প্রচ্ছদ

মাঠ-শিয়রের নদী

প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২২ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আবু সাঈদ জুবেরী

কাজে না হোক, মুখে অন্তত এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের নদীপ্রীতি আছে। এই প্রীতিবোধ থেকেই বোধ হয় আমরা হারিয়ে যাওয়া নদীর জন্য হাহাকার করি। সাড়ে সাতশ' নাকি ছিল একসময়! এখন কয়টি বেঁচেবর্তে আছে, সঠিক জানি না। কারণ, এ বিষয়ক সঠিক তথ্য কোথাও মেলে না। ফলে 'মতান্তরে' শব্দটি বারংবার ব্যবহূত হয়। মূল সমস্যা হচ্ছে নদী ও উপনদী তথা শাখা নদী নিয়ে; একই নদী বাঁক বদলে ভিন্ন নাম নিয়ে আবির্ভূত হয়, অপরদিকে আছে নামের বিভ্রাট। কবি যে নদীকে বলেন কুরুলিয়া, পুস্তকে তা এখনও কুলকুলিয়া। মরমি কবি হাছন রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র দেওয়ান গণিউর রাজা তাঁর ডায়েরিতে যে নদীকে বলেন পৈন্দা, মানচিত্রে এখন সেই নদীর অস্তিত্বই নেই।

অবহেলা ও অবজ্ঞার কারণে নদী হারিয়ে যায় এ দেশ থেকে, কিন্তু মানুষের হাড়ের খাঁচায় ছয়টি নদী (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য) ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়। এই ছয় খরস্রোতা নদীর দাপটে আমরা হারাই সামাজিক মূল্যবোধ, ন্যায়নীতি- সব।

ক্ষীণ গলায় শুধু বলি, আমার একটা নদী ছিল। এই হারানো নদী সুদূরের, স্মৃতির, ভালোবাসারও। হাড়ের খাঁচায় প্রবহমান ছয় নদীর সঙ্গে প্রেমজ নদীর কোনো মিল থাকে না। জাগতিক-নদী লোভের শিকার হয়; নদী ছোট করে ফেলার স্বপ্ন দেখেন দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিবর্গ; সেখানে হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট বানানোর পরিকল্পনার কথা বলেন দর্পিত ক্ষমতাসীনরা। হাওরে ফ্লাইওভার নির্মাণের অদ্ভুতুড়ে ইচ্ছা প্রকাশ করেন কোনো কোনো মন্ত্রী। এসবই এই দেশের বাস্তব চিত্র এখন।

তারপরও বলি, আমারও একটা নদী ছিল এবং এখনও সে আছে; তবে বাংলাদেশের সব নদীর মতো সেও বার্ধক্যে উপনীত। বাহুল্য বলা যে, নদীকে পূর্ণতার ধাপ অনুসারে 'যৌবন', 'পরিণত' এবং বার্ধক্য- এ তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়ে থাকে। বার্ধক্য অবস্থায় নদী-ভিত্তি সমতলে উপনীত হয় এবং প্রশস্ত-সমতল-অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ নদনদীই বার্ধক্য পর্যায়ে পৌঁছে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।



মাঠ ও নদী

বালকবেলায় যে বিস্তীর্ণ মাঠ দেখেছিলাম, তার শিয়রেই ছিল আমার নদী। সেই মাঠটিকে আমরা বলতাম, 'বন্দো'। সেটি ছিল মূলত গোচারণভূমি। বিকেলবেলা সেখানে আমরা ফুটবল খেলতে যেতাম। রাখালরা তখন আসত গৃহপালিত প্রাণীগুলো ঘরে ফিরিয়ে নিতে। আমার নদীটি তখনও ভাঙনপ্রবণ ছিল না। মধ্যরাতে অকস্মাৎ জলের জোয়ার এসে ভাঙেনি কোনো ঘর।

নদীর সিকস্তি কোনো গ্রামাঞ্চলে মধ্যরাতে কেউ

যেমন শুনতে পেলে অকস্মাৎ জলের জোয়ার,

হাতড়ে তালাশ করে সঙ্গিনীকে, আছে কি-না সেও

যে নারী উন্মুক্ত করে তার ধন-ধান্যের দুয়ার।



তবে নদীটি ছিল বিতর্কিত; তার নামের জন্য, তার উৎপত্তি বা জন্মস্থানের জন্য। গ্রামের বিডি-মেম্বার এখলাস মিয়া বলত, পুঙ্গা বেটি। মানে জারজ-কন্যা।

আমরা ক্ষিপ্ত হতাম। পাঠ্যবইয়ের লেখাটা বারংবার পড়তাম- 'আমার নাম সুরমা। তাই বলিয়া আমি চোখে দেওয়ার সুরমা নই। আসামের লুসাই পাহাড় থেকে আমার উৎপত্তি।' বহুকাল পরে জানলাম, তথ্য সত্য নয়। সিলেট জেলার অমলশিদে বাংলাদেশ সীমান্তে বরাক নদী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে এ দেশে প্রবেশ করেছে। জনশ্রুতি বা দন্তি আছে যে, কামরূপ-কামাখ্যার রানী সুরম্যা জনসাধারণের সুপেয় পানির জন্য একটি বৃহদাকার খাল খনন করেছিলেন; পরবর্তী সময়ে সেই খাল নদীতে রূপান্তরিত হয়। সুরম্যা রানীর নামে তাই সুরমা নদী।

কিংবদন্তি ইতিহাস নয়, জোর গলায় সে কারণে এই তথ্যই সত্য, এ কথা বলা যায় না। তবে সুরমা সিলেট অববাহিকার উত্তরে প্রবাহিত হয়ে খাসিয়া ও জৈন্তা পাহাড় থেকে আগত একাধিক উপনদী গ্রহণ করেছে। উল্লেখ্য যে, বৃহত্তর সিলেটে নদীর সংখ্যা ৩৭। হাছন রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্রের উল্লেখ করা পৈন্দা নদীও তার অন্তর্ভুক্ত; যদিও বাস্তবে তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া ভার।

তখন যৌবন যার

তখন ছিল 'এখন', তাই যুদ্ধে যাওয়ার সময় ছিল; পূর্ণ যৌবনা ছিল সুরমার। ইঞ্জিনচালিত জলযান বলতে ছিল লঞ্চ। শুশুক বা ডলফিনে ভরপুর ছিল নদী। ছাতক থেকে লঞ্চে সুরমায় যেতে যেতে চোখে পড়ত ডলফিনের অপরূপ নৃত্যের দৃশ্যাবলি। অসংখ্য ঘাট ও গঞ্জে ছিল মানুষের কোলাহল। এসব আজ নেই। শীর্ণকায় নদীর বুকে এখন বালুর ঝিকমিক। শুস্ক মৌসুমে কোথাও কোথাও সুরমাকে আর নদী বলে চেনা যায় না, মনে হয় খার। বিস্তীর্ণ চরে চোখধাঁধানো মরীচিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে বাধ্য করে।



সেই মাঠ

যে বিস্তীর্ণ মাঠের শিয়রে ছিল সুরমা, সেই মাঠের সবুজ আর নেই। রোদে পোড়া তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে। আমাদের অনেক পাখি যে মাঠে ওড়াউড়ি করত, এখন সেই মাঠে ইটভাটা গড়ে তোলার পরিকল্পনা চলছে; হয়তো হয়েও যাবে অদূর ভবিষ্যতে।

একদা একটি পাখি মনের আনন্দে উড়ে যেতে

গিয়ে অকস্মাৎ তীরবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়লো

সুরমা নামক এক তটিনীর পাশে ধান ক্ষেতে,

তার নম্র বক্ষ হতে অবিশ্রান্ত রুধির ঝরলো।

সেই মাঠে পড়ে আছে আমার শৈশব ও বালকবেলা; পড়ে আছে নাম জানা ও না জানা সঙ্গীসাথির রুধির মুখ। ফুরদ্দি না ফেরার দেশে চলে গেছে, মোশাহেদ সুরমা নদীর মতোই এখন বার্ধক্যে উপনীত; মনসুর কয়েক দাগ অ্যাটাকের পর হূৎপিণ্ড বাঁচাতে ব্যস্ত।

মাঠ ও নদী এ দেশের নারীর মতোই চিরকাল অবহেলিত ও অবজ্ঞার প্রাণ; বেঁচে থাকার জন্য তাদের লড়াই আজন্ম তাই সঙ্গী। আমরা যেন শুধু শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলি।

মাদ মোয়াজেল, পথিক জীবন ডাকে,
প্রাণের জোয়ারে মিটাও তৃষ্ণা সাধ,
নারী ও পৃথিবী ঝড়ের মেঘের ফাঁকে
নীল গগনের শর্বরী বোবা চাঁদ।

আমাদের পৃথিবী কি আসলেই 'বোবা চাঁদ' হয়ে গেছে? নদীর ওপর যত্রতত্র বাঁধ দেওয়ার সময় আমরা কি কখনও চিন্তা করি, এতে তার মৃত্যু ঘটতে পারে? মাঠ দখলের আগে কি কখনও ভাবি, অফুরন্ত অক্সিজেনের ওড়াউড়ির জন্য দরকার প্রকৃতিজ স্পেস? বালকদের শরীর চর্চার জন্যও প্রয়োজন মাঠ ও দিগন্ত।

আজ থেকে তিন দশক আগে ব্রিটিশ গবেষক জন হামফ্রে বলেছিলেন, 'যে দেশের শত শত নদী আছে, সে দেশে অভাব থাকার কথা নয়।' শুধু ফিশ-ব্যাংক তৈরি করেই আমরা হতে পারতাম পৃথিবীর অন্যতম ধনী রাষ্ট্র। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, এখন অনেক নদীর মাছই পাতে তোলা যায় না। দূষণ-দখলে একে একে মরতে বসেছে বহু নদী। কার নজর সেদিকে?

বেশির ভাগ মানুষ বাণিজ্য-চিন্তায় মগ্ন এখন। প্রকৃতির অফুরন্ত দান প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে বারবার। এই অকৃপণ দানকে আমরা অবহেলা করেছি নিয়ত।

দূষণ-দখলে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল ইউরোপের অনেক নদী, বিশেষ করে শিল্পবিপ্লবের পর। কিন্তু সময়োচিত উপলব্ধির কারণে আবার ফিরে এসেছে স্বমহিমায়, স্বরূপে। এখানে অন্তত দুটি নদীর কথা বলা যেতে পারে- রাইন ও টেমস।

রাইন নদী সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত হওয়ার পর জার্মানিতে সেদিন স্মরণযোগ্য উৎসব হয়েছিল। টেমস নিয়ে ব্রিটিশরা এখন গর্ব করে, অথচ একদিন কোলরিজ থেকে শুরু করে বহু কবির কণ্ঠে আক্ষেপ উচ্চারিত হয়েছে টেমসের শীর্ণ দশায়। বুড়িগঙ্গা নিয়ে কি আমাদের কোনো স্মরণযোগ্য কবিতা আছে?

আমাদের জলাধার

বাংলাদেশের সমস্ত নদনদী, ক্ষুদ্র জলস্রোত ইত্যাদির মিলিত দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪ হাজার ১৪০ কিমি। যদিও সাড়ে সাতশ' কিংবা সাতশ' নদীর কথা বলা হয়ে থাকে, কিন্তু হিসাবে কার্যত ৫৯৬টি নদীর অস্তিত্ব মেলে। সবচেয়ে বেশি নদী সুন্দরবন অঞ্চলে, ১৭৭টি। সবচেয়ে কম নদী রয়েছে কুষ্টিয়া জেলায়, মাত্র চারটি। বৃহত্তর সিলেটে নদীর সংখ্যা ৩৭। পৃথিবীর কোথাও বাংলাদেশের মতো নদী-জালিকা নেই, যা রয়েছে সুন্দরবন অঞ্চলে।

এ দেশে বেশির ভাগ নদীই নারী, যারা নর তারা 'নদ' নামে পরিচিত। নামেও রয়েছে অসাধারণত্ব- যমুনেশ্বরী, পুনর্ভবা, গর্ভেশ্বরী, মহানন্দা, সুরমা, গোমতী, কর্ণফুলী, চিত্রা, চন্দনা, শ্রীমা, মধুমতী, সুগন্ধা, কালীগঙ্গা, সন্ধ্যা, মেঘনা, যমুনা, তিস্তা, বিজলি, ঘুঙুর, কল্যাণী। এ রকম আরও বহু নদীর নাম বলা যায়।



ফিরে কি আসবে আবার?

তারপরও বিশ্বাস করি, সময়ের প্রয়োজনে আবার ফিরে আসবে নদীর স্বতঃস্ম্ফূর্ত উপস্থিতি। বিশ্বের মোড়লরা আজ যেমন উষ্ণায়ন নিয়ে ভাবছেন, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরাও একদিন এ দেশের অফুরন্ত সম্ভাবনার জলাধার নিয়ে উন্নত পরিকল্পনা নেবেন।

মৃতপ্রায় নদীগুলো পুনর্খনন হবে, নদীতে বর্জ্য ফেলার বাহাদুরি বন্ধ হবে; নদীগুলো হয়ে উঠবে মৎস্য ও জলজ প্রাণীর আধার।

সেদিন হয়তো আমরা থাকব না, কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে। নদীর জীবন নিয়ে একদা আমরাও ভেবেছিলাম।

মাঠ-শিয়রের নদী ফিরে আসবে তার স্বমহিমায়, সবুজ গালিচায় পূর্ণতা পাবে মাঠগুলো; দুরন্ত বালক-বালিকা সেখানে মত্ত হবে নান্দনিক ক্রীড়ায়।

লেখায় ব্যবহূত কবিতাসমূহের মধ্যে প্রথম কবিতাটি কবি আল মাহমুদের, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পঙ্‌ক্তিমালা কবি দিলওয়ারের।

এই লেখা উদ্ৃব্দত নদী সম্পর্কিত তথ্যাবলি আহরিত হয়েছে 'বাংলাদেশের নদীমালা' (আবদুল ওয়াজেদ প্রণীত) এবং বাংলাপিডিয়া (ষষ্ঠ খণ্ড) থেকে।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com