
রাজনীতি
সিদ্ধান্ত জাতীয় পার্টিকেই নিতে দিন
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২২ । ০২:৩০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মহিউদ্দিন খান মোহন

গত কিছুদিন ধরে জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব চলছে। এর শুরু রওশন এরশাদের একটি চিঠিতে। গত ৩১ আগস্ট রওশন চিঠি দিয়ে নিজেকে জাতীয় পার্টির সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক ঘোষণা করে দলের কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করেন ২৬ নভেম্বর। এতে দলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং দলের পক্ষ থেকে ওই চিঠি প্রত্যাহারের জন্য রওশনকে আলটিমেটাম দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি তা আমলে না নেওয়ায় জাপার পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠকে রওশনকে অব্যাহতি দিয়ে জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত করে পরদিনই চিঠি দিয়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে তা অবহিত করা হয়। কিন্তু দুই মাস পার হলেও স্পিকার কোনো সিদ্ধান্ত না দেওয়ায় গত ৩০ অক্টোবর জাতীয় পার্টি মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ কয়েকজন এমপি স্পিকারের সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন।
এ বিষয়ে গত ১ নভেম্বর সমকালে প্রকাশিত 'জাপায় সরকারের মধ্যস্থতা' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী জাপা নেতাদের এই আভাস দিয়েছেন, সরকার বিরোধীদলীয় নেতার পদে পরিবর্তন চায় না। তখন জাতীয় পার্টি তাৎক্ষণিক ঘোষণা দেয়, জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতার স্বীকৃতি না দিলে তারা সংসদে যাবে না। জাপা সংসদীয় দলের এ সিদ্ধান্তের আধা ঘণ্টার মধ্যে রওশন এরশাদ তাঁর আহূত কাউন্সিল অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা দেন। সমকালের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রওশনের ঘনিষ্ঠ এক জাপা নেতা জানিয়েছেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনায় কাউন্সিল স্থগিত করা হয়েছে। রওশন আহূত কাউন্সিল অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা আসার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জি এম কাদের গ্রুপও তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে সংসদে ফেরার ঘোষণা দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে কথা বলেই জি এম কাদের সংসদ বর্জনের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। যদিও জাতীয় পার্টি গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা ঘোষণা করা হবে- স্পিকারের এমন আশ্বাসের ভিত্তিতেই দলটি সংসদে ফিরেছে। তবে স্পিকারের অফিস এর সত্যতা স্বীকার করেনি। তারা জানিয়েছে, 'বিষয়টি সংসদ অধিবেশনে ঘেষণা করা হবে' বলে স্পিকার তাঁদের জানিয়েছেন।
অন্যদিকে জাতীয় পার্টির এক সময়ের মহাসচিব ও সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা আম ও ছালা দুটোই হারিয়েছেন। গত ১৪ সেপ্টেম্বর দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ সব পদ-পদবি থেকে রাঙ্গাকে অব্যাহতি দেন জি এম কাদের। এর পর ১৭ সেপ্টেম্বর দলটির উপদেষ্টা জিয়াউল হক মৃধাকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরই মধ্যে রাঙ্গাকে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ পদ থেকে সরানোর জন্য স্পিকারের কাছে আবেদন করে জাপা সংসদীয় দল। রাঙ্গা জাতীয় পার্টিতে সাম্প্রতিককালে রওশন-ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। রাঙ্গার এই অব্যাহতি রওশনের শক্তি অনেকটা কমিয়ে দেয়। দলের মধ্যে অবস্থান সংহত করার জন্য যে ধরনের নেতা দরকার, তা রওশনের হাতে নেই। তা ছাড়া ব্যাংককের হাসপাতালে শুয়ে নেতাকর্মীকে তাঁর পক্ষে রাখা বা নিয়ন্ত্রণ করা; কোনোটাই সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক জটিলতা শেষ পর্যন্ত গড়িয়েছে আদালতে। গত ৩১ অক্টোবর ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ মাসুদুল হক 'জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের কোনো দলীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না' মর্মে আদেশ দিয়েছেন। জাতীয় পার্টি থেকে সম্প্রতি বহিস্কৃৃত উপদেষ্টা জিয়াউল হক মৃধার দলের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে করা মামলার শুনানি শেষে আদালত এ আদেশ দেন। আদালতের আদেশে বলা হয়েছে, '২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর অনুমোদিত গঠনতন্ত্রের আলোকে এ সময় (মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আগে) জি এম কাদের যাতে কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারেন এবং কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করতে না পারেন, সে মর্মে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ দ্বারা বারিত করা হলো।'
জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক সমস্যা আদালত পর্যন্ত গড়ানোকে খারাপ দৃষ্টান্ত বলে মনে করছে রাজনীতি সচেতন মহল। তাদের মতে, রাজনৈতিক দলে অভ্যন্তরীণ সমস্যা-সংকট সৃষ্টি হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। অতীতে এমন ঘটনা বহু ঘটেছে এবং বর্তমানেও প্রায় সব দলেই সমস্যা রয়েছে। দলগুলো অভ্যন্তরীণভাবেই সেসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে। কখনও মীমাংসা হয়, কখনও তা দলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। ঘটে বহিস্কার-পাল্টা বহিস্কারের ঘটনাও। কখনও বা ধরে ভাঙন। কিন্তু জাতীয় পার্টির বিষয়টি আদালতে যাওয়া এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে দলের চেয়ারম্যানের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করারই শামিল। অন্য দলের নেতারাও যদি এ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেন, তাহলে দেশের রাজনীতিতে নতুন এক সমস্যার উদ্ভব ঘটতে পারে।
অনেকের ধারণা, জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরে সৃষ্ট বর্তমান সংকটের পেছনে ক্ষমতাসীন দলের হাত রয়েছে। 'সংসদে গৃহপালিত বিরোধী দল' তকমাধারী জাপা ইদানীং 'কার্যকর বিরোধী দল' হওয়ার কষ্টকর কসরত চালাচ্ছিল। এমনও প্রচারিত রয়েছে, আগামী নির্বাচনের আগে জি এম কাদের বিএনপি জোটে শামিল হতে পারেন। জাপার এই ভবিষ্যৎ 'মোচড়'-এর আশঙ্কায় সরকার কিছুটা হলেও চিন্তিত। তাই জি এম কাদেরকে বশে রাখার জন্য রওশনকে দিয়ে কাউন্সিল ডাকানো হয়েছিল। কিন্তু জি এম কাদের সংসদ বয়কট করার মতো কঠোর অবস্থানে চলে যাওয়ার পর তাঁকে ঠান্ডা করতেই রওশনের আহূত কাউন্সিল স্থগিত করানো হয়েছে। যদিও রওশন এরশাদের ঘনিষ্ঠজন, তাঁর রাজনৈতিক সচিব ও সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব গোলাম মসিহ বলেছেন, চিকিৎসকরা রওশনকে দেশে আসার অনুমতি না দেওয়ায় কাউন্সিল স্থগিত করা হয়েছে। সমালোচকরা অবশ্য বলেন, এ মুহূর্তে সরকারের নির্দেশনার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা দেবর-ভাবি কারোরই নেই।
১৯৮৪ সালে জন্ম নেওয়া জাতীয় পার্টি ইতোমধ্যে পার করেছে ৩৮ বছর। এক সময়ের শাসক দলটি ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে সংকটে পড়েছে। ভাঙনের শিকারও হয়েছে কয়েকবার। কিন্তু এবারের সংকট একটু ভিন্ন ধরনের। এ যেন সংসারের বড় কর্তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি নিয়ে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ। এরশাদের রেখে যাওয়া সম্পদ জাতীয় পার্টিকে নিয়ে দেবর-ভাবির এ দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত দলটিকে কোন পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
মহিউদ্দিন খান মোহন: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্নেষক
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com