
আন্তর্জাতিক
চীনের পরাশক্তি স্বপ্নে পশ্চিমা বাগড়া
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২২ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রামজি বারুদ

ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলনে ১৬ নভেম্বর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সংক্ষিপ্ত ভাববিনিময়ের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সেখানে শি জিনপিং যেন জাস্টিন ট্রুডোকে কূটনীতির বয়ান দিচ্ছেন। এই ভাববিনিময়ের বিষয়কে অনেকে চীনের সঙ্গে পশ্চিমা সম্পর্কের সন্ধিক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করছেন। জাস্টিন ট্রুডোকে চীনের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, আপনার দিক থেকে যদি আন্তরিকতা থাকে, তবে আমরা পরস্পর সম্মান প্রদর্শনমূলক মনোভাবের জায়গা থেকে আলোচনা করতে পারি। তা না হলে সম্পর্ক অনিশ্চিত গন্তব্যে প্রবাহিত হতে পারে। এই অদ্ভুত আলোচনা শেষে জাস্টিন ট্রুডোকে রেখেই শি জিনপিং প্রথম হাঁটতে থাকেন। তাতে জাস্টিন ট্রুডো যেন কিছুটা অস্বস্তির মধ্যে ছিলেন।
চীনের প্রেসিডেন্ট ও কানাডার প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার এই মুহূর্তটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ এবং এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। যখন পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো চীনকে শোষণ করা শুরু করেছিল, সে সময় চীনের অর্থনীতির আকার ছিল বিশ্বের পুরো অর্থনীতির এক-তৃতীয়াংশ। ১৯৪৯ সালে যখন জাতীয়তাবাদীরা শত বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের পর চীনকে স্বাধীন করতে সক্ষম হন, তখন চীনের জিডিপি বৈশ্বিক অর্থনীতির ৪ শতাংশ ছিল। ১৮৩৯ সালের প্রথম আফিম যুদ্ধ ও চীনের স্বাধীনতার মধ্যকার ১০০ বছরের এই সময়ের পর হাজারো চীনাকে যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাবে হত্যা করা হয়, যেখানে বিদ্রোহীরা ছিল। একই সঙ্গে দুর্ভিক্ষের কারণেও অনেকে নিহত হয়। ১৮৯৯ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত তথাকথিত বক্সার বিদ্রোহ হয়। এর মাধ্যমে চীনা জনগণ স্বাধীনতা ও তাদের ভূমির সার্বভৌমত্বের জন্য ব্যবস্থা নিয়েছিল। বক্সারদের হাতে অনেক বিদেশি নিহত হয়। কিন্তু এই বক্সার বিদ্রোহের ফল ছিল ব্যাপক ধ্বংসাত্মক। কারণ বক্সার বিদ্রোহী ও চীনের সামরিক বাহিনীকে পশ্চিমা মিত্ররা ব্যাপকভাবে আক্রমণ করে। সেখানে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও অন্যরা।
সে সময় মৃত্যুর সংখ্যা এত ব্যাপক ছিল যে ধারণা করা হয়, এক লাখের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। আরও ভয়ানক ব্যাপার, এ ঘটনার দায় চীনের ঘাড়েই পড়ে। কারণ চীন এর আগে দুটি আফিম যুদ্ধসহ নানা অঘটন ঘটিয়েছিল।
১৯৪৯ সালে চীনের স্বাধীনতার মাধ্যমে বিশ্বে দেশটির অতীত শৌর্য-বীর্য কিংবা এশিয়ার ক্ষমতাধর হিসেবেও ফিরে আসার বিষয়টি সেভাবে জানান দেয়নি। পুনরায় চীনের গড়ার প্রক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত ধীরগতির। এ জন্য তাদের ব্যাপক মূল্য চুকাতে হয়েছে। এমনকি এটি ছিল ভয়ানক পথ। ট্রায়াল অ্যান্ড এরর, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, সাংস্কৃতিক বিপ্লব ইত্যাদির মধ্য দিয়ে চীনকে এগোতে হয়েছে। সাত দশক পর আমরা দেখছি চীন বৈশ্বিক বিষয়াদির কেন্দ্রে হাজির হয়েছে। এটা কারও জন্য যেমন ভালো খবর, আবার অনেকের জন্য ভয়ংকরও বটে। ২২ অক্টোবর প্রকাশিত ২০২২ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল নথিতে চীনের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে- 'একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী, যে কিনা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা বদল করতে চায়। সে জন্য দেশটির অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক ও প্রাযুক্তিক ক্ষমতা ক্রমবর্ধমান।'
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থানে বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ পশ্চিমারা চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার হিসেবে শতবর্ষ আগের অবস্থার মতো নিরূপণ করতে চায়। পশ্চিমারা চীনের এই পুনরুত্থানকে সমস্যা হিসেবেই দেখছে। এটি শুধু তার মানবাধিকার রেকর্ডের জন্যই নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে দেশটির ক্রমবর্ধমান অংশীদারির কারণেও। ২০২১ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চীনের অংশ ছিল ১৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ। কেবল অর্থনৈতিক শক্তিই নয়, বরং চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তিও মাথাব্যথার কারণ। চীনের এই দুই শক্তির কারণে শিগগিরই দেশটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যেমন রাজনৈতিক প্রভাব খাটাতে যাচ্ছে, তেমনি বিশ্বব্যাপী তার প্রভাবেরও বেশি দেরি নেই। এসবের পরও বেদনাদায়ক ব্যাপার হলো, এক সময় চীন ও এশিয়ার অধিকাংশ দেশ এবং 'গ্লোবাল সাউথ'-এর প্রভাব বিভক্ত ছিল। চীন যেহেতু পশ্চিমাদের মতো নিজস্ব ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখতে চাইছে, সেহেতু পশ্চিমা সরকারগুলো বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে দেখছে না।
অনেক বছর ধরে পশ্চিমা শক্তি চীনের মানবাধিকারের রেকর্ড নিয়ে ভন্ডামি করছে। তারা হস্তক্ষেপ করার জন্য মূলত সেখানে নৈতিকতার স্খলন দেখাতে চাইছে। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিমাদের জন্য সুবিধাজনক অস্ত্র, যার মাধ্যমে তারা বিভিন্ন দেশে হস্তক্ষেপ করে। চীনের দিক থেকে আট জাতির মৈত্র, অর্থাৎ বক্সার বিদ্রোহের সময় যারা সোচ্চার ছিল, তারা একই ধুয়া তুলে এখনও সোচ্চার। সে জন্য দেখা যাচ্ছে, তাইওয়ানের বিষয় সামনে এনে এবং চীনের উইঘুর ও অন্য সংখ্যালঘুদের অধিকার খর্বের কথা বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে।
চীনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে মানবাধিকারের বিষয়টি যেভাবে পশ্চিমারা সামনে আনছে, কিন্তু বাস্তবতা কী? আমাদের মনে আছে, ২০০৩ সালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব ইরাকে যে আক্রমণ করেছিল, তখনও তারা 'মানবাধিকার' ও 'গণতন্ত্রের' বুলি আওড়েছিল। ইরাক ছিল বিচ্ছিন্ন এবং আরব দেশগুলোর মধ্যে এক পাশে। সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযানের মাধ্যমে তারা মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করে। আজকের চীন যেহেতু পরাশক্তি হয়ে উঠছে; তারা যেহেতু বৈশ্বিক অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে দাঁড়াচ্ছে, সে জন্য দেশটির সামরিক শক্তি ও ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব পশ্চিমাদের সমস্যায় ফেলতে পারে। এ লক্ষ্যেই তারা চীনের ক্ষমতা খর্ব করতে চাইছে।
বস্তুত চীনের উত্থান এবং চীন যে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে- মার্কিন যুক্তরাষ্টের আচরণে তা স্পষ্ট। তারা যে চীনকে স্বীকার করে নিচ্ছে- সেটিও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মতবিনিময়ে প্রকাশ পাচ্ছে। তাঁদের এই সাক্ষাতের আগে ১৫ নভেম্বর ইন্দোনেশিয়াতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চীনের এই উত্থানের কথা স্বীকার করে নেন। বাইডেন বলেছিলেন, 'আমরা জোরেশোরে প্রতিযোগিতা করছি বটে, তবে আমি দ্বন্দ্বে জড়াতে আগ্রহী নই। আমি দায়িত্বশীলতার মধ্য দিয়েই প্রতিযোগিতা অব্যাহত রাখব।'
জি২০ সম্মেলনে জাস্টিন ট্রুডোর প্রতি শি জিনপিংয়ের আচরণ চীনের তথাকথিত 'নেকড়ে কূটনীতি' হিসেবে দেখা হতে পারে। তবে সেখানে শি যে ভাষা ও ব্যবহার দেখিয়েছেন, তার মাধ্যমে বস্তুত চীন কেবল বৈশ্বিক গুরুত্ব নয়; বরং পরাশক্তি হওয়ার যোগ্যতাও অর্জন করেছে।
রামজি বারুদ :সাংবাদিক ও প্যালেস্টাইন ক্রনিকলের সম্পাদক; কাউন্টার পাঞ্চ থেকে ভাষান্তরিত
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com