১০ ডিসেম্বর বিএনপির মহাসমাবেশ

কেন নয়াপল্টনে 'হ্যাঁ' সোহরাওয়ার্দীতে 'না'

প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২২ । ০৩:৪২ | প্রিন্ট সংস্করণ

সমকাল প্রতিবেদক

নয়াপল্টনেই অটল বিএনপি। সেখানেই আগামী ১০ ডিসেম্বর মহাসমাবেশের মঞ্চ সাজাতে চায় রাজপথের প্রধান বিরোধী দলটি। বিএনপি নেতাদের ভাষ্য, অতীতে নয়াপল্টনেই অনেক সমাবেশ-মহাসমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। আগামীতেও সেখানে শান্তিপূর্ণ বড় সমাবেশে কোনো সমস্যা হবে না।

একই সঙ্গে সরকারি প্রস্তাব প্রসঙ্গে দলটি বলছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৮ ও ৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলন হবে। পরদিন সেখানে কীভাবে মহাসমাবেশ করবে বিএনপি? যেখানে এ ধরনের মহাসমাবেশ হয়, সেখানে অন্তত এক সপ্তাহ আগে থেকেই মঞ্চ তৈরিসহ সব প্রস্তুতি নিতে হয়। সমাবেশ ঘিরে নেতাকর্মীরাও আসতে শুরু করেন। সরকারের এ ধরনের প্রস্তাব সাংঘর্ষিক এবং হাস্যকর বলেও মনে করেন দলটির নেতারা।

কয়েক লাখ লোকের জমায়েতের স্থান হিসেবে বিশাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নয় কেন? এমন প্রশ্ন তুলেছেন রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা। তাঁরা মনে করেন, যানজটের নগরে জনদুর্ভোগের কথা মাথায় রেখে বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানই বেছে নেওয়া উচিত। সম্প্রতি সেখানে পরপর কয়েকটি সমাবেশ ও মহাসমাবেশ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও। সরকার সমাবেশের মঞ্চ তৈরিসহ সব প্রস্তুতি নেওয়ার সময় দিলে রাজি হতে অসুবিধা কোথায়- এ প্রশ্নও রাখেন তাঁরা।

এ ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল কুমিল্লা বিভাগীয় গণসমাবেশে পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, সরকার পূর্বাচল থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসছে। সোহরাওয়ার্দী থেকে নয়াপল্টনেও আসবে। তাঁরা নয়াপল্টনেই শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ করবেন।

বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী সমকালকে জানান, তাঁরা নয়াপল্টনেই শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ করতে চান। শুধু নয়াপল্টনের নাম উল্লেখ করেই তারা দু'দফা চিঠি দিয়েছেন। বিকল্প কোনো স্থানের নাম উল্লেখ করেননি। কেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নয়- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, নয়াপল্টনে বড় বড় সমাবেশ করেছেন তাঁরা। সোহরাওয়ার্দীতে ৮ ও ৯ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের সম্মেলনের পরদিন বিএনপিকে মহাসমাবেশ করতে বলার পেছনে 'ষড়যন্ত্র' থাকতে পারে। মঞ্চ তৈরি করতেই কয়েক দিন সময়ের প্রয়োজন।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বৃহস্পতিবার বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছিলেন। তবে ৮ ও ৯ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের সম্মেলনের বিষয়ে গতকাল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা মুখ খুলতে রাজি হননি। আজ বিকেলে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভা হবে। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।

অপর এক সূত্র জানিয়েছে, ইচ্ছা করলে ছাত্রলীগের দ্বিতীয় দিনের কাউন্সিল অধিবেশন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (আইইবি) মিলনায়তন বা অন্য কোনো মিলনায়তনেও হতে পারে। গতবারও ছাত্রলীগের দ্বিতীয় দিনের কাউন্সিল অধিবেশন আইইবির মিলনায়তনে হয়েছিল। এটি আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের ব্যাপার।

গতকাল ঢাকা ক্লাবে অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, সরকার যে জায়গা ভালো বলে মনে করে সেটিরই ব্যবস্থা করবে। তিনি বলেন, অফিসিয়ালি তারা তিনটি জায়গার একটি চেয়েছিল।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছাড়া বিকল্প কোনো চিন্তা সরকারের আছে কিনা জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিএনপি এত বড় গ্যাদারিং করবে, এই স্পট ছাড়া অন্য কোথায় আছে? তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান- পার্লামেন্ট ভবনের সামনে এগুলো চেয়েছিল। কিন্তু সংসদ ভবনের সামনে কাউকে দেওয়া হয় না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগ সভা-সমাবেশ কাউন্সিল অধিবেশন করছে। এটা সবার জন্য 'সুইটেবল' মনে করা হচ্ছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের কিছু দলীয় প্রোগ্রাম আছে সেগুলো শেষ হয়ে যাবে। এরপর তারা এটা ব্যবহার করতে পারবে।

ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক সমকালকে বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়ার কথা ভাবছি। এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আরও সময় আছে। ডিএমপির মুখপাত্র ডিসি (মিডিয়া) ফারুক হোসেন বলেন, যে ভেন্যুতে বিএনপি সমাবেশ করার অনুমতি পাবে, সেখানে পুলিশের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর যেখানে অনুমতি মিলবে, তার বাইরে অন্য কোথায়ও সমাবেশ করলে সেটা বেআইনি হবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দেওয়া হতে পারে। দলটি কয়েক লাখ লোকসমাগমের ঘোষণা দিয়েছে। নয়াপল্টনে ৬০-৭০ হাজারের বেশি লোকের সংস্থান হয় না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বেশি লোক জমায়েত করে সমাবেশ করার উপযুক্ত জায়গা। বিএনপির প্রতিনিধি দল যখন ডিএমপি কমিশনারের কাছে সাক্ষাৎ করে সমাবেশের অনুমতি চেয়ে চিঠি দিয়েছিল, তখনও তাঁদের বিকল্প ভেন্যুর কথা বলা হয়েছিল। তাঁরা বিকল্প ভেন্যুর নাম দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। অনুমতি ছাড়া অন্য ভেন্যুতে সমাবেশ করলে আইন অনুযায়ী পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।

আরেক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ৮ ও ৯ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অন্য সংগঠনের কর্মসূচি থাকলেও ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশ করতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বিএনপি মঞ্চ করার পর্যাপ্ত সময়ও পাবে।

নয়াপল্টনের বিকল্প নয় কেন?: বিএনপি নেতারাও জানান, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তরফ থেকে নয়াপল্টনের বিকল্প স্থান চিন্তা করার প্রস্তাব করেছিল। বিষয়টি দলীয় ফোরামে আলোচনা করে পুলিশকে জানাবেন বলে জানিয়েছেন তাঁরা। সেই আলোকে বিএনপির একটি দলও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও আরামবাগ মোড় এলাকা পরিদর্শন করে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক আহ্বান করা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল বৈঠকে বিকল্প ভেন্যুগুলোর সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করে নয়াপল্টনেই সমাবেশ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বিএনপি সূত্র দাবি করেছে, নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে লোক সমাগমে অনেক সুবিধা। চারদিক থেকে নির্বিঘ্নে নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলে উপস্থিত হতে পারবেন। পশ্চিমে কাকরাইল-বিজয়নগর মোড়, দক্ষিণে পুরানা পল্টন মোড়, পূর্বে ফকিরাপুল এবং উত্তরে রাজারবাগ ও মালিবাগ মোড় দিয়ে নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে দলে দলে সমাবেশে যোগ দিতে পারেন। সমাবেশে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেও নেতাকর্মীরা চারদিকের রাস্তা দিয়ে নিরাপদে সরে যেতে পারেন। তা ছাড়া নিজেদের দলীয় কার্যালয়ের সামনে হওয়াতে নেতাকর্মীর প্রভাব ও মনোবলও চাঙ্গা থাকে।

দলীয় সূত্রটির দাবি, সরকার বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একেবারের এক কোনায় অর্থাৎ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের দেয়ালের পাশে অনুমতি দেয়। সেখানে নেতাকর্মীর আসা-যাওয়া বিঘ্নিত হয়। মাত্র ছোট একটি গেট দিয়ে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে ভেতরে ঢুকতে হয়। এতে প্রচণ্ড ভিড় হয়। সার্বিকভাবে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিক থেকে ঢুকতে গেলে ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগের হামলার শিকার হতে পারে। আবার শাহবাগ দিক থেকেও আসতে একই সমস্যার শঙ্কা রয়েছে। শুধু পূর্বদিক থেকে মৎস্য ভবনের সামনের রাস্তা দিয়ে উদ্যানের ভেতর ঢুকতে হবে। চার দেয়ালের ভেতর লাখ লাখ নেতাকর্মীকে ভেতরে ঢোকানো ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করে দলটি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির কয়েকজন নেতা সমকালকে বলেন, অতীতে স্বৈরাচারী সব সরকারের আমলেই গণআন্দোলন রাজপথেই হয়েছে। রাজপথের সভা-সমাবেশ ও মিছিলের প্রভাব অনেক বেশি। উত্তপ্ত রাজপথের সমাবেশ ও মিছিলের অগ্নিস্ম্ফুলিঙ্গ অবৈধ সরকারের গদিতে কম্পন হয়। কোনো নির্দিষ্ট স্থানে বা উদ্যানে সমাবেশ করলে সরকারের ওপর চাপ তুলনামূলক কম হয়। এমনকি সমাবেশের প্রতিক্রিয়া জনজীবনে তেমন প্রভাব পড়ে না। দেশজুড়ে আলোচনাও কম হয়। ব্যাপক লোকসমাগমে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলো এক দিন বা এক বেলা বন্ধ থাকলে এর প্রভাব রাজধানীজুড়ে পড়ে। নগর অনেকটা অচল হয়ে পড়ে। তাতে বিরোধী দলের দাবি পূরণের ব্যাপারে এক ধরনের চাপ তৈরি হবে। এসব নানা হিসাব-নিকাশ কষেই বিএনপি নির্দিষ্ট ময়দানের চেয়ে রাজপথকে প্রাধান্য দিচ্ছে বেশি।

অবশ্য বিএনপির নেতারা দীর্ঘদিন ঢাকায় 'মহাসমাবেশ' করার কথা বললেও ডিএমপি পুলিশ কমিশনারকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে 'ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ'। ২০ নভেম্বর কমিশনারকে দেওয়া দ্বিতীয় দফার চিঠিতে দুপুর ১২ থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনুমতি চাওয়া হয়। দলের দপ্তরের দায়িত্ব থাকা সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, নয়াপল্টনে এর আগেও বিএনপির সব সমাবেশ সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে করেছে।

গত ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে বিভাগীয় সম্মেলন করার মাধ্যমে দুই মাসব্যাপী কর্মসূচি শুরু করে বিএনপি, যা আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণসমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, ময়মনসিংহ, রংপুর, ফরিদপুর, সিলেট ও কুমিল্লায় সমাবেশ করেছে দলটি।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com