সহজ ব্যবস্থায় বাড়বে রেমিট্যান্স

সমকাল-রামরু গোলটেবিল বৈঠক

প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২২ । ২১:৫২ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিশেষ প্রতিনিধি

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকাল কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার রেমিট্যান্স প্রবাহ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা সমকাল

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য যাওয়ার ব্যয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের তুলনায় বেশি। শুধু বিদেশে যাওয়ার হিসাব না রেখে, সেখানে গিয়ে চাকরি পেল কিনা কিংবা প্রতারণার শিকার হলো কিনা তার খোঁজ-খবরও রাখতে হবে। প্রবাসীরা যাতে কোনো ঝামেলা ছাড়াই সহজে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠাতে পারেন তার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা জরুরি। দেশে নিজের হিসাবে অর্থ রাখার সহজ ব্যবস্থা রাখা এবং এ বিষয়ে তাঁদের উৎসাহ দেওয়া দরকার। এ ছাড়া বৈধপথে রেমিট্যান্স বাড়াতে হুন্ডি প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে কার্যকর ফল পাওয়া যাবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য এই মুহূর্তে জরুরি।

গতকাল বৃহস্পতিবার দৈনিক সমকাল ও রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব সুপারিশ করেন। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকাল কার্যালয়ে 'রেমিট্যান্স প্রবাহ ও ব্যবস্থাপনায় চ্যালেঞ্জ এবং মোকাবিলার উপায়' শীর্ষক এ আলোচনায় সহযোগিতা করে হেলভেটাস বাংলাদেশ এবং সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোঅপারেশন।

সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেনের সভাপতিত্বে সভা সঞ্চালনা ও মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার ড. তাসনিম সিদ্দিকী। এতে অংশ নেন সংসদ সদস্য, অর্থনীতিবিদ, এমএফএস সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এবং অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা। বক্তারা সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স কমার অন্যতম কারণ হিসেবে হুন্ডি প্রবণতা বাড়ার পাশাপাশি ব্যাংক খাতের প্রতি আস্থা কমে যাওয়ার কথা বলেন। তাঁরা এ বিষয়ে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্নিষ্টদের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন।

মোজাম্মেল হোসেন বলেন, দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিশাল ভূমিকা আছে। এরপরও তাঁরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। তাঁদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ব্যবস্থাপনা ও সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ব্যবহার নিয়ে আরও গবেষণা দরকার।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের বর্তমান সংকট সমাধানে আমদানি কমানো কোনো সমাধান নয়। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর ওপর বেশ জোর দিতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রচুর টাকা ঋণের নামে বের হয়ে গেছে বলে খবর পাওয়া যায়। সেখানে আসলে কী ঘটেছে তা উদ্ঘাটন করে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। লোপাটের টাকা কোথায় গেল বের করতে হবে। ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকে গত দু'দিনে ৫ হাজার ২৫০ কোটি টাকা দেওয়া হলো। একজন চুরি করে নিয়ে যাবে, আর সরকার সেখানে টাকা দেবে- এটা হতে পারে না।

ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, সম্প্রতি রেমিট্যান্স কমার অন্যতম কারণ হিসেবে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানো নিরাপদ কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ক্ষেত্রে দেশের রেমিট্যান্স আহরণে সবচেয়ে ভূমিকা রাখা ইসলামী ব্যাংকের বিষয়ে অনেকে জানতে চাচ্ছেন। এ বিষয়ে প্রবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক দূর করতে হবে। রেমিট্যান্স কেন কমছে- এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আসল জায়গায় নজর দিতে হবে। সঠিকভাবে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার কারণ চিহ্নিত করতে ও সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারলে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

পার্লামেন্টারি ককাস অন মাইগ্রেশনের চেয়ারপারসন শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপি বলেন, বৈধপথে প্রবাসী আয় বাড়ানো ছাড়া বর্তমানের অর্থনৈতিক সংকট সমাধান হবে না। হুন্ডিতে টাকা পাঠালে শাস্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করতে হবে, যা বৈধপথ বেছে নিতে উৎসাহ দেবে। রেমিট্যান্সে প্রণোদনা বাড়ানোর পক্ষে নিজের অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। এখন তা এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। সুতরাং, প্রণোদনার পেছনে বছরে ৫ হাজার কোটি ব্যয় হলে তেমন কিছু যায় আসে না। সুফল পেতে বাড়ি বাড়ি রেমিট্যান্সের টাকা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

পার্লামেন্টারি ককাস অন মাইগ্রেশনের সদস্য তানভীর শাকিল জয় এমপি বলেন, রেমিট্যান্সের ইকো-সিস্টেম কত জটিল তা কাজ করতে গিয়ে বোঝা যায়। এটি সহজ করতে হবে। তিনি বলেন, দেশে টাকা পাঠানোর পর কোনো সমস্যা হয় না। সমস্যা হয়, বাইরে থেকে পাঠানোর ক্ষেত্রে। তাই দেশের বাইরে কীভাবে প্রবাসীদের বিভিন্ন সেবা দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে।

অনুষ্ঠানে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. নাশিদ রেজওয়ানা মনির বলেন, বর্তমান সরকার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মধ্যে আর্থিক অভিগম্যতাকে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হিসেবে রেখেছে। রেমিটেন্সের বিষয়টি এই এজেন্ডার মধ্যে রয়েছে। এই এজেন্ডা বাস্তবায়নে আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে একটা কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। আগামী ১৬ ডিসেম্বরের আগেই এই কর্মপরিকল্পনা প্রকাশের ইচ্ছা আমাদের আছে। এতে সুনির্দিষ্টভাবে রেমিটেন্সের বিষয়েও বলা আছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমরা ২১.০৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার রেমিটেন্স পেয়েছি। করোনার মধ্যেও এর আগের অর্থবছরেও আমাদের ২৪.৭৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার রেমিটেন্স ছিল। আমাদের রেমিটেন্সের প্রবাহ কিছুটা কমে গিয়েছে। এবছর রেমিটেন্সের ওপর প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে। মানি লন্ডারিং, হুন্ডি এবং রেমিটেন্স ব্যবস্থাপনাকে নিয়ন্ত্রণ করা- এসব বিষয় যদিও আমাদের মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়, তবে আমরা এ বিষয়ে সচেতন। এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ব্যাংকের শাখা জেলা থেকে যখন উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত হবে, তখন আমাদের অভিবাসী কর্মীরা আরো সুবিধা পাবেন। এছাড়া প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে প্রবাসীদের কল্যাণে অনেকগুলো সেবা আছে। শুধু অভিবাসী কর্মীই নয়, তার পরিবারের জন্যেও অনেক সেবা রয়েছে। ব্যাংকের সেবা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে।

বিকাশের চিফ এক্সটার্নাল অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মেজর জেনারেল (অব.) শেখ মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, প্রবাসী আয় বিতরণ চ্যানেল হিসেবে ২০১৬ সাল থেকে কাজ করছে বিকাশ। বিকাশের মাধ্যমে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ৩৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার সমপরিমাণ রেমিট্যান্স বিতরণ হয়েছে। গত বছর বিতরণ হয় ২৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি এমএফএস প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আনার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার প্রক্রিয়া সহজ হলে রেমিট্যান্স বাড়াতে তা বড় ভূমিকা রাখবে।

নগদের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা সিহাব উদ্দিন চৌধুরী বলেন, হুন্ডি কারবারিরা প্রবাসীদের কাছে গিয়ে নানা উপায়ে উদ্বুদ্ধ করে। বেতন পাওয়ার ৭ দিন আগে প্রবাসীর আবাসস্থলে গিয়ে কথা বলে তাদের পরিবারের জন্য আগাম টাকা পাঠিয়ে দেয়। ব্যাংকের চেয়ে তারা দরও দিচ্ছে বেশি।

সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মুনতাসির কামাল বলেন, রেমিট্যান্সে প্রণোদনা দিয়ে হুন্ডি ঠেকানো যাবে না। হুন্ডি ঠেকানোর জন্য অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

আলোচনায় আরও অংশ নেন হেলভেটাস সুইস কোঅপারেশন বাংলাদেশের সিমস প্রকল্পের পরিচালক আবুল বাশার, আইওএমের ন্যাশনাল গ্রোগ্রাম অফিসার আবদুল্লাহ আল মুঈদ, বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম, ওয়্যারবী ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক, ওকাপের চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম, প্রত্যাশীর চট্টগ্রাম জেলা সমন্বয়কারী রাশিদা খাতুন, রামরুর কুমিল্লা জেলা সমন্বয়কারী শান্তা সূত্রধর, কর্মসূচি পরিচালক মেরিনা সুলতানা এবং সমকালের বিজনেস এডিটর জাকির হোসেন।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com