সমকালীন প্রসঙ্গ

ভোটের দিনের নয়, চাই প্রতিদিনের গণতন্ত্র

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২২ । ০২:১০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মোশতাক আহমেদ

নির্বাচন এলেই গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনায় সরগরম হয়ে ওঠে চারদিক- গ্রামের হাটের চায়ের দোকান থেকে টেলিভিশনের 'টকশো'; সর্বত্র। কি সরকারি দল কি বিরোধী; সবাই তখন গণতন্ত্রের জন্য 'যায় যদি যাক প্রাণ' পণ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাজপথে; যারা ক্ষমতায় থাকে, তারা গণতন্ত্র রক্ষার জন্য আর যারা ক্ষমতার বাইরে থাকে, তারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য। তবে সবারই লক্ষ্য থাকে 'নির্বাচন'। যেন নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়াই গণতন্ত্রের একমাত্র উদ্দেশ্য।

এটি যে শুধু সাম্প্রতিক সময়ের বিষয়, এমন কিন্তু নয়। সেই স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকেই, বলা চলে তারও আগে, পাকিস্তান আমল থেকেই এমনটি চলে আসছে। যদিও পাকিস্তান আমলের প্রেক্ষিত ছিল ভিন্ন। একদিকে বাঙালি জাতিসত্তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া দেড় হাজার মাইল দূরের এক বিজাতীয় গোষ্ঠীর নব্য উপনিবেশবাদী আধিপত্য; অন্যদিকে তাদেরই প্রতিভূ সামরিক স্বৈরশাসন। স্বাভাবিকভাবেই তখনকার সংগ্রামে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর ভৌগোলিক স্বাধিকারের প্রশ্নটিই হয়ে উঠেছিল মুখ্য। গণতন্ত্রের ভাবাদর্শগত ভিত্তি বা চেতনা নিয়ে বেশি গভীরে যাওয়ার তেমন প্রয়োজন বোধ করেনি এ দেশের মানুষ। ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনকেই তারা দেখেছে গণতন্ত্র হিসেবে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও এ বিষয়ে পাকিস্তানি ধারণা থেকে উত্তরণের কোনো প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়নি। স্বাধীনতার প্রত্যুষলগ্নে প্রত্যাশা ছিল, লাখো শহীদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশে গণতন্ত্রই হবে মূল চালিকাশক্তি এবং সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার ভিত্তি। কিন্তু সেটি হয়ে ওঠেনি বা হয়ে উঠতে দেওয়া হয়নি। এই তো কয়েক দিন আগেই (৪ নভেম্বর) আমাদের সংবিধান দিবস পালিত হলো। অনেকেই অনেক আলোচনা করলেন। অথচ সংবিধানে বিধৃত চার মূলনীতির প্রথমটিই যে গণতন্ত্র; তা নিয়ে তেমন আলোচনা চোখে পড়েনি। পড়েনি কারণ এখনও এ দেশের মানুষ গণতন্ত্র বলতে নির্বাচনকেই বোঝে। বোঝে প্রতিনিধি বাছাইয়ের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে। তাই তো নির্বাচন এলে তা সে জাতীয় নির্বাচনই হোক আর স্থানীয় সরকার; গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না আর 'মারমার কাটকাট' শুরু হয়ে যায়। বাস্তবতা হলো, মুখে যতই গণতন্ত্রের কথা বলি না কেন; প্রকৃত অর্থে আমরা গণতন্ত্রকে ভয় পাই। কারণ গণতন্ত্র গণমানুষ তথা সাধারণ মানুষের কথা বলে। বলে জবাবদিহির কথা। সমস্যা হলো এই জবাবদিহি নিয়েই। কারণ জবাবদিহি নিশ্চিত হলে সমাজে, সরকারে চুরিচামারি, লুটপাট চলতে পারবে না। এসব যদি না চলে তাহলে সুবিধাবাদী বুর্জোয়ারা চলবেই বা কেমন করে!


আজকে যদি আমরা আমাদের সমাজবাস্তবতার দিকে তাকাই; দেখব রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার কোনো ক্ষেত্রেই জবাবদিহির লেশমাত্র নেই। সবাই নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে ক্ষমতার স্তরবিন্যাস অনুযায়ী ঊর্ধ্বতনকে খুশি করতে ব্যস্ত। এখানে জনগণের কোনো ঠাঁই নেই। যদিও আমরা কথায় বলি, 'জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস'; বাস্তবে জনগণ হলো ক্ষমতায় যাওয়ার একটা সিঁড়ি মাত্র। এই যে আমাদের আমলা সম্প্রদায়, যাদের প্রমিত বাংলায় বলা হয় 'প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী', তারা পর্যন্ত জনগণকে গোনায় ধরে না। কয়েক দিন আগে দেখলাম, সরকারের একজন আমলা সচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। শুধু সচিব পদেই নয়; আরও নিম্নতর পদেও অহরহ এমনটি হচ্ছে। কিন্তু এমনটি কি হওয়ার কথা? একজন আমলা তাঁর যোগ্যতাবলেই পদোন্নতি পাবেন। এটিই স্বাভাবিক। যখন কোনো আমলা তাঁর পদোন্নতি বা পদায়নের জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন, তখনই তাঁর জবাবদিহির অবস্থানটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে- তিনি জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। এই যদি হয় অবস্থা, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে কেমন করে! জবাবদিহির অনুপস্থিতির কারণে ক্রমেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলছে। ফলে বারবার হোঁচট খাচ্ছে আইনের শাসন। তাই তো দেখি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের মতো একটি চাঞ্চল্যকর মামলার শুনানি গত ১০ বছরে ৯৩ বারের মতো পেছানো হয়। অন্যদিকে স্বল্প সময়ের মধ্যেই রাজধানীতে মুনিয়ার মতো এক তরুণী হত্যা মামলার প্রধান অভিযুক্ত একজন শীর্ষ ব্যবসায়ীর পক্ষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। শুধু ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাই নয়; খোদ সংসদেও নেই কোনো জবাবদিহির বালাই। এই যে দেশে এত কিছু ঘটছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে হুহু করে; কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নামে মাসে মাসে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে; এসব নিয়ে সংসদে কোনো আলোচনা নেই। নেই কারও কোনো উচ্চবাচ্য। বিশ্বাস করতে চাই, আমাদের সংসদে যাঁরা আছেন, তাঁদের মাঝে নিশ্চয় এমন অনেকে আছেন, যাঁরা এসব নিয়ে ভাবেন। কিন্তু তাঁরা কথা বলতে চান না। এক অদৃশ্য শক্তি তাঁদের মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে। তাঁরা দলতন্ত্রের কাছে অসহায়। এভাবেই গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে দলতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদিতা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে।

এই অবস্থাতেই আমরা পাঁচ বছর পরপর গা-ঝাড়া দিয়ে উঠি কখনও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য, কখনওবা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে। ভাবখানা এমন- পাঁচ বছরে এক দিন সুন্দর একটি নির্বাচন করতে পারলেই সব ল্যাঠা চুকে গেল; বাকি ১ হাজার ৮২৪ দিন যা-ই ঘটুক না কেন। অথচ আমরা একবারও ভাবি না, গণতন্ত্র একটি চলমান সামাজিক প্রক্রিয়া। এক দিনের ভোটেই তার পরিপূর্ণতা আশা করা বোকামি বৈ আর কিছু নয়।

একটি কথা আমরা প্রায়ই বলে থাকি- বিরোধী দল শক্তিশালী হলে গণতন্ত্রও শক্তিশালী হয়। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত যখন যে দল ক্ষমতায় থেকেছে, তারাই বিরোধী দলকে দমিয়ে রাখার সম্ভাব্য সব চেষ্টা চালিয়েছে এবং এখনও যাচ্ছে। ভিন্নমতের প্রতি সাধারণ সহিষুষ্ণতাটুকু দেখাতে কেউ রাজি নয় বলে মনে হচ্ছে। সম্প্রতি বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সরকার বা সরকারি দল যা করছে, তাকে কোনো অবস্থাতেই গণতন্ত্র বিকাশে সহায়ক বা ইতিবাচক বলা চলে না। তবে এটিও সত্য, বিএনপি যদি কখনও ক্ষমতায় আসে, তারাও যে একই পথে হাঁটবে না- এর কোনো নিশ্চয়তা নেই।

অপ্রিয় হলেও এটিই সত্য, বাংলাদেশে গণতন্ত্র দলনে সামরিক স্বৈরশাসন আর নির্বাচিত বেসামরিক শাসন যেন একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে চলেছে। গত পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। এই সময়ে যেসব দল রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে, তাদের কেউই আইনের শাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সচেষ্ট হয়নি। ফলে গণতন্ত্র তার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। গণতন্ত্রকে দুর্বল রেখে নির্বাচন ব্যবস্থা যতই শক্তিশালী করা হোক না কেন, তা কখনোই কার্যকর ফল দিতে পারে না- এ কথা কে না জানে! এটি পেতে হলে আমাদের প্রতিদিনের রাষ্ট্রিক আচরণে গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে; শুধু ভোটের দিনে নয়।

মোশতাক আহমেদ: কলাম লেখক ও জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com