
শ্রদ্ধাঞ্জলি
লাবণ্যময়ী, মমতাময়ী, চৌকস নাহার আপা
প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২২ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
কাজী সুফিয়া আখ্তার

গত ৮ অক্টোবর অনন্তলোকে চলে গেলেন নারী নেত্রী, আলোকচিত্রী নূরুন নাহার আহমেদ। নাহার আহমেদ নামে পরিচিত জীবনবাদী এই মানুষটির নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন বিয়ে হয়। দুই ছেলে, এক মেয়ের মা। ঘর-সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক সময় দিতেন।
স্বামী ময়েজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন বিটিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক। শখ ছিল ফুলের বাগান করা। সবসময় হাসিখুশি, টিপটপ থাকতে পছন্দ করতেন। নিয়মিত ধর্মকর্ম করতেন; কিন্তু ধর্মীয় গোঁড়ামি বা সংকীর্ণতা ছিল না। মানবাধিকারে বিশ্বাসী, খোলামন আর মিষ্টি ব্যক্তিত্ব ছিল প্রিয় নাহার আপার।
মূলত স্বামীর মৃত্যুর পর বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে যুক্ত হয়ে কর্মস্পৃহা, কর্মগুণে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, নারী অধিকার রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। মোহাম্মদপুর শাখা কমিটির সহসভানেত্রী হিসেবে বস্তির নারীদের নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। তারপর ঢাকা মহানগর কমিটির সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পর্যায়ক্রমে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, সম্পাদকমণ্ডলীতে দায়িত্ব পালন করেছেন।
একবার ঘূর্ণিঝড়ের পর ত্রাণসামগ্রী নিয়ে আয়শা আপা, রাখী দি, রোজী আপা, নাহার আপা, দিলু আপাসহ আমরা বেশ কয়েকজন ময়মনসিংহে গিয়েছিলাম। গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে কীভাবে যেন নাহার আপা গোড়ালিতে ব্যথা পেলেন। ত্রাণ বিতরণ করে যখন গভীর রাতে রাজধানীতে ফিরলাম, তখন অধিকাংশ ফার্মেসি বন্ধ হয়ে গেছে। পরদিন সকাল ৯টায় গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। আমরা চিন্তা করছিলাম, নাহার আপা আসতে পারবেন কিনা! তিনি যথারীতি খেলোয়াড়দের মতো অ্যাঙ্কলেট লাগিয়ে মিটিংয়ে উপস্থিত হলেন। মিটিং শেষ হলে ডাক্তার দেখাতে যাবেন।
১৯৮৮ সালের বন্যার সময় সংগঠনের হয়ে সবার সঙ্গে অনেক কাজ করেছেন নাহার আপা। এসব কাজে ভীষণ উৎসাহী ছিলেন। অর্থ সংগ্রহসহ অক্লান্ত পরিশ্রম করতে পারতেন তিনি। তবে লিগ্যাল এইড উপপরিষদের কাজে তিনি বেশি সন্তুষ্টি লাভ করতেন। আপস-মীমাংসার মামলায় ধৈর্য ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাদী-বিবাদীর কথা শান্ত, নির্মোহভাবে শুনতে সক্ষম ছিলেন।
একবার শ্রীপুরে, রেলস্টেশনের বাইরে মরা একটি খালের ওপারে ঋষিপাড়ায় নারী নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে নাহার আপা ও আমি গিয়েছিলাম। সকালের ট্রেনে গেছি। তদন্তের কাজ ১টার মধ্যে শেষ; কিন্তু বিকেল ৪টার আগে ঢাকা ফেরার ট্রেন নেই। তিন দশক আগে শ্রীপুরে ভালো খাবারের দোকানও ছিল না। আপার উৎসাহে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে রেললাইনের পাশে একটা চা ও খাবারের দোকানের সামনে কাঠের বেঞ্চে বসে রইলাম। ভেতরে মানুষ দুপুরের খাওয়াদাওয়া সারছে। আমাদেরও ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। খাব না-খাব করে বেলা ৩টার দিকে ভেতরে গিয়ে টেবিলে বসলাম। তরকারি দিয়ে ভাত মেখে মুখে দিতেই ঝালের চোটে দু'জনেরই নাকমুখ দিয়ে জল বেরিয়ে এলো। ভাতে জল ঢেলে পাশের দোকান থেকে মিষ্টি খেয়ে ঝাল নিবারণ করা হলো। সারাদিন বলতে গেলে অভুক্ত থেকেই আমরা বিলম্বিত ট্রেনে ঢাকা ফিরলাম। লাবণ্যময়ী, মমতাময়ী, চৌকস নাহার আপাকে দেখে মনে হতো না, তিনি এত কষ্টসহিষুষ্ণ হতে পারেন!
নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতায় একের পর এক সাংগঠনিক ধাপ পেরিয়ে তিনি দীর্ঘ বছর কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভানেত্রীর দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠা, সততা, দৃঢ়তা ও আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করেছেন।
কিশোরীর মতো উৎসাহ নিয়ে তিনি ক্যামেরার কারুকাজ শিখেছেন পুত্রসম জামাতা, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শহীদুল আলমের কাছে। তারপরের ঘটনা তো ইতিহাস। ক্যামেরা কাঁধে আমাদের প্রিয় নাহার আপা কখনও মহিলা পরিষদের কর্মসূচির ছবি তুলছেন; কখনও নারীপক্ষের কর্মসূচির; কখনও নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা বা অন্য কোনো সংগঠনের। তাঁর কর্মব্যস্ত দিন; কর্মব্যস্ত রাত। আন্তর্জাতিক নারীবর্ষের ২৫ বছর পূর্তিতে মধ্যরাতে পোস্টারের ছবি তোলা হলো। নাহার আহমেদ, খুরশীদা আপা, শারমিন, শিখা, আমিসহ অনেকে আছেন সেই ছবিতে। ফটোগ্রাফিতে ছিলেন শহীদুল আলম।
একবার লন্ডনে ছোট ছেলে সাইফুল ও পুত্রবধূ রিনি রেজার বাসায় বেশ কয়েক মাস ছিলেন। নাতি-নাতনি দু'জনই ছিল তাঁর প্রাণের চেয়ে প্রিয়। ওখানে সবাই ব্যস্ত। নাহার আপা কী করেন? তিনি ছবি আঁকা শুরু করলেন রিনির উৎসাহে। বাংলাদেশে যখন ফিরে এলেন তখন তিনি একজন শৌখিন চিত্রশিল্পী। আমাকে আর রেখা সাহাকে একদিন ছবিগুলো দেখাতে নিয়ে গেলেন তাঁর বাসায়। আমরা দু'জনই মুগ্ধ! তাঁর অধ্যবসায় দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।
অত্যন্ত বন্ধুবৎসল, পরোপকারী ছিলেন নাহার আপা। প্রায় সময়ই বাসায় যেতে বলতেন। আমার ক্যান্সার হওয়ার পর তিন বছর তাঁর বাসায় যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তাঁকে কেউ আমার অসুখের খবর জানায়নি। কারণ তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সুস্থ হয়ে আমি যখন একদিন তাঁকে দেখতে গেলাম, ওমা কী অভিমান তাঁর! পরে সব শুনে আমাকে কী খাওয়াবেন, তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।
১০ বছর প্রচার ও প্রকাশনা উপপরিষদে নাহার আপার সঙ্গে কাজ করেছি। ভালোবাসার সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের চেয়েও গাঢ় হয়ে গিয়েছিল। ৯ অক্টোবর সবাই মিলে আপাকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে কত শত স্মৃতি যে মনে পড়ছিল! তিনি সতত আমাদের হৃদয়ে থাকবেন প্রেরণার আলো ছড়িয়ে।
কাজী সুফিয়া আখ্তার: নারী অধিকার নেত্রী
স্বামী ময়েজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন বিটিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক। শখ ছিল ফুলের বাগান করা। সবসময় হাসিখুশি, টিপটপ থাকতে পছন্দ করতেন। নিয়মিত ধর্মকর্ম করতেন; কিন্তু ধর্মীয় গোঁড়ামি বা সংকীর্ণতা ছিল না। মানবাধিকারে বিশ্বাসী, খোলামন আর মিষ্টি ব্যক্তিত্ব ছিল প্রিয় নাহার আপার।
মূলত স্বামীর মৃত্যুর পর বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে যুক্ত হয়ে কর্মস্পৃহা, কর্মগুণে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, নারী অধিকার রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। মোহাম্মদপুর শাখা কমিটির সহসভানেত্রী হিসেবে বস্তির নারীদের নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। তারপর ঢাকা মহানগর কমিটির সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পর্যায়ক্রমে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, সম্পাদকমণ্ডলীতে দায়িত্ব পালন করেছেন।
একবার ঘূর্ণিঝড়ের পর ত্রাণসামগ্রী নিয়ে আয়শা আপা, রাখী দি, রোজী আপা, নাহার আপা, দিলু আপাসহ আমরা বেশ কয়েকজন ময়মনসিংহে গিয়েছিলাম। গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে কীভাবে যেন নাহার আপা গোড়ালিতে ব্যথা পেলেন। ত্রাণ বিতরণ করে যখন গভীর রাতে রাজধানীতে ফিরলাম, তখন অধিকাংশ ফার্মেসি বন্ধ হয়ে গেছে। পরদিন সকাল ৯টায় গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। আমরা চিন্তা করছিলাম, নাহার আপা আসতে পারবেন কিনা! তিনি যথারীতি খেলোয়াড়দের মতো অ্যাঙ্কলেট লাগিয়ে মিটিংয়ে উপস্থিত হলেন। মিটিং শেষ হলে ডাক্তার দেখাতে যাবেন।
১৯৮৮ সালের বন্যার সময় সংগঠনের হয়ে সবার সঙ্গে অনেক কাজ করেছেন নাহার আপা। এসব কাজে ভীষণ উৎসাহী ছিলেন। অর্থ সংগ্রহসহ অক্লান্ত পরিশ্রম করতে পারতেন তিনি। তবে লিগ্যাল এইড উপপরিষদের কাজে তিনি বেশি সন্তুষ্টি লাভ করতেন। আপস-মীমাংসার মামলায় ধৈর্য ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাদী-বিবাদীর কথা শান্ত, নির্মোহভাবে শুনতে সক্ষম ছিলেন।
একবার শ্রীপুরে, রেলস্টেশনের বাইরে মরা একটি খালের ওপারে ঋষিপাড়ায় নারী নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে নাহার আপা ও আমি গিয়েছিলাম। সকালের ট্রেনে গেছি। তদন্তের কাজ ১টার মধ্যে শেষ; কিন্তু বিকেল ৪টার আগে ঢাকা ফেরার ট্রেন নেই। তিন দশক আগে শ্রীপুরে ভালো খাবারের দোকানও ছিল না। আপার উৎসাহে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে রেললাইনের পাশে একটা চা ও খাবারের দোকানের সামনে কাঠের বেঞ্চে বসে রইলাম। ভেতরে মানুষ দুপুরের খাওয়াদাওয়া সারছে। আমাদেরও ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। খাব না-খাব করে বেলা ৩টার দিকে ভেতরে গিয়ে টেবিলে বসলাম। তরকারি দিয়ে ভাত মেখে মুখে দিতেই ঝালের চোটে দু'জনেরই নাকমুখ দিয়ে জল বেরিয়ে এলো। ভাতে জল ঢেলে পাশের দোকান থেকে মিষ্টি খেয়ে ঝাল নিবারণ করা হলো। সারাদিন বলতে গেলে অভুক্ত থেকেই আমরা বিলম্বিত ট্রেনে ঢাকা ফিরলাম। লাবণ্যময়ী, মমতাময়ী, চৌকস নাহার আপাকে দেখে মনে হতো না, তিনি এত কষ্টসহিষুষ্ণ হতে পারেন!
নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতায় একের পর এক সাংগঠনিক ধাপ পেরিয়ে তিনি দীর্ঘ বছর কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভানেত্রীর দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠা, সততা, দৃঢ়তা ও আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করেছেন।
কিশোরীর মতো উৎসাহ নিয়ে তিনি ক্যামেরার কারুকাজ শিখেছেন পুত্রসম জামাতা, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শহীদুল আলমের কাছে। তারপরের ঘটনা তো ইতিহাস। ক্যামেরা কাঁধে আমাদের প্রিয় নাহার আপা কখনও মহিলা পরিষদের কর্মসূচির ছবি তুলছেন; কখনও নারীপক্ষের কর্মসূচির; কখনও নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা বা অন্য কোনো সংগঠনের। তাঁর কর্মব্যস্ত দিন; কর্মব্যস্ত রাত। আন্তর্জাতিক নারীবর্ষের ২৫ বছর পূর্তিতে মধ্যরাতে পোস্টারের ছবি তোলা হলো। নাহার আহমেদ, খুরশীদা আপা, শারমিন, শিখা, আমিসহ অনেকে আছেন সেই ছবিতে। ফটোগ্রাফিতে ছিলেন শহীদুল আলম।
একবার লন্ডনে ছোট ছেলে সাইফুল ও পুত্রবধূ রিনি রেজার বাসায় বেশ কয়েক মাস ছিলেন। নাতি-নাতনি দু'জনই ছিল তাঁর প্রাণের চেয়ে প্রিয়। ওখানে সবাই ব্যস্ত। নাহার আপা কী করেন? তিনি ছবি আঁকা শুরু করলেন রিনির উৎসাহে। বাংলাদেশে যখন ফিরে এলেন তখন তিনি একজন শৌখিন চিত্রশিল্পী। আমাকে আর রেখা সাহাকে একদিন ছবিগুলো দেখাতে নিয়ে গেলেন তাঁর বাসায়। আমরা দু'জনই মুগ্ধ! তাঁর অধ্যবসায় দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।
অত্যন্ত বন্ধুবৎসল, পরোপকারী ছিলেন নাহার আপা। প্রায় সময়ই বাসায় যেতে বলতেন। আমার ক্যান্সার হওয়ার পর তিন বছর তাঁর বাসায় যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তাঁকে কেউ আমার অসুখের খবর জানায়নি। কারণ তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সুস্থ হয়ে আমি যখন একদিন তাঁকে দেখতে গেলাম, ওমা কী অভিমান তাঁর! পরে সব শুনে আমাকে কী খাওয়াবেন, তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।
১০ বছর প্রচার ও প্রকাশনা উপপরিষদে নাহার আপার সঙ্গে কাজ করেছি। ভালোবাসার সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের চেয়েও গাঢ় হয়ে গিয়েছিল। ৯ অক্টোবর সবাই মিলে আপাকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে কত শত স্মৃতি যে মনে পড়ছিল! তিনি সতত আমাদের হৃদয়ে থাকবেন প্রেরণার আলো ছড়িয়ে।
কাজী সুফিয়া আখ্তার: নারী অধিকার নেত্রী
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com