমবে।



ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার

শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় বায়ুদূষণের ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সূক্ষ্ণ কণার মাত্রা ২ দশমিক ৫ হলে তা ফুসফুস পর্যন্ত প্রবেশ করে আর মাত্রা ১০ হলে সেটি শ্বাসনালিতে আক্রমণ করে। বাতাসে এ সূক্ষ্ণ কণার মাত্রা বাড়ার ফলে শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থদের সর্দি, কাশি, হাঁপানি বা শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। কার্বন ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোঅক্সাইড বেড়ে যাওয়ায় ফুসফুসে ক্যান্সারও হতে পারে। কালো ধোঁয়ায় থাকা বস্তুকণা ও সালফার ডাই-অক্সাইডের প্রভাবে ব্রঙ্কাইটিস, কিডনির জটিলতা ও হৃদরোগের ঝুঁকি রয়েছে। বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে অন্তঃসত্ত্বার ওপর। দূষিত বায়ুর প্রভাবে তাঁর গর্ভে থাকা শিশুটি আক্রান্ত হয়। বাতাসে যদি মাত্রাতিরিক্ত সিসার অবস্থান থাকে, সেটা একজন অন্তঃসত্ত্বা এবং তাঁর গর্ভের সন্তানকে সারাজীবনের জন্য আক্রান্ত করে। যদি কোনো অন্তঃসত্ত্বা নারী দীর্ঘমেয়াদি বায়ুদূষণের শিকার হন, তাহলে তিনি সবসময় অক্সিজেনের ঘাটতিতে থাকবেন; সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ)-তে আক্রান্ত হবেন। এর ফলে তাঁর গর্ভে থাকা সন্তানটি অপরিণত হিসেবে জন্ম নেবে।

এসব অপরিণত নবজাতকের জন্মগতভাবেই হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে। এসব শিশু হার্টে ছিদ্র বা বাড়তি রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করবে। এভাবেই তারা হৃদরোগী হয়ে যাবে একসময়। এই বায়ুদূষণ আমাদের জীবনে এমন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে যে খুব দ্রুত যদি সঠিকভাবে পরিকল্পনা না করা যায়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি অসুস্থ প্রজন্ম হিসেবে বেড়ে উঠবে।

মাওলানা রুহুল আমিন

পরিকল্পিত নগরায়ণ করতে হবে, আবার উন্নয়নও করতে হবে। বায়ুদূষণ হতে দেওয়া যাবে না। দূষণ বাড়ার কারণে আমরা ফাঁদে পড়ে যাচ্ছি। আমরা ঝুঁকির মুখে আছি। আমাদের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আমাদের ফুসফুস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। টঙ্গী থেকে গাজীপুরের শেষ পর্যন্ত শুধুই ধুলাবালি। জীবন এখানে স্থবির হয়ে গেছে। আমরা শুধু উন্নয়ন দেখি, কিন্তু ক্ষতিটা দেখি না। আল্লাহর নেয়ামতগুলোও আমরা নষ্ট করে দিচ্ছি। খোঁড়াখুঁড়ির কারণে বায়ুদূষণ বেশি হচ্ছে। গাজীপুরে আমরা দূষণমুক্ত পরিবেশ চাই। আমাদের আগামী প্রজন্ম যেন সুস্থ থাকতে পারে- এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে।

জোয়ানা ডি রোজারিও

বায়ুদূষণ নিয়ে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ আরবান কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রচারণাসহ বেশ কিছু কাজ করছে। আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, উন্নয়ন পরিকল্পনা, প্রচারণার মাধ্যমে দেশের শিশু ও বৃদ্ধদের জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশগত বিষয়ে কাজ করি। বায়ুদূষণ রোধে যুবাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতেও গুরুত্ব দিচ্ছি।



শরিফুল ইসলাম

গাজীপুরে প্রতিদিন চার থেকে সাড়ে চার হাজার টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। এত বর্জ্য ফেলার স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নেই, যার কারণে এখন ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কড্ডা, ঢাকা-বাইপাস সড়কের মোগরখাল, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের কুনিয়া বড়বাড়ি এলাকায় ফেলা হচ্ছে। বাসাবাড়ির পাশাপাশি কলকারখানার বর্জ্যও বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টঙ্গী ও কোনাবাড়ি এলাকায় দুটি বিসিক শিল্পনগরী রয়েছে। বিসিকসহ গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় দুই হাজার শিল্পকারখানা আছে। এসব শিল্পকারখানা থেকে প্রতিদিন তরল বর্জ্য ও ময়লা আবর্জনা উৎপন্ন হচ্ছে। তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে তুরাগ নদ ও আশপাশের খালবিলে, আর কঠিন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে কারখানার আশপাশে বিভিন্ন স্থানে। সেখান থেকে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা বর্জ্য নিয়ে ফেলছেন রাস্তার পাশে খোলা স্থানে। সেখান থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে নষ্ট হচ্ছে আশপাশের পরিবেশ। বাড়ছে বায়ুদূষণ।

সুমনা শারমিন

রাজধানীর কাছের শহর গাজীপুর সুন্দর হবে- এটা আমাদের প্রত্যাশা ছিল। আমাদের সেই আশা পূরণ হয়নি। বায়ুদূষণ সহ্যের বাইরে চলে গেছে। নগরের প্রধান সমস্যা অপরিকল্পিত শিল্পায়ন। মানুষ একটি দূষণের কুণ্ডলীর মধ্যে বসবাস করছে। যেহেতু গাজীপুরকে সিটি করপোরেশন করা হয়েছে, সেহেতু নগরের সেবা, সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।


মঞ্জু মারিয়া পালমা

আমরা সবাই বিশুদ্ধ পানিকে জীবনের সঙ্গে তুলনা করি। তবে আমি মনে করি, বিশুদ্ধ বায়ু আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। বিশুদ্ধ পানি না পাওয়ার কারণে যেমন প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে, তেমনি বিশুদ্ধ বায়ুর অভাবেও প্রতি বছর অসংখ্য শিশুসহ বয়স্ক ব্যক্তি বিভিন্ন অসুখে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর বায়ুদূষণজনিত অসুখের কারণে ৮২ হাজারের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে, যার মধ্যে বেশির ভাগই শিশু আর বৃদ্ধ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বায়ুদূষণজনিত কারণে উদ্বেগজনকভাবে মানুষের মৃত্যুর হার বাড়ছে। বায়ুদূষণবিষয়ক গ্লোবাল প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সালে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, যা ২০১৭ সালের তুলনায় ৫০ হাজার বেশি।

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক নয়া দিগন্ত (৩ ডিসেম্বর ২০২১) ও প্রথম আলোয় (২১ জানুয়ারি, ২০২২) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (অছও) ২০২২ অনুযায়ী ঢাকা বিশ্বের মধ্যে বায়ুদূষণে চতুর্থ স্থান দখল করেছে। অথচ ২০১৭ সালে বিশ্বে ১৭তম স্থান অর্জন করেছিল। গত ৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালে গাজীপুর বায়ুদূষণের দিক থেকে ৬৪ জেলার মধ্যে সবার ওপরে। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত গবেষক দল গাজীপুরের বায়ুতে প্রতি ঘনমিটারে ২৬৩ দশমিক ৫১ মাইক্রোগ্রাম অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা খুঁজে পায়; যেখানে পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে, বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বায়ুকণার আদর্শ মান ৬৫ মাইক্রোগ্রাম। অর্থাৎ নিরাপদে বেঁচে থাকার জন্য বায়ুতে প্রতি ঘনমিটারে সর্বোচ্চ ৬৫ মাইক্রোগ্রাম অতিক্ষুদ্র কণা গ্রহণযোগ্য।

২০১৫ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় বায়ুদূষণজনিত মৃত্যুঝুঁকি (%) : বাংলাদেশ ২৭ দশমিক ৭, ভারত ২৬ দশমিক ৫, নেপাল ২৫ দশমিক ৮, পাকিস্তান ২২ দশমিক ২, আফগানিস্তান ২০ দশমিক ৬, ভুটান ১৭ দশমিক ৭ এবং শ্রীলঙ্কা ১৩ দশমিক ৭।

৩১ জানুয়ারি ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত একিউআই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওইদিন সকাল ৯টায় বিশ্বের সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের বায়ুতে দূষিত কণার পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ প্রতি ঘনমিটারে ২৮৮ মাইক্রোগ্রাম; যা একই সময়ে পাকিস্তানের লাহোরে ছিল ২৫৫ মাইক্রোগ্রাম এবং আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে ছিল ২১১ মাইক্রোগ্রাম। প্রতি ঘনমিটারে ২০১ থেকে ৩০০ মাইক্রোগ্রামের মধ্যে থাকলে তাকে বলা হয় খুব খারাপ পরিস্থিতি। ৩০১ থেকে ৪০০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত থাকলে সেটাকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বা ভয়ানক বলা হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিকর।

ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের তথ্যে উঠে এসেছে, গত জুনে গাজীপুরের টঙ্গী এলাকার স্টেশন রোড, কলেজ গেট, মেইল গেট, টঙ্গী বাজারসহ বেশ কিছু এলাকায় ৯ দিনে বায়ুতে প্রতি ঘনমিটারে গড় ধূলিকণা ও দূষিত পদার্থের পরিমাণ ছিল ১৯২ মাইক্রোগ্রাম। আগস্টে মোট আট দিনে ওই একই স্থানে গড়ে এটি ছিল প্রতি ঘনমিটারে ২৭০ দশমিক ৮৭ মাইক্রোগ্রাম এবং সেপ্টেম্বর মাসে সাত দিনের গড় ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৩৭৫ মাইক্রোগ্রাম। এতে সহজেই অনুমেয় গাজীপুর তথা টঙ্গীর বায়ুতে কী পরিমাণ বিষাক্ত ধূলিকণা ও ক্ষতিকর পদার্থ বিরাজমান; যা মানবজীবন, প্রাণিকুল ও পরিবেশ বা জলবায়ুর ক্ষতি করে যাচ্ছে।

বায়ুদূষণ মানুষের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কিছু স্বাস্থ্যগত সমস্যার সৃষ্টি করে। বায়ুদূষণের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। এর ফলে যেসব স্বাস্থ্যগত ক্ষতি হচ্ছে তা হলো- ফুসফুসের ক্যান্সার, ব্রেইন, লিভার ও কিডনি ড্যামেজ, হার্টের সমস্যা এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা। এ ছাড়া বায়ুদূষণের ফলে ফসল, বন ও প্রাণিসম্পদেরও ক্ষতি হয়। এটি ওজোন স্তরের ক্ষতি করে (যা সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিকে বাধা দিয়ে বিশ্বকে রক্ষা করে)। বায়ুদূষণের ফলে এসিড বৃষ্টিও হয়; যা গাছ, মাটি, নদী ও বন্যপ্রাণীর জীবন ক্ষতিগ্রস্ত করে। সর্বোপরি এটি জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব ফেলে। বায়ুদূষণের প্রভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শহর বা নগর।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০২১ সালের ১৮ মার্চ বায়ুদূষণ প্রতিরোধ নীতিমালা ২০২১ অনুমোদন করেছে, যা ১৯৯৫ সালের বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট কনজারভেশন অ্যাক্টের সঙ্গে যুক্ত। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর বায়ুদূষণ প্রতিরোধ করতে এবং এর মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নীতিমালা বা পলিসি, আইন, গাইডলাইন, সরকারি পরিপত্র ইত্যাদি।

উল্লিখিত ইস্যুগুলোয় ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ আরবান প্রোগ্রাম উল্লেখযোগ্য যেসব কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে-

- পলিসি মেকার, নীতিনির্ধারক, সেবা প্রদানকারী ও দায়িত্ববাহকদের উদ্বুদ্ধকরণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ সভা, সমাবেশ ও প্রচার অভিযান।

- প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানার মালিক ও অভিভাবকদের সঙ্গে সচেতনতামূলক সভা ও কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে।

- সচেতনতামূলক পোস্টার, লিফলেট, স্টিকার, ব্যানার, প্রমোশনাল উপকরণ তৈরি ও বিতরণ করা হয়েছে।

- বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা সমস্যা সমাধানে নতুন নতুন ধারণা গ্রহণ এবং সবচেয়ে ভালো প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুযায়ী দলগুলোর সঙ্গে বায়ুদূষণ হ্রাস নিশ্চিতকরণে যৌথ কর্মসূচি শুরু।

- কর্ম এলাকার একটি ওয়ার্ড ও চারটি রোড আবর্জনামুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে এবং চারটি বিদ্যালয়ে গ্রিন স্কুল মুভমেন্টের আওতায় আনা হয়েছে।

- বায়ুদূষণ সম্পর্কে গবেষণা ও পলিসি সহায়তা প্রদান।

আলোচক
আসাদুর রহমান কিরন
প্যানেল মেয়র
গাজীপুর সিটি করপোরেশন

আনিসুর রহমান
জেলা প্রশাসক, গাজীপুর

মো. আলমগীর হোসেন
ডিসি, ট্রাফিক পুলিশ, গাজীপুর

অ্যাডভোকেট আনোয়ার সাদাত
সভাপতি
গাজীপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ

ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার
অধ্যাপক, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
পরিচালক (গবেষণা ও সম্প্রসারণ)
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট)

জোয়ানা ডি রোজারিও
টেকনিক্যাল ম্যানেজার, আরবান প্রোগ্রাম
ওয়ার্ল্ড ভিশন

মো. আকবর হোসেন
অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী
গাজীপুর সিটি করপোরেশন

শরিফুল ইসলাম
প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা
গাজীপুর সিটি করপোরেশন

সুমনা শারমিন
নগর পরিকল্পনাবিদ
গাজীপুর সিটি করপোরেশন

মাওলানা নূরুল আমীন
খতিব
গাজীপুরের হায়দারাবাদ জামে মসজিদ

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন
মঞ্জু মারিয়া পালমা
ডেপুটি ডিরেক্টর, ওয়ার্ল্ড ভিশন

সভাপতি ও মডারেটর
আবু সাঈদ খান
উপদেষ্টা সম্পাদক
সমকাল

সার্বিক তত্ত্বাবধানে
মীর রেজাউল করিম
অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড ক্যাম্পেইন
কো-অর্ডিনেটর, আরবান প্রোগ্রাম
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ

জনি রোজারিও
টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর
আরবান প্রোগ্রাম, টঙ্গী এপি
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ

অনুলিখন
জাহিদুর রহমান
স্টাফ রিপোর্টার, সমকাল

ফটো
মামুনুর রহমান রশিদ
, সমকাল

সহযোগিতায়
ইজাজ আহমেদ মিলন

গাজীপুর প্রতিনিধি, সমকাল

ইভেন্ট সমন্বয়
হাসান জাকির
, সমকাল

সুপারিশ

বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষায় বায়ুদূষণমুক্ত পরিবেশ তৈরিতে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি সকল পর্যায়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

সরকারি, বেসরকারি ও প্রাইভেট সেক্টর দ্বারা ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ।

সংশ্নিষ্ট ও বিদ্যমান পলিসি, আইন, গাইড লাইন ও সরকারি পরিপত্রগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ।

সব পর্যায়ের মনিটরিং কমিটির কার্যক্রম জোরদারকরণ এবং আইন, পলিসি বা অন্য কোনো সরকারি নির্দেশনা অমান্যকারীদের উপযুক্ত শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com