সেন্টমার্টিন দ্বীপ রক্ষায় 'গালগল্প' ঢাকায়

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২২ । ০১:৩২ | প্রিন্ট সংস্করণ

মসিউর রহমান খান

দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে পর্যটক পদচারণ এখনও লাগামহীন। সেখানকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নানামুখী সংকটের বৃত্তে। এর মধ্যেই নতুন করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে অবৈধ স্থাপনা। খোদ পরিবেশ অধিদপ্তরের চোখে চোখে রয়েছে পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়া চলা দেড় শতাধিক অবৈধ হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট। প্রতিদিন পর্যটকদের অনিয়ন্ত্রিত যাতায়াত, অসচেতনতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ, অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, পরিবেশ দূষণের কারণে সেখানকার প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকারি এই অধিদপ্তর। তবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতার কারণে এ দ্বীপ বাঁচাতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা। এসব কারণে দ্বীপটির প্রবাল, শৈবাল, সামুদ্রিক কাছিম, লালকাঁকড়া, শামুক, ঝিনুকসহ নানা জলজ প্রাণী এখন বিলুপ্তির পথে হাঁটছে। সেন্টমার্টিনে যে কোনো স্থাপনা গড়ে তোলার ব্যাপারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানছে না কেউই। দ্বীপটির এমন পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি বলেছে, সেন্টমার্টিন একটি ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) হিসেবে বিবেচিত। সেখানে কোনো রিসোর্ট গড়ে ওঠার কথা নয়। কমিটির পক্ষ থেকে সেখানে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ব্যক্তি মালিকানাধীন হোটেল, মোটেল ও রিসোর্টকে নোটিশ এবং এরই মধ্যে যাদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদ কমিটি বৈঠকে জানিয়েছেন, সেন্টমার্টিনে ব্যক্তি মালিকানাধীন হোটেল, মোটেল ও রিসোর্টের সংখ্যা ১৬৬। এদের কারোরই নেই পরিবেশের ছাড়পত্র। এসব প্রতিষ্ঠানের নাম, আবাসিক কক্ষ, ভবনের ধরন, চালুর সময়, তাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আছে কিনা বিস্তারিত তারা উল্লেখ করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তাদের দায়িত্ব পরিবেশগত ছাড়পত্রের বিষয়ে। অবৈধ স্থাপনার বিষয়টি দেখভাল করে স্থানীয় প্রশাসন।

ওই বৈঠকে 'ইসিএ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কারণে সেখানে বসবাসকারীদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে দ্বীপটিকে সংরক্ষণ এবং পর্যটকদের রাতযাপনের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া যায় কিনা'- সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীর এমন প্রশ্নের জবাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদ বলেন, বিষয়টি চিন্তা করেই এ-সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে।

২০১২ সালের বেসরকারি পর্যায়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সেন্টমার্টিনে হোটেল ছিল ১৭টি। ২০১৮ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮টিতে। আর ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) হিসাবে এ বছরের শুরুতে সেন্টমার্টিনে হোটেল, মোটেল ও কটেজের সংখ্যা দেড়শ।

অবৈধভাবে নির্মিত সব স্থাপনা অপসারণে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ২০০৯ সালে জনস্বার্থে আদালতে মামলা করে। ২০১১ সালে আদালত দ্বীপে পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া গড়ে ওঠা সব স্থাপনা ভাঙার নির্দেশ দেন। এরপরও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ২০১৭ সালে হাইকোর্ট সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেন।

গত ২০ অক্টোবর পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে উপস্থিত হয়ে পরিবেশ সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ জানিয়েছেন, পর্যটন মৌসুমে সেখানে এনফোর্সমেন্টের বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা ম্যাজিস্ট্রেট সংকটের কথা বলেছে। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সবসময় ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে এনফোর্সমেন্ট সম্ভব নয়। জনপ্রশাসন থেকে ডেডিকেটেড ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করে এনফোর্সমেন্ট চালানোর পরামর্শ দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ আরও বলেন, এটি শুধু এনফোর্সমেন্টের বিষয় নয়। সেখানে মানুষের কর্মসংস্থান, ব্যবসা এবং ট্যুর অপারেটরসহ নানা মানুষের সংশ্নিষ্টতা রয়েছে। যে নীতিমালা তৈরি হচ্ছে সেখানে ব্যবস্থাপনার বিষয়টি বিস্তারিত থাকছে। তিনি বলেন, সেখানে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং এলজিইডিসহ অনেক স্টেকহোল্ডার রয়েছে। অনেকের ভূমিকা রয়েছে।

পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক সেমিনারে অংশ নেওয়ার কথা উল্লেখ করে সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ বলেন, ওই সেমিনারেও বলা হয়েছে। এগুলো বন্ধ করে দেওয়া কোনো সমাধান নয়। ওই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনিও একই কথা বলেন।

পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, পর্যটকদের চাহিদা পূরণে দ্বীপের ভূগর্ভস্থ সুপেয় মিঠাপানির স্তরও নিচে নেমে গেছে। এ কারণে নলকূপ থেকে লবণাক্ত পানি আসছে। এ ছাড়া পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যত্রতত্র পল্গাস্টিকের বর্জ্য ফেলা, ভারী জেনারেটর, পাম্প পরিচালনা, পাথর তোলা, সৈকতের বালু অপসারণ- এক কথায় পরিবেশ বিধ্বংসী সব ধরনের কাজই হচ্ছে দ্বীপটিতে। প্রতিদিন এই দ্বীপে আট থেকে ১০ হাজার মানুষের সমাগম হয়। দ্বীপে পর্যটক যাতায়াত নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন নির্দিষ্টসংখ্যক যাত্রী আনা-নেওয়ার বিষয়ে নৌ মন্ত্রণালয় এবং পর্যটন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হলেও এসব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ পরিবেশ অধিদপ্তরের। অথচ জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে সরকার পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করেছিল।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে থাকা এই দ্বীপটির স্থায়ী বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার। এ ছাড়া পর্যটক মিলে প্রতিদিন দ্বিগুণ সংখ্যক মানুষের চাপ নিয়ে এক রকম মরমরে হাল সেন্টমার্টিনের। দ্রুত পর্যটকের স্রোত ঠেকানো না গেলে এ দ্বীপের পরিবেশে ভারসাম্য ফেরানো রীতিমতো অসম্ভব হবে বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা।

সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, পর্যটন ও পরিবেশের বিষয়টি পুরোপুরি আলাদা। এটিকে এক করার সুযোগ নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়িত্ব পরিবেশগত মান দেখা। তিনি বলেন, পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হওয়ায় এখানে কোনো রকম ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ নেই।



© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com