
পরিকল্পনা নেই, সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২২ । ০১:২৭ | প্রিন্ট সংস্করণ
সাক্ষাৎকার: বীরূপাক্ষ পাল

বীরূপাক্ষ পাল। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কোর্টল্যান্ডের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন। এক সময় তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ছিলেন। গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে টেলিফোনে সমকালের সঙ্গে বাংলাদেশের বেকারত্ব নিয়ে কথা বলেছেন।
সমকাল : বেকারত্ব বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা। অর্থনীতির ভালো অবস্থার মধ্যেও বেকার তরুণ-তরুণীরা কাজ পাচ্ছেন না। সামনে অর্থনৈতিক সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। তখন সেটি আরও প্রকট হতে বাধ্য। সরকারের কী করা উচিত?
বীরূপাক্ষ পাল :জনসংখ্যা একটি বড় সমস্যা। তবে বেশি হয়ে গেলে আপনি ফেলে দিতে পারবেন না।
জনসংখ্যাকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে সর্বোচ্চ সুফল ঘরে তোলা যায়, সেটা করতে হবে। এদিক থেকে বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মধ্যে আছে। এই ডিভিডেন্ড বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারছে না। সঠিক পরিকল্পনা না থাকার কারণে বাংলাদেশ এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করছে।
সমকাল :এর জন্য কী করা দরকার?
বীরূপাক্ষ পাল :সরকারকে যথোপযুক্ত পরিকল্পনা নিতে হবে। সেই সঙ্গে বেকার তরুণ-তরুণীদের শুধু সরকারি এবং প্রাইভেট চাকরির দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা রাখতে হবে। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় তরুণদের অনেকগুলো মূল্যবান বছর নষ্ট করে দেয়। এরপর অনার্স-মাস্টার্স পাস করে তারা শুধু চাকরি খোঁজে। তাদের মাথায় শুধু বিসিএস- প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস ইত্যাদি। এটা একটা বিকৃতি, এ থেকে বের হতে হবে। পৃথিবীর সব উন্নত দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে সঠিক উপায়ে কাজে লাগিয়েছে। বাংলাদেশকেও সেটা করতে হবে। এর বিকল্প নেই।
সমকাল :বাংলাদেশ কি কাজে লাগাতে পারছে?
বীরূপাক্ষ পাল : বেকার সমস্যা সমাধানে সবার আগে প্রয়োজন বেকারের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা। বাংলাদেশে বেকারের যে সংজ্ঞা নির্ধারিত সে অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম যুবকদের মধ্যে ৪ থেকে ৫ শতাংশ বেকার আছে। যেটা সুইজারল্যান্ড, আমেরিকায় দেখা যায়। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশে বেকার হবে ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ। তথ্য ব্যবস্থাপনার এই বিকৃতি বন্ধ করতে হবে। ভারতের তথ্য ব্যবস্থাপনা অনেক স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়। তবে আমাদের দেশে সেটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পরিপূরক হিসেবে কাজে লাগানো হয়। এটি শুধু আমার কথা নয়, বড় বড় পণ্ডিতরাও এই অভিযোগ করেন।
সমকাল :সরকার তো বলছে যুবকদের লক্ষ্য করে অনেক কিছু করছে। তবে চাকরির ইন্টারভিউয়ে দেখা যায়, পিয়ন পদের জন্য হাজার হাজার অনার্স-মাস্টার্স পাস করা বেকার আবেদন করছে।
বীরূপাক্ষ পাল :সরকারের দাবি ঠিক আছে। তারা উদ্যোগ নিচ্ছে। তবে উদ্যোগটা টার্গেট ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছতে পারছে না। এই জায়গায় বড় অগ্রগতি নেই। বিশ্বজুড়ে সফল দেশগুলোতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখে ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প (এসএমই)। এ জন্য বিনিয়োগে ব্যাংকিং খাতকে এসএমইবান্ধব করতে হবে।
সমকাল :৯ শতাংশ সুদে ঋণের ব্যবস্থা তো সরকার করে দিয়েছে।
বীরূপাক্ষ পাল :দিয়েছে, তবে এই ঋণ কারা পাচ্ছে খোঁজ নিয়ে দেখেন। লাখ-কোটিপতিদের যে সুবিধা, একজন নতুন যুবক উদ্যোক্তা বা বিধবা নারীর জন্যও একই সুবিধা রাখলে কে বেশি লাভবান হবে? এটা আমরা সবাই বুঝি। তাই এ সুবিধাগুলো টার্গেট বেজড হতে হবে। কাকে কত শতাংশ সুদে ঋণ দেবেন তা ঠিক করতে হবে। সঠিক ব্যক্তি অর্থাৎ উদ্যোক্তারা যাতে ঋণটা নিয়ে কাজে লাগান সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সেসঙ্গে কৃষি খাতকে আনুষ্ঠানিকীকরণের মধ্যে আনতে হবে।
সমকাল : সেটা কেমন?
বীরূপাক্ষ পাল :বিদেশে কৃষি ফার্মে কাজ করতে গেলে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে যেতে হয়। আর আমাদের এখানকার কৃষক কখনও তার সন্তানকে কৃষিকাজের জন্য স্বপ্ন দেখতে পারেন না। তাঁদের চিন্তা শুধু চাকরি করবে, শহরে থাকবে। এই ধারা থাকলে কৃষিতে এগোনো সম্ভব নয়। আমাদের দেশের কর্মসংস্থানের মাত্র ১৫ শতাংশে আনুষ্ঠানিকীকরণে আছে। ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক।
সমকাল :উন্নত দেশগুলোতে ছোট কাজগুলোকে কীভাবে আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে আনে?
বীরূপাক্ষ পাল :আমি যুক্তরাষ্ট্রে থাকি। এখানে যে সেলুনে কাজ করে তারও একটি স্বীকৃতি আছে। সে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজটি করে, এতে সংশ্নিষ্টরা সম্মানবোধ করে।
সমকাল :বাংলাদেশে এটা কতটা সম্ভব?
বীরূপাক্ষ পাল :অবশ্যই সম্ভব। আমি প্রায় দুই দশক আগে দেখেছি দূরপাল্লার বাসগুলোতে কোট, টাই পরা ছেলেরা কাজ করছে। এই সেক্টরে ফর্মালাইজেশনের এই উদ্যোগটা বেশি এগোয়নি। কেন এগোয়নি সেটা খুঁজে বের করে উদ্যোগ নিতে হবে। কৃষি, নির্মাণ এবং পরিবহন এই তিন খাতে ফর্মালাইজেশনের উদ্যোগ নিতে পারলে অনেক বেকার আত্মসম্মান নিয়ে কাজ করবে। তবে সেই উদ্যোগটা না নিয়ে শুধু সরকারি চাকরির দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না।
সমকাল :আপনার দৃষ্টিতে বেকার সমস্যা সমাধানে কোন বিষয়টিতে আগে হাত দেওয়া দরকার।
বীরূপাক্ষ পাল :প্রথমে রোগ নির্ণয় করা দরকার। এর জন্য বেকারের প্রকৃত সংখ্যা বের করতে হবে। পরে এই সংখ্যার ওপর চিকিৎসা চালাতে হবে। অর্থাৎ বেকারত্ব তাড়াতে উদ্যোগ হতে হবে সুপরিকল্পিত। ছোট ছোট কাজেও যদি যুবকরা নিয়োগপত্র পায়, শ্রম আইন অনুযায়ী তাদের সুবিধা প্রাপ্য হয়, অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকীকরণ নিশ্চিত করা যায়, তাহলে ছোট কাজকে শিক্ষিত যুবকরা অবজ্ঞা না করে গুরুত্ব দিয়ে করবে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন : বাহরাম খান
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com