পরিবহন ধর্মঘটে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে খেটে খাওয়া মানুষ

রাজশাহীতে বিএনপির গণসমাবেশ কাল

প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২২ । ০১:২৬ | প্রিন্ট সংস্করণ

সমকাল ডেস্ক

রাজশাহীতে বিএনপির সমাবেশ ঘিরে ধর্মঘট ডাকায় উত্তরাঞ্চলের যাত্রীদের ভোগান্তি চরমে। বগুড়া বাস টার্মিনাল থেকে বৃহস্পতিবার তোলা -সমকাল

কৃষি শ্রমিক জাহিদ হাসানের বাড়ি গাইবান্ধার ফুলছড়িতে। ধান কাটার কাজে ১৪ জনের একটি দল নিয়ে তিনি এসেছিলেন বগুড়ার কাহালু উপজেলার বিবিরপুকুর এলাকায়। প্রায় দুই সপ্তাহ কাজ শেষে বৃহস্পতিবার বাড়িতে ফেরার জন্য বগুড়া বাস টার্মিনাল এলাকায় এসে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও কোনো বাস পাননি। দৃশ্যত বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সমাবেশ ঠেকাতে ডাকা এ পরিবহন ধর্মঘটে তাঁরা দুর্ভোগে পড়েন। শেষে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় রওনা দেন তাঁরা।

জাহিদ বলেন, 'বাসে বাড়িতে যেতে ভাড়া লাগত ৬০ টাকা। এখন সিএনজিচালিত অটোরিকশায় লাগবে ১৭০ টাকা। আমাদের মতো দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের জন্য বাড়তি ভাড়া গোনা আসলে দুই বেলা না খেয়ে থাকার সমান।'

সকালে রাজশাহীর ফায়ার সার্ভিস মোড়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা থেকে শীতল পাটি হাতে বিএনপির সমাবেশস্থল নগরীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা মাঠের দিকে যাচ্ছিলেন ৪৫ বছর বয়সী আব্দুস সাত্তার মিয়া। শনিবারের গণসমাবেশে যোগ দিতে বগুড়ার সোনাতলা থেকে আগেভাগেই এসেছেন রাজশাহীতে। অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘটের কারণে বাস চলাচল বন্ধ থাকায় দু'দিন আগেই চলে এসেছেন তিনি।

সমাবেশস্থল সংলগ্ন ঈদগাহ মাঠ ও এর আশপাশে গতকাল সাত্তার মিয়ার মতো এমন আরও অসংখ্য বিএনপি কর্মীকে চোখে পড়েছে। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে তিন দিন আগে থেকেই বিএনপি নেতাকর্মী বিভিন্ন জেলা থেকে আসা শুরু করেছেন। কেউ হাতে বিছানা, কেউ কাঁথা, কেউ বালিশ নিয়ে এসেছেন বিভিন্ন জেলা থেকে। সমাবেশস্থলের পাশে রাজশাহী ঈদগাহ মাঠে তাঁবু পেতে ত্রিপল বিছিয়ে অবস্থান করছেন কয়েক হাজার নেতাকর্মী। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে মাঠ প্রস্তুতের অনুমতি পেয়েছে বিএনপি। শুরু হয়েছে মঞ্চ তৈরির কার্যক্রম।

আগামীকাল শনিবার রাজশাহীতে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ। এটাই আপাতত ঢাকার বাইরে বিএনপির শেষ সমাবেশ। তাই এখানে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি লোকসমাগম করতে চায় বিএনপি। তবে বৃহস্পতিবার ভোর থেকে রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় শুরু হয়েছে পরিবহন ধর্মঘট। এ কারণে গন্তব্যে পৌঁছাতে বিএনপি নেতাকর্মীর পাশাপাশি সাধারণ যাত্রীদেরও নিদারুণ দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে পুলিশের তল্লাশি ও গ্রেপ্তার চলছে। এসব ভোগান্তি উপেক্ষা করেই বুধবার রাত থেকেই হাজার হাজার নেতাকর্মী এসেছেন রাজশাহীতে।

রাজশাহীর শিরোইল বাস টার্মিনালে কথা হয় ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'বিকেলে আমার পরীক্ষা আছে। আগে ধর্মঘটের বিষয়টি জানতাম না। এখন আমি ঢাকায় গিয়ে পরীক্ষায় কীভাবে অংশ নেব বুঝতে পারছি না।' পরে তিনি রেলস্টেশনের দিকে ছুটতে থাকেন।

অন্যদিকে, বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন, পথে পথে গাড়িতে তল্লাশি করছে পুলিশ। রাস্তায় গাড়ি আটকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। ঈদগাহ মাঠে দেখা যায় হাজার হাজার নেতাকর্মী উপস্থিত। অনেকগুলো তাঁবু পেতে তাঁরা সেখানে অবস্থান করছেন। অনেকে বিছানা পেতে, ঘাসের ওপর শুয়ে-বসে সময় কাটাচ্ছেন। কেউ খিচুড়ি রান্না করে নেতাকর্মীদের মাঝে সরবরাহ করছেন।

এখানে পাবনা-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সিরাজুল ইসলাম সরদার অভিযোগ করেন, ঈদগাহ মাঠে তাঁবু তৈরি করার পর পুলিশ এসে ভেঙে দিয়েছে। রান্নার চুলায় পানি ঢেলে দিয়েছে। ড্রামে করে খাবার পানি আনার সময় পুলিশ পানির ড্রাম আটকে রেখেছে। পদে পদে আমাদের নেতাকর্মীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।'

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থেকে আসা যুবদল কর্মী আল আমিন হোসেন বলেন, 'এলাকায় পুলিশের অত্যাচারে থাকতে পারছি না, সেজন্য তিন দিন আগেই চলে এসেছি। আমরা এই সরকারের পতন দেখতে চাই, সেজন্য এসেছি। সারাদেশের মানুষ নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমূল্যের কারণে হাঁসফাঁস করছে। সরকার ও সরকার দলের খুন, গুম, হত্যার মতো নানা অমানবিক কার্যক্রমে দেশবাসী অতিষ্ঠ। আমরা এর প্রতিকার চাই। সেজন্য সব ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত আছি।'

বুধবার রাতে বগুড়া থেকে বাসে আসছিলেন বগুড়ার একটি ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবু হাই সিদ্দিক রনি। তিনি বলেন, প্রথমে নাটোরে বাধা দেওয়া হয়। পরে বানেশ্বরে বাস এলে আটকে দেয় পুলিশ। প্রায় ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় বাসের। পরে বানেশ্বর থেকে ২২ কিলোমিটার পথ হেঁটে আমরা রাতেই মাদ্রাসা মাঠে চলে এসেছি। বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ থেকেও অনেকে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত হেঁটে এসেছেন বলে জানান।

বগুড়া-৪ আসনের বিএনপিদলীয় সাংসদ মোশারফ হোসেন জানান, তাঁর নির্বাচনী এলাকা বগুড়ার কাহালু ও নন্দীগ্রামের বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে করা ককটেল হামলার মামলার ঢাকা উচ্চ আদালত থেকে ৬৬ জন জামিন নেন বৃহস্পতিবার। জামিন নিয়ে বগুড়া ফেরার পথে ২৭ নেতাকর্মীকে শাহবাগ থানা পুলিশ আটক করে। পরে তাঁদের ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে চালান দেয় আদালতে।

গতকাল বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, প্রতিটি এলাকায় বাসে তল্লাশি ও নিপীড়ন করা হচ্ছে। পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে নেতাকর্মীকে আসতে দিচ্ছে না। আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। তবে এত বাধার মাঝেও বুধবার রাতেই লক্ষাধিক লোক আসছে। অনেকেই আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে উঠেছেন। নেতাকর্মীর কষ্ট হলেও আমাদের গণসমাবেশ সফল হবে।

বাস শ্রমিকদের দুর্ভোগ :বগুড়া থেকে প্রতিদিন ৩৬টি জেলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ বাস চলাচল করে থাকে। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে সব রুটের বাস বন্ধ আছে। এতে অর্থকষ্টে পড়েছেন বাস শ্রমিকরা। বগুড়া-ঢাকা রুটের বাসচালকের সহকারীর কাজ করেন সেলিম মিয়া। তিনি জানান, বাস মালিকরা বলেছেন বাস বন্ধ। কেন বন্ধ সে বিষয়ে মালিকরা বলেছেন, বিএনপির সমাবেশের জন্য বাস বন্ধ থাকবে। নওগাঁ-সাপাহার রুটে চলা নওগাঁ ট্রাভেলস পরিবহনের একটি বাসের চালকের একজন সহকারী বলেন, 'মালিকরা আর হামাগের শ্রমিক নেতারা সরকারের দালালি করার জন্য এ ধর্মঘট ডাকছে। তাগের লাভ ঠিকই হবে, কিন্তু হামাগের কোনো লাভ হবে না। দাবিটাবি কিছু লয়, এটা গরিবের প্যাট মারা ধর্মঘট। বিএনপির সমাবেশ শ্যাষ, এ ধর্মঘট শ্যাষ হবে।' নওগাঁ বালুডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

তবে ধর্মঘটের মধ্যেও উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জে জেলা অভ্যন্তরে বৃহস্পতিবার বাস চলাচল করছে। তবে বিপরীত চিত্র নাটোরে। এ জেলায় পণ্যবাহী যানবাহনও চলাচল করছে না। এদিকে রাজশাহীতে পরিবহন ধর্মঘটের প্রভাব পড়েছে রংপুরেও। গতকাল সকাল থেকে রাজশাহী রুটে রংপুর থেকে বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা। আকস্মিক এই বাস ধর্মঘটে রংপুর থেকে রাজশাহীগামী যাত্রীরা পড়েছেন চরম বিপাকে।

প্রতিবাদ সমাবেশ আ'লীগের :এদিকে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম 'ব্যাহত' ও বিএনপির 'দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের' প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজশাহীতে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ। এর আগে দুপুর ১২টায় নগরীর কুমারপাড়ায় দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপিকে সতর্ক করেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেছেন, গণসমাবেশের নামে বিএনপি রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড করলে, বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কোনো অশোভন মন্তব্য ও জনগণের জানমালের ক্ষতি করলে তা বরদাশত করা হবে না।

সংবাদ সম্মেলনে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার, আওয়ামী লীগের সদস্য বেগম আখতার জাহান, রাজশাহী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর ইকবাল ও মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামাল উপস্থিত ছিলেন।

[প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়েছেন রাজশাহী ও বগুড়া ব্যুরো, পাবনা ও রংপুর অফিস এবং সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি]



© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com