
ভারসাম্যহীনতা
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২২ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সম্পাদকীয়
বিশেষত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা স্বীয় হস্তে আনয়নের লক্ষ্যে সরকার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসি আইন সংশোধন করিবার যে উদ্যোগ গ্রহণ করিয়াছে, উহাতে প্রশ্ন তুলিবার যথেষ্ট অবকাশ রহিয়াছে। সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে প্রস্তাবটা চূড়ান্ত অনুমোদন পাইবার পর এখন রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে প্রজ্ঞাপন জারি হইলেই সরকার ইচ্ছামাফিক বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ করিতে পারিবে। প্রশ্ন হইতেছে, তাহা হইলে 'চেক অ্যান্ড ব্যালান্স' রক্ষা হইবে কীভাবে? নূতন ব্যবস্থায় জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির জন্য যদি জবাবদিহির ব্যবস্থা না থাকে, তাহা হইলে ভ্রম শোধরানো হইবে কী প্রকারে? বিদ্যমান আইনে উক্ত ক্ষমতা শুধু বিইআরসির হস্তে ন্যস্ত থাকিবার কারণে দ্বিতীয় চিন্তা করিবার সুযোগ ছিল খোদ সরকারের।
বিদ্যমান আইনে জ্বালানি মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে কমিশনকে একটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করিতে হইত। যেমন- সরকারের সংশ্নিষ্ট পরিষেবা সংস্থা বিদ্যুৎ বা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রথমেই একটা খসড়া প্রস্তাব উপযুক্ত যুক্তি সহকারে বিইআরসির নিকট পেশ করে। প্রস্তাবটা যাচাই-বাছাই করিয়া বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি গণশুনানির নিমিত্তে আরেকটা প্রস্তাব প্রস্তুত করে। উহার উপর ভোক্তাদের প্রতিনিধিসহ সকল অংশীজন প্রকাশ্য সভায় মতামত প্রকাশ করেন। উক্ত গণশুনানির ভিত্তিতে কমিশন একটা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। অধিকাংশ সময় সেই সিদ্ধান্ত সংশ্নিষ্ট পরিষেবা সংস্থার পক্ষে গিয়া থাকিলেও কখনোই মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ ঐ সংস্থার প্রত্যাশামাফিক হয়নি। আবার কদাচ কমিশন মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নাকচও করিয়া দেয়। শুধু তাহাই নহে, বিদ্যমান আইন অনুসারে, কমিশন এক বৎসরের কম সময়ের মধ্যে দ্বিতীয়বার কোনো পরিষেবার মূল্যবৃদ্ধি করিতে পারে না এবং অন্যথা হইলে ভোক্তারা প্রতিকারের প্রত্যাশায় আদালতের দ্বারস্থ হইতে পারেন। কিন্তু উক্ত অধ্যাদেশ কার্যকর হইলে জরুরি জনস্বার্থসংশ্নিষ্ট একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার লেশমাত্র থাকিবে না।
স্বীকার করিতে হইবে- বিদ্যমান আইন অনুসারেও সকল ধরনের জ্বালানি তেলের মূল্যনির্ধারণের ক্ষমতা বিইআরসির হস্তেই থাকিবার কথা। কিন্তু সরকারের জ্বালানি বিভাগ কতিপয় খোঁড়া যুক্তি প্রদর্শন করিয়া বরাবরই উহা স্বীয় হস্তে রাখিয়া দিয়াছে। ঐ ক্ষমতাবলে তাহারা নূ্যনতম স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ধার না ধারিয়া ইচ্ছামাফিক জনগণের নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করিয়া থাকে। তবে সরকারের এই স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে ধীরে হইলেও জনমত গড়িয়া উঠিতেছিল। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অনেকেই বিদ্যুৎ-গ্যাসের মতো জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতাও বিইআরসির হস্তে ন্যস্ত করিবার দাবি জানাইতেছিলেন। কিন্তু হতাশাজনকভাবে, সরকার সেই দাবির প্রতি কর্ণপাত করিবার পরিবর্তে বিইআরসির অবশিষ্ট ক্ষমতাটুকুও কাড়িয়া লইতে চাহিতেছে। আরও লক্ষণীয়, আইনটা সংশোধনেও সরকার একভাবে জবাবদিহি এড়াইবার চেষ্টা করিতেছে। ইহাও অনস্বীকার্য, জাতীয় সংসদে এখন অধিবেশন চলিতেছে না। তাই সরকারকে অধ্যাদেশের পথে হাঁটিতে হইয়াছে। কিন্তু সংসদের পরবর্তী অধিবেশনের জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করিতে হইবে- বিষয়টা এমনও নহে। এইরূপ ধারণা অমূলক নহে, চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার স্বার্থে সরকারকে যত দ্রুত সম্ভব আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করিতে হইবে। সেই পথ মসৃণ করিবার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী সংস্থার চাহিদানুসারে যে কোনো সময় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করিতে হইবে। সেই লক্ষ্যেই সরকার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা বিইআরসির নিকট হইতে তড়িঘড়ি কাড়িয়া লইবার পথ ধরিয়াছে।
আমরা জানি, সরকারি প্রতিষ্ঠান হইলেও বিইআরসি আইনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে একটা নূ্যনতম ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু আলোচ্য সংশোধনীর ফলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পরিষেবা বিক্রেতা সরকার নিজেই সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবে; ভোক্তা হিসাবে জনগণের বলিবার কোনো সুযোগ থাকিবে না। ইহার মাধ্যমে সরকার এক যুগের অধিক সময়ের চেষ্টায় গড়িয়া ওঠা একটা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে হীনবলই করিবে না শুধু; গণতন্ত্রান্ত্রিক ব্যবস্থাও দুর্বল হইতে দুর্বলতর হইবে। আর শাসনব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের যে প্রত্যাশা সমকালসহ বিভিন্ন পক্ষ হইতে পুনঃপুনঃ উচ্চারিত হইতেছে, উহা মুক্তির মন্দির সোপানতলে মস্তক কুটিয়া মরিতে থাকিবে। সকল দিক বিবেচনা করিয়া বিইআরসি আইনের সংশোধনীর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনাই সংগত।
বিদ্যমান আইনে জ্বালানি মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে কমিশনকে একটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করিতে হইত। যেমন- সরকারের সংশ্নিষ্ট পরিষেবা সংস্থা বিদ্যুৎ বা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রথমেই একটা খসড়া প্রস্তাব উপযুক্ত যুক্তি সহকারে বিইআরসির নিকট পেশ করে। প্রস্তাবটা যাচাই-বাছাই করিয়া বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি গণশুনানির নিমিত্তে আরেকটা প্রস্তাব প্রস্তুত করে। উহার উপর ভোক্তাদের প্রতিনিধিসহ সকল অংশীজন প্রকাশ্য সভায় মতামত প্রকাশ করেন। উক্ত গণশুনানির ভিত্তিতে কমিশন একটা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। অধিকাংশ সময় সেই সিদ্ধান্ত সংশ্নিষ্ট পরিষেবা সংস্থার পক্ষে গিয়া থাকিলেও কখনোই মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ ঐ সংস্থার প্রত্যাশামাফিক হয়নি। আবার কদাচ কমিশন মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নাকচও করিয়া দেয়। শুধু তাহাই নহে, বিদ্যমান আইন অনুসারে, কমিশন এক বৎসরের কম সময়ের মধ্যে দ্বিতীয়বার কোনো পরিষেবার মূল্যবৃদ্ধি করিতে পারে না এবং অন্যথা হইলে ভোক্তারা প্রতিকারের প্রত্যাশায় আদালতের দ্বারস্থ হইতে পারেন। কিন্তু উক্ত অধ্যাদেশ কার্যকর হইলে জরুরি জনস্বার্থসংশ্নিষ্ট একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার লেশমাত্র থাকিবে না।
স্বীকার করিতে হইবে- বিদ্যমান আইন অনুসারেও সকল ধরনের জ্বালানি তেলের মূল্যনির্ধারণের ক্ষমতা বিইআরসির হস্তেই থাকিবার কথা। কিন্তু সরকারের জ্বালানি বিভাগ কতিপয় খোঁড়া যুক্তি প্রদর্শন করিয়া বরাবরই উহা স্বীয় হস্তে রাখিয়া দিয়াছে। ঐ ক্ষমতাবলে তাহারা নূ্যনতম স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ধার না ধারিয়া ইচ্ছামাফিক জনগণের নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করিয়া থাকে। তবে সরকারের এই স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে ধীরে হইলেও জনমত গড়িয়া উঠিতেছিল। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অনেকেই বিদ্যুৎ-গ্যাসের মতো জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতাও বিইআরসির হস্তে ন্যস্ত করিবার দাবি জানাইতেছিলেন। কিন্তু হতাশাজনকভাবে, সরকার সেই দাবির প্রতি কর্ণপাত করিবার পরিবর্তে বিইআরসির অবশিষ্ট ক্ষমতাটুকুও কাড়িয়া লইতে চাহিতেছে। আরও লক্ষণীয়, আইনটা সংশোধনেও সরকার একভাবে জবাবদিহি এড়াইবার চেষ্টা করিতেছে। ইহাও অনস্বীকার্য, জাতীয় সংসদে এখন অধিবেশন চলিতেছে না। তাই সরকারকে অধ্যাদেশের পথে হাঁটিতে হইয়াছে। কিন্তু সংসদের পরবর্তী অধিবেশনের জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করিতে হইবে- বিষয়টা এমনও নহে। এইরূপ ধারণা অমূলক নহে, চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার স্বার্থে সরকারকে যত দ্রুত সম্ভব আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করিতে হইবে। সেই পথ মসৃণ করিবার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী সংস্থার চাহিদানুসারে যে কোনো সময় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করিতে হইবে। সেই লক্ষ্যেই সরকার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা বিইআরসির নিকট হইতে তড়িঘড়ি কাড়িয়া লইবার পথ ধরিয়াছে।
আমরা জানি, সরকারি প্রতিষ্ঠান হইলেও বিইআরসি আইনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে একটা নূ্যনতম ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু আলোচ্য সংশোধনীর ফলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পরিষেবা বিক্রেতা সরকার নিজেই সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবে; ভোক্তা হিসাবে জনগণের বলিবার কোনো সুযোগ থাকিবে না। ইহার মাধ্যমে সরকার এক যুগের অধিক সময়ের চেষ্টায় গড়িয়া ওঠা একটা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে হীনবলই করিবে না শুধু; গণতন্ত্রান্ত্রিক ব্যবস্থাও দুর্বল হইতে দুর্বলতর হইবে। আর শাসনব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের যে প্রত্যাশা সমকালসহ বিভিন্ন পক্ষ হইতে পুনঃপুনঃ উচ্চারিত হইতেছে, উহা মুক্তির মন্দির সোপানতলে মস্তক কুটিয়া মরিতে থাকিবে। সকল দিক বিবেচনা করিয়া বিইআরসি আইনের সংশোধনীর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনাই সংগত।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com