
মতামত
সেন্টমার্টিন রক্ষার গালগল্প ঢাকায় কেন?
প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২২ । ১৯:৫৪ | আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২২ । ২০:২৭
মিজান শাজাহান

শুধু পর্যটনের জন্য নয়, পরিবেশ-প্রতিবেশের বিচারেও দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। প্রায় ৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে থাকা এই দ্বীপটির প্রতি কুনজর রয়েছে কোনো কোনো প্রভাবশালী রাষ্ট্রেরও। তাই জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেও সেন্টমার্টিন আমাদের কাছে আলাদা গুরুত্ব বহন করে। কিন্তু বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকের অতিরিক্ত চাপে দ্বীপটি গত কয়েক বছর ধরে সংকটে পড়েছে।
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে সরকার পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করেছিল। তাই এখানে যে কোনো স্থাপনা গড়ে তোলার ব্যাপারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে; তবে কাগজে-কলমে থাকা সরকারি আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একের পর এক বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মিত হচ্ছে। ফলে দ্বীপটির প্রবাল, শৈবাল, সামুদ্রিক কাছিম, লালকাঁকড়া, শামুক, ঝিনুকসহ নানা জলজ প্রাণী এখন বিলুপ্তির পথে। এসব বিলুপ্ত হয়ে গেলে সেন্টমার্টিন নিয়ে গর্ব করার সুযোগ থাকবে না। শুক্রবার সমকালে প্রকাশিত সেন্টমার্টিন দ্বীপ রক্ষায় 'গালগল্প' ঢাকায় শীর্ষক সংবাদে দ্বীপটি ঘিরে নানা শঙ্কার চিত্র ফুটে উঠেছে।
২০১২ সালের বেসরকারি পর্যায়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সেন্টমার্টিনে হোটেল ছিল ১৭টি। ২০১৮ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮টিতে। আর ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) হিসাবে এ বছরের শুরুতে সেন্টমার্টিনে হোটেল, মোটেল ও কটেজের সংখ্যা দেড়শ। পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও স্বীকার করে নিয়েছেন, বর্তমানে ব্যক্তি মালিকানাধীন হোটেল, মোটেল ও রিসোর্টের সংখ্যা ১৬৬। ১০ বছরের মধ্যে ১৭টি বেড়ে ১৬৬ হওয়ার পরিণতি আর ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বিস্ময়কর যে তথ্য দিয়েছেন তা হলো ১৬৬ হোটেল, মোটেল ও রিসোর্টের একটিরও অনুমোদন নেই। প্রশ্ন হলো, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া এসব বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে উঠল কীভাবে? স্থানীয় প্রশাসন তথা কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও টেকনাফ উপজেলা প্রশাসন কেন তাদের ঠেকাল না?
জনবল সংকটের কথা বলে সব দায় এড়ানো যায় না। সেন্টমার্টিনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপে রাতারাতি এসব স্থাপনা তৈরি হয়নি। এসব অবকাঠামো নির্মাণে সময় লেগেছে। তখন প্রশাসন ব্যবস্থা নিলে আজকে সংখ্যাটি থ্রি ডিজিটে আসতে পারত না। দেশে একাধিক মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর রয়েছে। কাজের পরিধি আলাদা হলেও সবাই রাষ্ট্র ও নাগরিকের জন্য কাজ করে। তাই সমন্বয়হীনতার অবসান জরুরি; এক বিভাগ আরেক বিভাগের ঘাড়ে দোষ না চাপিয়ে সেন্টমার্টিনকে রক্ষায় দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সভাপতি সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী সেন্টমার্টিনে বসবাসকারীদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে দ্বীপটিকে সংরক্ষণ এবং পর্যটকের রাতযাপনের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা আমলে নেওয়া উচিত। বসবাসকারীদের অন্যত্র আবাসন করে দিলে এটা নিয়ে আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে পর্যটক নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে রাজস্ব কমবে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে এ বাস্তবতা মেনে নেওয়া উচিত। কারণ দ্বীপ বাঁচলে রাজস্ব আসবে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে দ্বীপের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে। সমকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ইতোমধ্যে দ্বীপটি হুমকিতে পড়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, পর্যটকের চাহিদা পূরণে দ্বীপের ভূগর্ভস্থ সুপেয় মিঠাপানির স্তরও নিচে নেমে গেছে। এ কারণে নলকূপ থেকে লবণাক্ত পানি আসছে। এ ছাড়া পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যত্রতত্র প্লাস্টিকের বর্জ্য ফেলা, ভারী জেনারেটর, পাম্প পরিচালনা, পাথর তোলা, সৈকতের বালু অপসারণ- এক কথায় পরিবেশ বিধ্বংসী সব ধরনের কাজই হচ্ছে দ্বীপটিতে। প্রতিদিন এই দ্বীপে আট থেকে ১০ হাজার মানুষের সমাগম হয়। পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখে পর্যটন খাত থেকে আয়ের চিন্তা হবে আত্মঘাতী। পর্যটক চাপ থাকলেই সবাইকে একসঙ্গে সুযোগ করে দেওয়া উচিত নয়। এজন্য এটিকে নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা দরকার। আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তিতে যারা আগে বুকিং দেবেন সেই নির্দিষ্ট সংখ্যক পর্যটককে ওদিন যাওয়ার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। এজন্য ডিজিটালি বুকিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে; পর্যটকরা অনলাইনে বুকিং দেবেন।
মন রক্ষা, রাজস্ব আদায়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সেন্টমার্টিনকে বাঁচিয়ে রাখা। রাজধানীর হাতিরঝিলে বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত মূল্যবান হওয়া সত্ত্বেও একটি সুৃউচ্চ বভবন ভেঙে ফেলা হয়েছিল আদালতের নির্দেশে এলাকার প্রতিবেশের কথা বিবেচনা করে। উচ্চআদালত ভবনটিকে 'বিষফোড়া' আখ্যা দিয়েছিলেন। আর সরকার-ঘোষিত পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা সেন্টমার্টিনে এতসব বাণিজ্যিক স্থাপনা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে কীভাবে? কেবল ঢাকায় বসে কথা নয় বরং পরিবেশ অধিদপ্তরকে প্রয়ােজনে সেন্টমার্টিন গিয়ে অভিযান চালানোসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com