অধিকার

কৃষকের কারাবাস ও শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্য

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২২ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মামুনুর রশীদ

অতি সম্প্রতি বেশ আলোচিত বিষয় হিসেবে এসেছে পাবনায় ১২ জন কৃষকের ঋণখেলাপি হিসেবে কারাবাস এবং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে দ্রুতই জামিনে মুক্তি। বিষয়টি পত্রপত্রিকায় এমনভাবে এসেছে; সরকারপ্রধান বিষয়টি উপেক্ষা করতে পারেননি। এদিকে উচ্চ আদালতও দুদকের আইনজীবীকে প্রশ্ন করছেন- চুনোপুঁটিদের আপনারা ধরছেন, কিন্তু বড়দের কিছু বলছেন না! ওদিকে কারাবাস করা ১২ জনসহ মোট ৩৭ কৃষকের জামিন মঞ্জুর হওয়ার পরও তাঁদের উদ্বেগ কাটছে না। তাঁরা সবাই জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।

এই চিত্র শুধু ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে নয়। ব্যাংকগুলো নিম্নমূল্যে সুদ দিয়ে থাকে ক্ষুদ্রঋণের বেসরকারি সংস্থাগুলোকে। তারা অল্প সুদে টাকা নিয়ে কৃষক খুঁজে ব্যবসায়ী ও নারী উদোক্তাদের মধ্যে উচ্চ সুদে ঋণ বিতরণ করে থাকে। বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই ঋণের জন্য কোনো আমানত দিতে হতো না এবং উদ্দেশ্য দারিদ্র্য বিমোচন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ঋণ নারীদের দেওয়া হতো। ঋণের টাকা পেয়ে ওই নারী বাড়ি পৌঁছানোর আগেই স্বামী তাঁর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ইচ্ছামতো খরচ করে ফেলেছেন। সে অর্থ কোনো উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার না হওয়ায় ওই নারী ঋণখেলাপি হয়ে গেছেন। দেখা যেত অন্য একটি সংস্থা পুনরায় তাঁকে ঋণ দিল এবং সেই টাকাটাও নিঃশেষ হয়ে গেল। ফলে দারিদ্র্য তো কমলই না, বরং বিষয়টি এমন পর্যায়ে চলে গেল; কিছু ক্ষেত্রে ওইসব ব্যক্তি ঋণখেলাপি হয়ে ঋণ পরিশোধের চাপে এমনকি আত্মহননের পথ খুঁজে নিলেন।

বাস্তবে বহু সমীক্ষায় এটা প্রমাণিত, দরিদ্র মানুষই একমাত্র ঋণের টাকা ফেরত দেয়। কৃষকেরও ঋণের টাকা ফেরত না দেওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি কখনও অর্থ পাচার করেন না। বিলাসবহুল জীবন যাপন করেন না। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে কৃষি উৎপাদন করে দেশ ও সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখেন। অন্যদিকে ঋণ বিতরণকারী সংস্থা বা ব্যাংকগুলো বিপুল মুনাফা করে ঢাকা শহরে বহু তলবিশিষ্ট অট্টালিকা নির্মাণ করে বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করে এবং অনেক ক্ষেত্রে অর্থ পাচার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। ঋণ ব্যবস্থাটি নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার মাঝেমধ্যে নানা নির্দেশ জারি করে থাকে। কিন্তু তাতে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না।

আবার কৃষকের সমস্যা নানাবিধ। একে তো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল উৎপাদন ব্যাহত; দুই ফড়িয়া ও চাঁদাবাজদের হাতে পড়ে কোনোভাবেই তাঁর পণ্যের দাম পান না। প্রতিবছর দেখা যায়, ক্ষুব্ধ কৃষক হাটে গিয়ে পণ্য বিক্রি করতে না পেরে ফেলে দিয়ে চলে আসেন। কখনও তাঁর পণ্যে আগুন ধরিয়ে দেন। সরকার নিজে কৃষিপণ্য ক্রয় করে, কিন্তু সেখানেও কয়েক হাত পার হওয়ার পর। প্রকারান্তরে কৃষক সাধারণত নিঃস্ব হয়ে ঘরে ফেরেন। ফলে কৃষি বর্তমানে অনেক কৃষকের কাছে আদর্শ পেশা নয়।

ঢাকা শহরে ক্রমবর্ধমান হারে যেসব রিকশাচালকের আগমন ঘটছে, তাঁদের জীবনবৃত্তান্ত দেখলেই বোঝা যায়; কৃষি থেকে তাঁরা উৎখাত হয়ে একেবারেই নিজের প্রাণ ধারণের প্রয়োজনে শহরে চলে এসেছেন। এর মধ্যে আছে প্রবল বেকারত্ব। রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানা বহু আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কারখানার শ্রমিকরা কিছু টাকা-পয়সা নিয়ে গ্রামাঞ্চলে চাষাবাদ করার চেষ্টা করেছেন। টাউট-বাটপারদের পাল্লায় পড়ে তাঁরা উৎখাত হয়ে শহরে চলে আসেন।

গল্প-উপন্যাস, নাটক-সিনেমায় সৃজনশীল এবং সমাজ সচেতন লেখকরা প্রাচীনকাল থেকে কৃষকদের দুর্দশার কথা বারবার জানান দিলেও তাতে কোনো লাভ হয়নি। খাবার টেবিলে বসে কোনো বিত্তবান ব্যবসায়ী, আমলা বা সংসদ সদস্যের মধ্যে এসব ভাবনার উদ্রেক হয়নি। এটাকে স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থা বলেই তিনি মেনে নিয়েছেন। এই অখ্যাত, অজ্ঞাত কৃষককুলের দুর্দশা বেড়েই চলেছে।

উচ্চ আদালত আরেক শ্রেণির লোক পর্যবেক্ষণ করেছেন, যাঁরা বিনা শ্রমে, রাষ্ট্রের ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। সেই সঙ্গে বিচারপতি দুর্নীতির কথাও উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন- দুর্নীতি সমাজকে ধ্বংস করে দেয়। এই দুর্নীতির উৎস উন্নয়ন। কিন্তু উন্নয়ন আবার সভ্যতার এক অনস্বীকার্য অগ্রগতি। এই অগ্রগতি ছাড়া অর্থনীতির চাকা ঘোরে না; মানুষের জীবন সহজ হয় না। কিন্তু এই উন্নয়নের ফাঁকফোকর আছে। এক কিলোমিটার রাস্তা করতে গিয়ে যদি অন্য দেশের চেয়ে বহুগুণ অর্থ খরচ হয়, তাহলে উদ্বৃত্ত মূল্যটা যায় কোথায়?

এসব নিয়ে প্রচুর আলাপ-আলোচনা হলেও অনালোচিত থেকে যায় বাংলার হতভাগ্য কৃষকদের কথা। কোন আদিকালে সংখ্যা গণনার অতীত প্রত্যুষে কৃষকের জন্ম হয়েছিল মানুষকে উৎপাদনের মাধ্যমে সভ্যতাকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনে। একদা কৃষক ও ভূমিমালিক অভিন্ন ছিল। সে সময়কার উৎপাদন ব্যবস্থার কথা আমরা কতটাই বা জানি? কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর থেকে আমরা কৃষকের উৎপাদন ও শোষণের ইতিহাস জানতে শুরু করেছি এবং তা নিয়ে অর্থনীতির নানা দলিল তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পেছনেও কৃষকের বঞ্চনা এবং মুক্তির উপায়ের কথা বলা হয়েছিল। সে সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় কৃষক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতো। প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই কৃষক সংগঠন অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। কৃষকের শক্তি রাজনৈতিক দলগুলো অনুভব করত এবং সেইভাবে তাদের দাবি-দাওয়া অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে শোনা হতো। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের কথা, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ক্ষমতাসীন দলগুলো এবং খোদ কমিউনিস্ট পার্টি কৃষকদের বিষয়গুলোকে কোনো গুরুত্বই দেয়নি। সব দলেরই কৃষক সংগঠন অবলুপ্তির পথে। তাদের কণ্ঠস্বর হয়ে গেছে ক্ষীয়মাণ।

আজকের দিনে বিশেষ করে পাবনার কৃষকদের এই সংকট মুহূর্তে সংবাদমাধ্যম ছাড়া কেউ তাঁদের পাশে এসে দাঁড়াননি। প্রশাসন এবং নীতিনির্ধারকরা কেউ এগিয়ে আসেননি। প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসার পর তিনি দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে একটা সুরাহা করেছেন। কৃষকরা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন কিন্তু ঋণের জাল থেকে কি মুক্তি পেয়েছেন? প্রধানমন্ত্রী ঋণের টাকা মওকুফও করে দিতে পারতেন। কিন্তু তাতে কি সুদূরপ্রসারী সমস্যার সমাধান হবে? দেশে কত ধরনের অর্থনীতিবিদ আছেন, কৃষিবিদ আছেন এবং কৃষি থেকে উঠে আসা দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের আমলা, সংসদ সদস্য আছেন। তাঁরা কি বিষয়টি নিয়ে কোনো স্থায়ী সমাধানের কথা ভেবেছেন?

দেশে একটি শেয়ার মার্কেট আছে। অতীতে এবং বর্তমানে সেখানে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেনে বহু লোক সর্বস্বান্ত হয়েছেন এবং বহু অসাধু, দুর্নীতিপরায়ণ বিত্তবানের জন্ম হয়েছে। এসব বিত্তবানের হাজার হাজার কোটি টাকা হয় পাচার, না হয় বিভিন্ন ব্যাংকে নানাভাবে সঞ্চিত। তার একটা অংশ দিয়েই শহরগুলোতে বিত্তবান মানুষের সুরম্য অট্টালিকা গড়ে উঠছে এবং কোটি টাকার ওপরে বিলাসবহুল গাড়ি চলছে। কৃষি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে দক্ষ মানুষের কী হবে? এ ভাবনা কি কোনো বাস্তব রূপ পাচ্ছে? যেসব দেশে রূপ পেয়েছে, সেখানে একটা বিবেচনা করার মতো উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন এবং সুষম অর্থনীতি গড়ে উঠেছে।

বর্তমানকালে আমরা অবশ্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোয় অর্থনৈতিক দুর্দশা এবং দ্রুত উত্থান-পতন দেখতে পাচ্ছি। সেই সঙ্গে যে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো পুঁজিবাদের দিকে ধাবিত হয়েছে, তার অন্তঃসারশূন্যতাও দেখতে পাচ্ছি। এর মধ্য দিয়ে ১৬ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ১২ বা ৩৭ জন কৃষকের দুর্দশার চিত্র পত্রপত্রিকায় প্রকট হয়েছে। কিন্তু বাকি শত, সহস্র, অযুত, নিযুত কৃষকের কথা, শ্রমিকের কথা একটা বড় রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে আমরা কি এখনও দেখব না? 

মামুনুর রশীদ :নাট্যব্যক্তিত্ব

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com