কৃষি

শঙ্কা কাটিয়ে আমন উৎপাদনে স্বস্তি

প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২২ । ০২:৩৩ | প্রিন্ট সংস্করণ

মো. শাহজাহান কবীর

সারাবিশ্ব বর্তমানে একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। করোনা মহামারির নেতিবাচক প্রভাব কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সারাবিশ্বকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। সবচেয়ে বেশি নাজুক অবস্থায় পড়েছে বিশ্বের খাদ্য পরিস্থিতি। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আগামী দিনগুলো কেমন কঠিন হবে তা সহজেই অনুমেয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশ, যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রায় ১ হাজার ২০০, তাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হবে। বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদনের প্রায় সব উপকরণই বিদেশনির্ভর। এমন অবস্থায় খাদ্য উৎপাদনের বর্তমান ধারা অব্যাহত রাখা বিশাল চ্যালেঞ্জ। তাই বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সামনে একটাই লক্ষ্য- খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো, তা যেভাবেই হোক।

তবে অকাল বন্যা ও অতিরিক্ত বৃষ্টিতে এ বছর বোরো ও আউশের উৎপাদন কিছুটা কম হয়েছে। এতে দেশের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে বেশ অস্বস্তি কাজ করছে। বাজারে চালের দাম বেশি থাকায় এ অস্বস্তি আরও প্রকট হয়েছে। এ অবস্থায় আমনের উৎপাদন বাড়ানো অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তাই চলতি আমন মৌসুমের শুরুতেই ধানের উৎপাদন বাড়াতে কৃষি মন্ত্রণালয় আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ৫৯ লাখ হেক্টর এবং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৬১ লাখ টন নির্ধারণ করে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সব উপকরণ- বীজ, সার, কীটনাশক ও সম্পূরক সেচ প্রদান, সঠিক সময়ে সঠিক বয়সের চারা রোপণ এবং যথাসময়ে কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

আমন মৌসুমের শুরুতেই অপ্রতুল ও অসম বৃষ্টিপাতের কারণে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বড় একটি ধাক্কা আসে। যার কারণে সময়মতো বীজ বপন ও চারা রোপণ কিছুটা ব্যাহত হয়। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুততম সময়ে সেচ পাম্প ও সেচ প্রকল্প চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ফলে পাম্পের সাহায্যে প্রয়োজনমাফিক সেচ দিয়ে যথাসময়ে আমন চাষ শুরু হয়। পরে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিক হওয়ায় আমন চাষাবাদে আর কোনো সমস্যা হয়নি। সারাদেশে এ বছর আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, আমনের ভালো ফলনের জন্য পরিস্কার সূর্যালোক, অধিক সৌর বিকিরণ, অধিক গড় তাপমাত্রা, কম আপেক্ষিক আর্দ্রতা এবং মেঘমুক্ত আকাশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ধানের অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায়, প্রজনন পর্যায় এবং সমগ্র জীবনকালে যথাক্রমে মোট ৬০৯, ৪০১ এবং ১০১০ ঘণ্টা সূর্যালোক প্রয়োজন। চলতি আমন মৌসুমে অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায়ে ৬১০ ঘণ্টা, প্রজনন পর্যায়ে ৪২৫ ঘণ্টা এবং সমগ্র জীবনকালে ১০১২ ঘণ্টা ছিল। এ ছাড়া আবহাওয়ার রেকর্ড থেকে দেখা যায়, আমন ২০২২ মৌসুমে মোট সূর্যালোক ছাড়াও সৌর বিকিরণ ও গড় তাপমাত্রা বেশি, আপেক্ষিক আর্দ্রতা কম এবং মেঘমুক্ত আকাশ থাকায় ফলন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

বিগত ৫ বছরের (২০১৭-২১) আমন মৌসুমের আবহাওয়ার উপাদানগুলো (সূর্যালোক, সৌর বিকিরণ, তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আর্দ্রতা ও মেঘমুক্ত আকাশ) এবং ফলনের ওপর এদের প্রভাবের গাণিতিক বিশ্নেষণের মাধ্যমে আমনের ফলন প্রাক্কলন করে দেখা যায়, ২০২২ সালে আমনের ফলন হবে হেক্টরপ্রতি ২ দশমিক ৭৬ টন, যা বিগত বছরের তুলনায় প্রায় ৭ শতাংশ বেশি। সে হিসাবে এ বছর আমনে প্রায় ১ কোটি ৬৩ লাখ টন চাল উৎপাদন প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

উৎপাদন বৃদ্ধির দ্বিতীয় কারণ হলো, বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় অনেক নিচু জমি আমন চাষের আওতায় এসেছে এবং স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ফলন হয়েছে। অন্যান্য বছর এসব জমিতে ধান রোপণ করা সম্ভব হয় না। অনেক সময় রোপণ করা গেলেও উপর্যুপরি বন্যায় ফসল নষ্ট হয় এবং কিছু টিকে থাকলেও পোকা-মাকড়ের আক্রমণে ফলন অনেক কমে যায়।

এই আমন উত্তোলনের পর দেশে সারাবছরে খাদ্য পরিস্থিতি কেমন হবে? আমাদের হিসাবে আগামী জুন পর্যন্ত আউশ (৩ মিলিয়ন টন), আমন (১৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন টন) ও বোরো (২০ দশমিক ৪ মিলিয়ন টন) ধরে মোট উৎপাদন হবে ৩৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন টন। প্রতিদিন জনপ্রতি ৪০৫ গ্রাম হিসাব করলে ১৭ কোটি মানুষের জন্য চালের প্রয়োজন হবে ২৫ দশমিক ১৩ মিলিয়ন টন। ২৬ দশমিক ১২ শতাংশ হিসাব করে চালের প্রয়োজন ১০ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন টন। সে হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকবে ৪ দশমিক ২ মিলিয়ন টন বা ৪২ লাখ টন। এ হিসাবে যত ত্রুটিই আমরা বিবেচনায় নিই না কেন; আগামী জুন পর্যন্ত দেশে চালের কোনো সংকট হবে না। তবে কোনো অবস্থাতেই সরবরাহ ব্যবস্থা যাতে বিঘ্নিত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তা হলেই দেশের খাদ্য পরিস্থিতিতে বিশেষ করে চালে একটি স্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করবে।

ড. মো. শাহজাহান কবীর: মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট

dg@brri.gov.bd

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com