
স্মরণ
মানবিক চট্টলবীর
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২২ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মোহাম্মদ বেলাল হোসেন

চট্টগ্রাম শহরকে যাঁরা নিয়মিত পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ করেন, তাঁদের বলা হতো 'মেথর'। তাঁরা যেখানে বাস করতেন সেই এলাকাকে বলা হতো 'মেথরপট্টি'। মেথর বলতে সমাজের দলিত সম্প্রদায়কে বোঝায়, যাঁরা ছিলেন এক ধরনের অচ্ছুত। যুগ যুগ ধরে চট্টগ্রাম শহরে এই প্রথা চলে আসছিল। কিন্তু সমাজের এই উঁচু-নিচু বিভাজন প্রথা মানতে নারাজ একজন মেয়র। তিনি চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি 'মেথর'দের নাম পাল্টে নতুন নাম দেন 'সেবক'।
পদ দখল করে দলনেতা হওয়া যায়, কিন্তু জননেতা হওয়া যায় না। জননেতার প্রধান গুণ মানবিক হওয়া, মানবতার জন্য কাজ করা। মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, নেতাজি সুভাষ বসু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মানুষ আজও সংকট-সংগ্রামে স্মরণ ও অনুসরণ করে। তাঁরা শোষকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন; নিপীড়নের বিরুদ্ধে গেয়েছেন মানবতার জয়গান। ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে সৃষ্টির কথা বলেছেন। চট্টলবীর মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁদের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন; একজন পরিপূর্ণ মানবিক মানুষ। তাঁর কর্মের মধ্যে চতুরতা ও অহমিকা ছিল না। ছিল অদম্য সাহস, কর্মস্পৃহা ও দেশপ্রেম।
মহিউদ্দিন চৌধুরীর পুরো নাম আবুল বশর মোহাম্মদ মহিউদ্দিন চৌধুরী। ১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা রেলওয়েতে কর্মরত থাকায় মহিউদ্দিন চৌধুরীর শৈশব কাটে চট্টগ্রাম শহরে। মহিউদ্দিন চৌধুরী যখন সরকারি সিটি কলেজের ছাত্র, তখনই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তাঁর মনে দাগ কাটে। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে নেতৃত্ব দেন মহানগর ছাত্রলীগের। '৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, '৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন সক্রিয়ভাবে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। পার্বত্য এলাকায় ৩০০ সদস্যের মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতা হিসেবে সম্মুখসমরে নেতৃত্ব দেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর সহযোদ্ধাদের নিয়ে বিজয়ীর বেশে তিনি চট্টগ্রামে ফিরে আসেন।
স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের প্রধানতম নেতা হয়ে উঠেছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। কালুরঘাটে গার্মেন্টের আগুনে পুড়ে অর্ধশতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু, বন্দরটিলায় নৌবাহিনীর সঙ্গে এলাকাবাসীর সংঘর্ষ- সবকিছুতেই সবার আগে ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রামের উপকূলজুড়ে ছিল লাশের স্তূপ। সেই লাশ দাফন ও অসহায় মানুষের চিকিৎসাসেবা দিতে মুসলিম ইনস্টিটিউটে ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলেন তিনি। যখনই চট্টগ্রামের দুর্দিন, তখনই হাজির হয়েছেন বীর মহিউদ্দিন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে ১৯৯৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত টানা ১৭ বছর দায়িত্ব পালন করেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।
চট্টগ্রামের স্বার্থের প্রশ্নে মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন আপসহীন। আমেরিকার এসএসএ কোম্পানি ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের মোহনায় পোর্ট নির্মাণের উদ্যোগ নিলে মহিউদ্দিন চৌধুরী তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে তা বন্ধ করে দেন। একইভাবে বছরে মাত্র ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে শাহ আমানত বিমানবন্দর থাই কোম্পানিকে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে গর্জে উঠেছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। এখন রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠান বছরে ৪০ কোটি টাকার বেশি আয় করে প্রমাণ করেছে- সিদ্ধান্তটি ছিল হঠকারী। মহিউদ্দিন চৌধুরী আন্দোলন করেছিলেন কর্ণফুলী নদীতে টানেল নির্মাণে। আজ কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধনের দ্বারপ্রান্তে।
সমাজ ও রাজনীতিতে সবাই নেতা বা নায়কের স্থান করে নিতে পারে না। ইতিহাসে নায়ক হওয়ার মতো মানুষ সব কালে, সব যুগে সৃষ্টি হয় না। ইতিহাস আপন তাগিদে নায়কের উদ্ভব ঘটায়। চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী তেমনই এক অবিসংবাদিত নেতা, যাঁর সৃষ্টি ইতিহাসের প্রয়োজনে।
মোহাম্মদ বেলাল হোসেন: শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা ও প্রাবন্ধিক
historybelal@gmail.com
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com