ইসলাম ও সমাজ

দুর্যোগে বিপদগ্রস্তের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২২ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মো. শাহজাহান কবীর

প্রকৃতি মহান আল্লাহর দান। প্রাণিকুলের বসবাসের উপযোগী করেই প্রকৃতিকে সাজানো হয়েছে। প্রকৃতি মহান আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। মাঝেমধ্যে প্রকৃতি বিরূপ রূপ ধারণ করে। রূঢ় ও রুষ্ট হয়, যাকে আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে থাকি। যেমন ঘূর্ণিঝড়, শিলাবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস, ভারি বর্ষণ, বন্যা, খরা, দাবানল, শৈত্যপ্রবাহ, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, ভূমিকম্প, সুনামি প্রভৃতি। সাম্প্রতিক সময়ে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। গত মাসেই আমরা ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাব দেখেছি। এসব দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ার কারণ জলবায়ু পরিবর্তন নিঃসন্দেহে। যে কারণে আমরা দেখেছি, শীত কিংবা গ্রীষ্ফ্মকালের সময় বদল হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে কোনো সময় যে কোনো দেশে বা যে কোনো এলাকায় হতে পারে। এ জন্য সবসময় মানসিক এবং অন্যান্য প্রস্তুতি থাকা দরকার, যাতে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়।

তবে দুর্যোগ মানুষের জন্য পরীক্ষাও। আল্লাহতায়ালা বিভিন্ন সময় দুর্যোগ দিয়ে মানুষকে হেদায়েতের পথে আসার আহ্বান জানান, মানুষকে সতর্ক করেন, মানুষ যেন মহান আল্লাহকে ভুলে না যায়। মহান আল্লাহ সুরা আল-বাকারায় এরশাদ করেন, 'আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা এবং জান, মাল ও ফলফলাদির ক্ষতির মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। যারা নিজেদের বিপদ-মুসিবতের সময় বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা আল্লাহরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী; তাদের ওপরেই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও রহমত এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত।'

পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই দুর্যোগ এসেছে বিভিন্ন রূপে। রাসুলে পাক (সা.)-এর সময়েও নানা দুর্যোগ দেখা দিয়েছিল। এসব দুর্যোগে রাসুলে পাক (সা.) নিজে সতর্ক থেকেছেন ও উম্মতকে সতর্ক করেছেন। যেমন তিনি সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের সময় আহার গ্রহণ করতেন না। এ সময় তিনি সিজদায় নত হয়ে আল্লাহতায়ালার কাছে দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ চাইতেন।

অনেক ক্ষেত্রে দুর্যোগ আসে মানুষের কর্মফলের কারণে। পবিত্র কোরআনের সুরা আর-রুমের ৪১ আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, 'মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সাগরে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে; ফলে তিনি তাদের কোনো কোনো কাজের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।' অর্থাৎ স্থলে, জলে তথা সারাবিশ্বে মানুষের নাফরমানির বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। বিপর্যয় অনেক রকমের হতে পারে। যেমন- দুর্ভিক্ষ, মহামারি, অগ্নিকাণ্ড, পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার ঘটনাবলি, সবকিছু থেকে বরকত উঠে যাওয়া, উপকারী বস্তুর উপকার কম হওয়া এবং ক্ষতি বেশি হয়ে যাওয়া ইত্যাদি আপদ-বিপদ।

পৃথিবীর মহাদুর্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে ঝড়, অতিবৃষ্টি ও ভূমিধস। মানুষের নাফরমানি ও কুফরির কারণে কখনও কখনও মহান আল্লাহ তাদের এসব দুর্যোগ দিয়ে সতর্ক করেন। পবিত্র কোরআনের সুরা বনি ইসরাইলের ৬৭-৬৯ আয়াতে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন- 'আর যখন তোমাদের সাগরে বিপদ স্পর্শ করে, তখন তিনি ছাড়া যাদের তোমরা ডাকো, তারা তোমাদের মন থেকে হারিয়ে যায়; অতঃপর তিনি যখন তোমাদের রক্ষা করে স্থলে আনেন, তখন তোমরা বিমুখ হয়ে যাও। আর মানুষ তো খুবই অকৃতজ্ঞ।'

বজ্রপাত আল্লাহতায়ালার শক্তির নিদর্শনগুলোর একটি, যা তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাদের সাবধান করার জন্য রেখেছেন। তিনি চাইলেই যে কাউকে এর মাধ্যমে যে কোনো সময় শাস্তি দিতে পারেন; যা আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের সুরা রা'দ-এর ১৩ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেন, 'বজ্র তাঁরই তাসবিহ ও হামদ জ্ঞাপন করে এবং তাঁর ভয়ে ফেরেশতারাও তাসবিহরত। তিনিই গর্জমান বিজলি পাঠান, তারপর যার ওপর ইচ্ছা একে বিপদরূপে পতিত করেন। আর তাদের অর্থাৎ কাফিরদের অবস্থা এই যে তারা আল্লাহ সম্পর্কেই তর্কবিতর্ক করছে, অথচ তাঁর শক্তি অতি প্রচণ্ড।'

মানুষের পাপকর্মই বজ্রপাতের মূল কারণ। খোদাদ্রোহ, জেনা, ব্যভিচার, পরকীয়া, অন্যায়-অত্যাচার দুনিয়ায় যত বাড়বে, ততই বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ বাড়বে। মহান আল্লাহতায়ালা সুরা আনআমের ৬৫ আয়াতে এরশাদ করেন, 'বলে দাও, আল্লাহ তোমাদের ওপর থেকে অথবা তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম। তাফসিরবিদদের মতে, এর ব্যাখ্যা হলো ভূমিকম্প।'

অনাবৃষ্টি ও খরার মূল কারণও আল্লাহর নাফরমানি। আল্লাহর নাফরমানির কারণে কখনও কখনও অনাবৃষ্টি দেখা দেয়। মানুষ যখন তার নাফরমানি থেকে ফিরে আসবে, মহান আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দিয়ে দুর্যোগ থেকে নিস্তার দেবেন। হাদিসে বর্ণিত রাসুলে পাক (সা.) এরশাদ করেন, তোমাদের প্রবল পরাক্রমশালী প্রভু বলেছেন, যদি আমার বান্দারা আমার বিধান মেনে চলত, তবে আমি তাদের রাতের বেলায় বৃষ্টি দিতাম, সকালবেলায় সূর্য দিতাম এবং কখনও তাদের বজ্রপাতের আওয়াজ শোনাতাম না। (মুসনাদে আহমদ)। আমাদের দায়িত্ব হবে সব ধরনের দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে মহান আল্লাহর কাছে বেশি বেশি তওবা করা; তার পথে ফিরে আসা।

একই সঙ্গে এটাও বলা দরকার, আমাদের মধ্যে যখন কেউ দুর্যোগে পতিত হয়, তার পাশে দাঁড়ানোও ইসলামের শিক্ষা। বন্যার্ত কিংবা শীতার্তদের পাশে দাঁড়ানোও তার বাইরে নয়। এমনকি সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে উপকূলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া ইমানের তাগিদ।

ড. মো. শাহজাহান কবীর: চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com