ভালো নেই ইমাম-মুয়াজ্জিনেরা

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২২ । ১১:০৪ | প্রিন্ট সংস্করণ

নাজমুল হাসান, গুরুদাসপুর (নাটোর)

গুরুদাসপুরের মশিন্দা শিকারপুর গ্রামের মসজিদের ইমাম মো. সিদ্দিকুর রহমান। মাস শেষে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে চাঁদা তুলে ৫ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হয় তাঁকে। অনেক সময় দুই মাস পরও পান বেতন। তিনি বলেন, 'সংসারে স্ত্রী, দুই মেয়ে আর এক ছেলে। মাস শেষে ৫ হাজার টাকা বেতনে সংসার চলে না। প্রতি মাসেই ধারদেনা বাড়ছে।'

একই অবস্থা পৌর সদরের খামারনাচকৈড় মসজিদের ইমাম মহরম আলীর। তিনি বলেন, 'পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেশিরভাগ সময়ই সবজি বা ডাল খেয়ে কোনোমতে পার করছি। সবজি কেনাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়ছে ধারদেনার চাপ।' তিনি বলেন, ইমাম-মুয়াজ্জিনের পেশায় কোনো ছুটি নেই। নেই ঝড়বৃষ্টি কিংবা কনকনে শীতের অজুহাত। সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হয়।

গুরুদাসপুর উপজেলায় প্রায় ৪৪৪ জন ইমাম ও ৪১০ জন মুয়াজ্জিন। অন্তত ৩০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাস শেষে মসজিদ কমিটি থেকে ইমাম ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার আর মুয়াজ্জিন দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা পান। এ টাকায় সংসারের চাকা যেন ঘুরছে না। পৌরসভার চেয়ে গ্রামাঞ্চলের অবস্থা আরও করুণ।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ৪৪৪টি মসজিদ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৮০টি ওয়াক্তিয়া। বাকিগুলো জামে মসজিদ। প্রায় প্রতিটিতেই একজন করে ইমাম ও মুয়াজ্জিন রয়েছেন। অনেকে দুই দায়িত্ব একসঙ্গে পালন করেন। ইমামতির পাশাপাশি মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত ১৫৪ জন। তাঁদের মাসিক বেতন ৫ হাজার টাকা। উপজেলায় কোনো সরকারি মসজিদ না থাকলেও মডেল মসজিদ নির্মাণকাজ চলছে।

উপজেলার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম সর্বোচ্চ ১১ হাজার টাকা বেতন পান। মুয়াজ্জিনের বেতন সাড়ে ৭ হাজার ও খাদেমের ৭ হাজার টাকা। এ মসজিদের সভাপতি ইউএনও। কেন্দ্রীয় মসজিদ ছাড়া অন্য কোনোটির এমন বেতন কাঠামো নেই।

কথা হয় উপজেলা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম জহুরুল হকের সঙ্গে। তিনি জানান, উপজেলার একমাত্র কেন্দ্রীয় মসজিদ এটি। ইমামতির পাশাপাশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করেন তিনি। এতে কোনোমতে দিন কেটে যাচ্ছে।

একই মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. মাসনুন হাসান জানান, সাড়ে ৭ হাজার টাকা বেতনে সংসার চলে না তাঁর। স্ত্রীসহ চার সন্তান রয়েছে। মুয়াজ্জিন পেশার বাইরে আর কোনো আয় নেই। মসজিদ কমিটির দেওয়া বেতনের ওপর নির্ভর করতে হয়। মাস শেষে এ টাকা দিয়ে হিসাব মেলে না। আগামী দিনগুলো কীভাবে চলবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।

তাঁর মতোই অবস্থা খাদেম মো. মাসুদ আলীরও। তিনি জানান, বেতনের ৭ হাজার টাকায় সংসারের খরচ মেটে না। দিনে তিন-চারবার মসজিদে এসে পরিস্কার করে চলে যান নিজের ভ্রাম্যমাণ দোকানে। আতর, টুপি, মেসওয়াক, বই বিক্রি করেন। এতে কিছু বাড়তি আয় হলেও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সংসারে স্ত্রী, বাবা-মা আর সন্তান নিয়ে বিপদে আছেন।

শিকারপুর গ্রামের জামে মসজিদের ইমাম কালি মুল্লাহ জানান, তিনি শুধু জুমার নামাজ পড়ান। বছরে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয় তাঁকে।

সম্প্রতি উপজেলার বিয়াঘাট ইউনিয়নের বিলহরীবাড়ী গ্রামের পূর্বপাড়া জামে মসজিদের ইমাম মো. রিয়াজ উদ্দিনের বাড়িতে তাঁকে দেখা গেল সংসারের কাজে ব্যস্ত। তিনি জানান, ভোরে ঘুম থেকে উঠে মসজিদে গিয়ে আজান দিয়েছেন। ফজরের নামাজ শেষে বাড়িতে গিয়ে খেজুরের গুড় ও আটার রুটি খেয়ে ১০ কেজি রসুন নিয়ে গিয়েছিলেন পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমিতে রোপণের জন্য। অল্প জমি ও আর্থিক সংকটের কারণে ১০ শতক জায়গায় নিজেই রসুন রোপণ করছেন। বাড়ি ফিরে ১০ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে আঙ্গিনার আগাছা পরিস্কার করেন। কাজ শেষে গোসল করে ভাত খেয়ে চলে যান মসজিদে।

আজান দিয়ে জোহরের নামাজ শেষে আবারও গিয়েছিলেন মাঠে। তাড়াহুড়ো করে মাঠ থেকে এসে আসরের নামাজ আদায় শেষে ক্লান্ত শরীরে বাজারে যান চাল, ডাল আর আলু কিনতে। ফিরে মাগরিব ও এশার নামাজ শেষে ঘুম। এভাবেই দিন কাটছে বলে জানান ইমাম রিয়াজ উদ্দিন। সংসারে স্ত্রী, বৃদ্ধ মা ও সন্তান রয়েছে। ইমামতি করছেন প্রায় ২৫ বছর। মুয়াজ্জিনের দায়িত্বও তাঁর। প্রতি মাসে বেতন পান ৭ হাজার টাকা।

রিয়াজ উদ্দিন বলেন, 'এখন ৭ হাজার পেলেও বছরখানেক আগে বেতন ছিল ৫ হাজার টাকা। ইমামতির পাশাপাশি বাবার রেখে যাওয়া সামান্য জমি নিজেই চাষাবাদ করি। ইমামতি আর জমির আয়ে সংসার চলছে না। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, বৃদ্ধ মায়ের চিকিৎসা, সংসার চালানোসহ অন্যান্য খরচে হাঁপিয়ে উঠেছি। কিছুদিন পর হয়তো এক বেলা খেয়ে আরেক বেলা না খেয়ে জীবন চালাতে হবে।'

জানা গেছে, মসজিদে ইমামতির পাশাপাশি অনেকে ভিন্নভাবে আয়ের চেষ্টা করেন। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাড়তি আয়ের সুযোগ কম তাঁদের। এরপরও অনেকে শিক্ষকতা, টিউশনি, ছোটখাটো ব্যবসা, কৃষিকাজ বা দিনমজুরি করে বাড়তি আয়ের চেষ্টা করছেন।

গুরুদাসপুর হাফেজিয়া মাদ্রাসার মুহতামিম রেজাউল করিম বলেন, ইমাম-মুয়াজ্জিনরা যে টাকা বেতন পান, তা দিয়ে সংসার চলে না। তাঁদের সরকারিভাবে সহযোগিতা করা প্রয়োজন।

উপজেলা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ফিল্ড সুপারভাইজার মহিদুল ইসলাম বলেন, ইমামতির পাশাপাশি মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষা কার্যক্রম থেকে ১৫৪ জন প্রতি মাসে বাড়তি ৫ হাজার টাকা পাচ্ছেন। অন্য ইমামদের এ কার্যক্রমের আওতায় আনার জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

ইউএনও শ্রাবণী রায় বলেন, করোনার সময় ইমাম-মুয়াজ্জিনদের প্রয়োজনীয় খাদ্য সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কেউ সমস্যায় থাকলে প্রশাসনকে জানালে সহযোগিতা করা হবে।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com