দালালদের খপ্পরে ফসলি জমির মাটি উজাড়

প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২২ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মতিউর রহমান সেলিম, ত্রিশাল (ময়মনসিংহ)

ত্রিশালের হরিরামপুর ইউনিয়নের ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে ইটভাটায় নেওয়া হচ্ছে সমকাল

এখন শুকনো মৌসুম। ইট তৈরি ও পোড়ানোর উপযুক্ত সময়। ভাটাগুলোতে বিরাজ করছে কর্মচাঞ্চল্য পরিবেশ। ইট তৈরির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যস্ত সময় পার করছেন ত্রিশাল উপজেলার ভাটা মালিক ও শ্রমিকরা। একই সঙ্গে ভাটাগুলোতে মাটির জোগান দিতে ব্যস্ত দালাল চক্র। ভাটা মালিকদের সঙ্গে আঁতাত করে ফসলি জমির মাটি উজাড় করে ফেলছে দালালরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ত্রিশাল উপজেলায় রয়েছে ৫৮টি ইটভাটা। ছোট-বড় প্রতিটি ভাটায় গড়ে প্রতিবছর পোড়ানো হয় ৫০ লাখ ইট। এক হাজার ঘনফুট মাটিতে তৈরি হয় ১২ হাজার ইট। এই হিসাবে ৫০ লাখ ইটের বিপরীতে দরকার ৪১৬ হাজার ঘনফুট মাটি। ৫৮টি ভাটায় লাগে ২ কোটি ৪১ লাখ ৬৬ হাজার ৬৬৬ ঘনফুট মাটি। এ বিশাল মাটির জোগান দিতে ব্যস্ত দালাল চক্রের সদস্যরা। তাঁরা স্থানীয় কৃষিজীবীদের টাকার লোভে ফেলে উজাড় করে ফেলছে ফসলি জমির মাটি। দালালরা নামমাত্র মূল্যে ফসলি জমির মাটি কিনে নিয়ে প্রতি হাজার ঘনফুট ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা দরে ভাটা মালিকদের কাছে বিক্রি করছেন। এ কাজে জড়িতদের মধ্যে রয়েছেন- ডালিম, আবু তাহের, রুবেল, ভাঙাড়ি জামাল, বাচ্চু ও মোহাম্মদ আলী।

ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইনে জেলা প্রশাসকের অনুমোদনক্রমে মজা পুকুর, খাল, বিল, খাঁড়ি, দিঘি, নদ-নদী, হাওর-বাঁওড়, চরাঞ্চল বা পতিত জমি থেকে মাটি সংগ্রহের নির্দেশনা রয়েছে। তবে ইট তৈরির বেশিরভাগ মাটি আসছে উর্বর ফসলি জমি থেকে। বিধান রয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বিধান লঙ্ঘন করে ইট তৈরির উদ্দেশ্যে কৃষিজমি, পাহাড় বা টিলা থেকে মাটি সংগ্রহ করেন, তাহলে অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন প্রয়োগ বা বাস্তবায়নে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের তৎপরতা না থাকার কারণে ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে ফসলি জমি এবং হুমকির মুখে পড়ছে খাদ্য উৎপাদন।

হরিরামপুর ইউনিয়নের নিগুরকান্দা গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, ভেকু (খননযন্ত্র) দিয়ে ফসলি জমির মাটি খুঁড়ে তুলে দেওয়া হচ্ছে ট্রাকে। একের পর এক ট্রাক আসছে আর মাটি ভরে ছুটছে ইটভাটার দিকে। প্রতিদিন এভাবেই বিরামহীন চলছে ফসলি জমির মাটি উজাড়। এ যেন ইট তৈরির মাটি আহরণের মহোৎসব। ইটভাটার মাটিভর্তি ট্রাক চলাচলে হারবার চর নামের গ্রামীণ সড়কটি বেহাল হয়ে পড়েছে। একই অবস্থা দেখা গেছে বালিপাড়া ইউনিয়নের আমিয়ান ডাঙ্গুরি ও বাহাদুরপুর গ্রামেও। টানা কয়েক বছর মাটি কাটার ফলে আমিয়ান ডাঙ্গুরি গ্রামের ২০-২৫ একর কৃষিজমি যেন বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে।

চাউলাইদ গ্রামের স্পিনিং মিল শ্রমিক আলমগীর হোসেন ও স্থানীয় বাসিন্দা খবির উদ্দিন জানান, কয়েক বছর ধরেই চলছে ফসলি জমির মাটি লুটপাট। কিন্তু জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা বা প্রশাসনের কোনো অভিযান চোখে পড়েনি। মাটির দালাল ডালিম, আবু তাহের ও রুবেলের ট্রাক চলাচলের কারণে হারবার চর কাঁচা সড়কটি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

কৃষক কামাল হোসেন, আবুল কাশেম ও জসিম উদ্দিনের ভাষ্য, এত কিছু বোঝেন না তাঁরা। চাষাবাদে লাভ নেই। এ অবস্থায় টাকার লোভে ফেলে তাঁদের কাছ থেকে ফসলি জমির মাটি কিনে নেন দালালরা।

মাটি কাটতে দুই একর কৃষিজমি চুক্তিতে নেওয়া দালাল বাচ্চু মিয়ার সঙ্গে কথা হয়। তবে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, 'আমি তো মাটির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নই।' এ ছাড়া সুনির্দিষ্ট কোনো জবাব দিতে না পারলেও মাটি ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ স্বীকার করেছেন তারই (বাচ্চু) অংশীদার মোহাম্মদ আলী।

বাহাদুরপুর গ্রামের কৃষক জালাল উদ্দিন বলেন, 'চাষাবাদে খরচ বেড়েছে, কিন্তু বাড়েনি ধানের দাম। ন্যায্যমূল্য না পেলে পরিশ্রম বৃথা যায়। তা ছাড়া চারা রোপণের পর প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা রোগবালাই হলে তো সবই শেষ। তাই ভালো-মন্দ বিবেচনা না করেই ক্ষেতের মাটি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিই।'

ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, কৃষিজমির মাটি ইটভাটায় ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে ত্রিশাল উপজেলা প্রশাসন জিরো টলারেন্স। খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com