
বড় দলগুলোর হারে সতর্ক ব্রাজিল
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২২ । ০৯:৪৫ | প্রিন্ট সংস্করণ
দোহা থেকে, সঞ্জয় সাহা পিয়াল

শীত এসে গেলে দূরে থাকতে পারে কি বসন্ত! বিশ্বকাপে যেখানে আর্জেন্টিনা মাঠে নেমেছে, তখন ব্রাজিলেরই বা অপেক্ষা কেন! বিশ্বকাপ বসন্তের পূর্ণতা দিতেই আজ যেন মাঠে নামছে পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। প্রতিপক্ষ সার্বিয়া। ভেন্যু লুসাইল। হ্যাঁ, সেই মাঠেই, যেখানে কিনা আগের দিনই আর্জেন্টিনার দীর্ঘশ্বাস পড়েছে। মেসিদের অমন হাল দেখে নেইমাররা কি বাড়তি সতর্ক থাকবে- জানাই ছিল সাংবাদিকদের সামনে এলে এমন একটি প্রশ্ন শুনতে হবে ব্রাজিল কোচ তিতেকে। পাশের বাড়িতে ডাকাতি হওয়ার পর যেভাবে প্রতিবেশী এসে সান্ত্বনা দেয়, সেভাবেই উত্তর দিলেন তিতে। 'ওদের সঙ্গে যেটা হয়েছে তা সত্যিই অপ্রত্যাশিত। তবে একটি ম্যাচ হেরে গেলেই যে দলটি খারাপ, তা বোধ হয় বলা ঠিক হবে না। আমি আজ এসব নিয়ে কথা বলতে আসিনি। এসেছি বিশ্বকাপে আমাদের লক্ষ্যের কথা বলতে। ব্রাজিলের ফুটবল সংস্কৃতি সম্পর্কে দলের প্রতিটি খেলোয়াড়ের ধারণা আছে। আমাদের লক্ষ্য অবশ্যই ট্রফির দিকে।'
তবে আর্জেন্টিনার হারের পর গতকাল সন্ধ্যায় জাপানের কাছে জার্মানির হার বড় দল হিসেবে ব্রাজিলও মনস্তাত্ত্বিকভাবে চাপে পড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ পরীক্ষায় ব্রাজিল কী করবে সেটিই দেখার বিষয়।
অনুশীলনে নাকি রাশভারী থাকেন তিতে। এদিন কিন্তু মাইকের সামনে হাসিমাখা মুখেই সারাক্ষণ উত্তর দিয়ে গেছেন। দল নিয়ে তাঁর প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের কারণও ব্যাখ্যা করেছেন। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ৯ স্ট্রাইকার বা ফরোয়ার্ড নিয়ে এবার কাতার এসেছে ব্রাজিল। তাহলে কি গোলমুখ ফোয়ারা ছোটানোর কৌশলই ঠিক করে এসেছে সেলেকাওরা। রিও ডি জেনেরিওর জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল লা গ্লোবার সাংবাদিক কিন্তু উল্টো প্রশ্নই করলেন। আপনি তো সাধারণত রক্ষণাত্মক কৌশলে একাদশ সাজাতে পছন্দ করেন, তাহলে এবার কি কৌশল বদল করছেন? তিতের পাশে বসা অধিনায়ক থিয়াগো সিলভা কানে কানে কী যেন বলে দিলেন। হেসে উত্তর দিতে গিয়ে তিতে জানান, 'দিজো (ডিয়াগো উচ্চারণ এভাবেই করেন ব্রাজিলিয়ানরা) আমাকে বলছে, আপনি কিন্তু ভুলেও আমাদের একাদশ বলবেন না।' আসলে আগের কয়েকটি বিশ্বকাপে কখনও ব্রাজিলের রক্ষণে দুর্বলতা, কখনওবা ফরোয়ার্ডের ভুলের কারণে হারতে হয়েছে। এবার তাই নিজেদের কৌশল আর ছক সম্পর্কে একটা রহস্যই রেখে দিচ্ছেন। শোনা যাচ্ছে, রক্ষণ আর আক্রমণের বাইরে একটা তৃতীয় কৌশল ঠিক করে রেখেছেন তিনি।
বিশ্বকাপে ব্রাজিল যে অলটাইম ফেভারিট সেটা তাদের ঘোর শত্রুও মেনে নেবে। সঙ্গে এটাও মেনে নেবে, নেইমারকে সামনে রেখেই স্বপ্ন দেখছে তারা। অবশ্য নেইমারকে নিয়ে গত দু'বারও এমনই আশার ঘর বাঁধা হয়েছিল। 'এবার কিন্তু আমরা বেটার নেইমারকে পাচ্ছি। তাকে নিয়ে ইনজুরির কোনো ভয় নেই। তাছাড়া ক্লাবে দারুণ ফর্মে আছে সে। বিশ্বকাপে ভালো করার জন্য এমন নেইমারকেই আমরা চেয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য গতবার তার ইনজুরি আমাদের সেই লক্ষ্য পূরণ করতে দেয়নি।' ২০১৪ বিশ্বকাপের পর আবার অধিনায়কত্ব পাওয়া থিয়াগো সিলভা এভাবেই নেইমারের প্রতি তাঁর আস্থার কথা জানান।
নেইমার ঠিক কতটা ফর্মে সিলভা তা মুখে না বললেও পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝানো যেত। পিএসজির হয়ে গত ১৩ ম্যাচে ১১টি গোল করেছেন, ৯টি গোল করতে সাহায্য করেছেন। ফুটবলের ভাষায় যাকে বলে অ্যাসিস্ট। প্যারিস মাতিয়ে কাতার এসেছেন তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জনের জন্য। ইঙ্গিতও দিয়ে রেখেছেন হয়তো পরের বিশ্বকাপে তিনি নাও থাকতে পারেন। তাই যুদ্ধ জয়ের তাঁর এটাই শ্রেষ্ঠ সময়। এখানে দলের বাইরেও তাঁর ব্যক্তিগত একটি মাইলফলক হাতছানি দিচ্ছে। কিংবদন্তি পেলেকে ছাপিয়ে যাওয়ার সুযোগ তাঁর সামনে। ব্রাজিলের হয়ে পেলে গোল করেছেন ৭৭টি, আর নেইমারের সংখ্যা এখন ৭৫। যদিও অফসাইডমুক্ত ফুটবলে পেলে খেলেছিলেন ৯২ ম্যাচ আর নেইমার খেলছেন ১২১ ম্যাচ। ব্রাজিলের এক সাংবাদিকের কাছ থেকে শোনা, শরীরটা ভালো না যাচ্ছে দেখে এবার আর বিশ্বকাপে আসা হচ্ছে না তাঁর। তবে নেইমাররা যদি ফাইনালের মঞ্চ ঠিক করতে পারেন, তাহলে নাকি কাতারের আমিরের বিশেষ অতিথি হয়ে আসার চেষ্টা করবেন।
তবে কিনা গতকাল সংবাদ সম্মেলনে তিতে এবং থিয়াগো- দু'জনেই একটি কথা বারবার বলার চেষ্টা করলেন আর তাহলো, এই ব্রাজিল দল কিন্তু কোনো এক বা দু'জন তারকার ওপর নির্ভর করে বসে নেই। অতীতের অভিজ্ঞতা বলে নেইমারের ওপর এককভাবে প্রত্যাশার চাপ দিয়ে তাঁর কাছ থেকে সেরাটা পায়নি দল। এবার নেইমারকে হালকা রাখতেই দলের বেশ কয়েকজনের কথা উঠে আসছে বারবার। ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, রদ্রিগো আর অন্তোনির তাঁদেরই মধ্যে রয়েছেন। দলের এই তরুণ ব্রিগেডের প্রতি প্রবল আস্থা গোটা দলের। কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকেরই তো এটা প্রথম বিশ্বকাপ। ব্রাজিল দল যেখানে হেক্সার লক্ষ্যে খেলতে এসেছে, সেখানে তাঁদের মতো এতটা অনভিজ্ঞ কীভাবে দলকে চ্যাম্পিয়ন করবে- স্বদেশি এক সাংবাদিকের প্রশ্ন থামিয়ে দিয়ে থিয়াগো উত্তরটা দিয়েছিলেন এভাবে। 'ওদের জন্য বিশ্বকাপ নতুন হতে পারে, কিন্তু ফুটবল মাঠের চাপ ওরা নিতে পারে। আপনি রদ্রিগোকেই দেখেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সে কী চাপের মুখে রিয়াল মাদ্রিদকে স্বস্তি দিয়েছে।' মুখে হাসি এনে অনেকটা কলার ঝাঁকানোর মতোই বললেন, 'মনে রাখবেন, ব্রাজিলিয়ানরা জানে কীভাবে চাপের মুখে খেলতে হয়। '
শেষ ২০০২ সালে জাপান-কোরিয়া থেকে বিশ্বকাপ জিতে গিয়েছিল ব্রাজিল। দুই দশক পর ফের এশিয়ায় আরেকটি বিশ্বকাপ। তাছাড়া এশিয়ায় প্রচুর ভক্ত-সমর্থক রয়েছে। তাদের জন্য কিছু বলবেন কি- সিউলের এক সাংবাদিকদের করা প্রশ্নে থিয়াগোর উত্তর ছিল- 'সমর্থকদের বলব, বিশ্বাস রাখুন আমাদের ওপর। আমরা তৈরি হয়েছে এসেছি কাতারে।' চোয়াল শক্ত করে এতটা আত্মবিশ্বাস ঠিকরে বেরোল থিয়াগোর মধ্যে থেকে, তার পর আর কোনো কথাই থাকে না।
কিন্তু কান কথা কি তাতে থেমে থাকে। কিউএনসিসির সাংবাদিক হাবে পশ্চিমারা বলাবলি করছিলেন ব্রাজিলের দাদাগিরি তো কেবলই লাতিনে। শেষ কবে তারা ইউরোপের দলের সঙ্গে খেলেছে। সেই ২০১৯ এর মার্চে চেক রিপাবলিকের সঙ্গে। তার পর ৩১টি ম্যাচের সবই ওই লাতিনে। একটি হার শুধু আর্জেন্টিনার কাছে। তথ্যগুলো আসলেই সত্য, সেই সঙ্গে এটাও সত্য, ব্রাজিলের এই ২৬ জনের স্কোয়াডে মাত্র দু'জন শুধু স্বদেশি লিগে খেলেন। বাকি ২৪ জনের সবাই সারাবছর ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোর খেলাতেই ব্যস্ত থাকেন এবং তাদের মধ্যে ১২ জনই আবার প্রিমিয়ার লিগে! এবারের বিশ্বকাপে তিতের যে সম্ভাব্য ছক, সেখানেও টটেনহামের রিচার্লিসন সবার ওপরে, তাঁর পেছনে পিএসজির নেইমার, বার্সেলোনার রাফিনহা আরেক পাশে রিয়াল মাদ্রিদের ভিনিসিয়ুস। মাঝমাঠে রিয়াল মাদ্রিদের ক্যাসিমিরো আর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ফ্রেড। বিশ্বকাপের বসন্ত এনে দিতে পারে তাঁরাই।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com