আলোচনাই সমাধান

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২২ । ০৩:২৮ | প্রিন্ট সংস্করণ

সম্পাদকীয়

নূ্যনতম মজুরি ২০ সহস্র টাকা নির্ধারণসহ ১০ দফা দাবিতে নৌযান শ্রমিকরা রবিবার হইতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করিয়াছে। রবিবার সমকালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, আন্দোলনকারী শ্রমিকদের সংগঠন নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন তাহাদের দাবিগুলি মানিয়া লইবার জন্য সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষকে শনিবার রাত ১২টা পর্যন্ত সময় দিয়াছিল। এই সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হওয়ায় নৌযান শ্রমিকরা দেশের সকল নৌপথে নৌযান চলাচল বন্ধ করিয়া দিয়াছে। ইহার ফলে শুধু যে নৌপথে যাত্রী চলাচল বন্ধ হইয়াছে, তাহাই নহে; দেশের ৮০ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনাকারী চট্টগ্রাম বন্দরসহ সকল সমুদ্রবন্দরেও বিশেষ করিয়া আমদানিকৃত মালপত্র খালাসে অচলাবস্থা তৈরি হইয়াছে। অর্থাৎ চলমান নৌযান ধর্মঘট আপাতদৃষ্টে নিছক নদীপথে চলাচলকারীদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করিলেও, বাস্তবে উহা অবিলম্বে কোনো সমাধানসূত্র বাহির না হইলে সাধারণ জনজীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলিবে। গত কয়েক দশকে বিশেষত সড়ক পরিবহন ক্ষেত্রে বহুবিধ উন্নয়ন ঘটিলেও এখনও দক্ষিণাঞ্চলের একটা বিশাল জনগোষ্ঠী বিশেষ করিয়া তুলনামূলক সুলভ ও আরামদায়ক ভ্রমণের অভিপ্রায়ে নৌপথে চলাচল করে। চলমান ধর্মঘটের কারণে সেই সকল মানুষ বেশ বেকায়দায় পড়িবে। উপরন্তু ধর্মঘট এমন এক সময়ে সংঘটিত হইতেছে যখন বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি, তৎসহিত তীব্র ডলার সংকট হেতু অভ্যন্তরীণ বাজারে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের সরবরাহ দারুণভাবে হ্রাস পাইয়াছে। একই সঙ্গে পণ্যসমূহের মূল্যও অনেকাংশে বিশেষ করিয়া সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাহিরে চলিয়া গিয়াছে। নৌযান শ্রমিকদের এহেন ধর্মঘট কিয়দংশে হইলেও রপ্তানি কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করিতে পারে। কারণ সড়কপথে যানজট ও উচ্চ ব্যয়ের কারণে অনেক রপ্তানিকারক বন্দরে পণ্য প্রেরণ করিতে নৌপথকে অগ্রাধিকার দিয়া থাকেন।

বিগত দুই বৎসরের করোনা মহামারি এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে দেশে যে রূপ ভয়াবহ মূল্যস্ম্ফীতি ঘটিয়াছে; উহার বৃহৎ শিকার নিম্ন আয়ের মানুষ- এই কথা সর্বজনবিদিত। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে ব্যতিক্রম নহে, উহাও সকলের জানা। আর ধর্মঘটরত নৌযান শ্রমিকরা এই নিম্ন আয়ের মানুষেরই অংশ, যাহাদের পক্ষে বর্তমান মজুরি দিয়া সংসারের ব্যয় নির্বাহ সত্যই কঠিন হইয়া পড়িয়াছে। অতএব, তাহাদের প্রধান দাবি উপেক্ষা করিবার কোনো সুযোগ নাই। নৌযান শ্রমিকরা আরও যে দাবিসমূহ পেশ করিয়াছেন, তন্মধ্যে রহিয়াছে নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র ও সার্ভিস বুক প্রদান। এই সকল বিষয় যে কোনো পেশার মানুষের জন্য বিশেষ করিয়া চাকুরির নিশ্চয়তার কথা বিবেচনা করিলে আবশ্যকীয় বটে- কে অস্বীকার করিবে! নৌযান শ্রমিকদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন করিতে হইলেও এই বিষয়গুলি প্রয়োজনীয়। কিন্তু দুঃখজনক, বৎসরের পর বৎসর দাবি উত্থাপনের পরও শুধু আশ্বাস ব্যতিরেকে মালিকগণ, তৎসহিত সংশ্নিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ নৌযান শ্রমিকদের জন্য কিছুই করিতে পারে নাই। শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে গত বৎসর নৌযান মালিকরা শ্রমিকদের খাদ্য ভাতা ও সমুদ্র ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি করিয়াছিল। এখন শ্রমিকরা সেই ভাতার নিশ্চয়তার স্বার্থে কন্ট্রিবিউটরি ফান্ড ও নাবিক কল্যাণ তহবিল গঠনের দাবি উত্থাপন করিয়াছে। ইহাও অপ্রাসঙ্গিক কোনো দাবি নহে। এই রূপে বিশ্নেষণ করিলে নৌযান শ্রমিকদের দাবিসমূহের যৌক্তিকতা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষমাত্রই স্বীকার করিবেন।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, নৌযান মালিকরা তো বটেই, এই ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে নিয়োজিত নৌপরিবহন অধিদপ্তরও ধর্মঘট আরম্ভ হইবার পূর্বে যথেষ্ট সময় পাইবার পরও তাহা এড়াইবার লক্ষ্যে শ্রমিকদের সহিত কার্যকর কোনো আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করে নাই। স্বাভাবিক কারণেই নৌযান শ্রমিকশ্রেণি অনন্যোপায় হইয়া শনিবার রাত্রি ১২টার পর হইতে ধর্মঘটে শামিল হইয়াছে। একই সঙ্গে যাত্রীসাধারণ ও নৌপথের সেবাগ্রহীতারা নানাবিধ দুর্ভোগে পড়িয়াছে। আমরা জানি, ধর্মঘট প্রসঙ্গে নৌযান মালিকদেরও বক্তব্য রহিয়াছে। বিদ্যমান মূল্যস্ম্ফীতিসহ জাতীয় অর্থনীতির সংকটকালে বিশেষ করিয়া অর্থসংশ্নিষ্ট দাবিসমূহ পুরাপুরি মানিয়া লওয়া তাহাদের পক্ষে বাস্তবিকই কঠিন হইতে পারে। তাই বলিয়া শ্রমিকদের সহিত এখন পর্যন্ত কোনো প্রকার আলাপ-আলোচনা না করাও গ্রহণযোগ্য বিষয় হইতে পারে না। আমরা মনে করি, উভয় পক্ষ আলোচনায় বসিলে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান বাহির হইতে পারে। আর আলোচনাই উদ্ভূত পরিস্থিতি হইতে উত্তরণের একমাত্র পথ। আমাদের প্রত্যাশা, এই ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখিবার লক্ষ্যে সংশ্নিষ্ট সরকারি সংস্থা অবিলম্বে উদ্যোগী হইবে।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com