চট্টগ্রামে নানা কায়দায় শক্তি বাড়াচ্ছে জামায়াত

প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২২ । ০১:৫২ | প্রিন্ট সংস্করণ

সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে ফের সংগঠিত হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। জাতীয় নির্বাচনের আগেই সাংগঠনিক ভিত্তি জবরদস্ত করতে দলটি এগোচ্ছে কৌশলে। নানা সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে অনলাইনে সক্রিয় যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সংগঠনটি। নানা ইস্যুতে তারা দলীয় বৈঠক করছে ভার্চুয়ালি। কখনও কখনও গোপনে উপস্থিত হয়ে সশরীরে করছে বৈঠক। তবে এসব গোপন বৈঠকে এক টেবিলে ১০ থেকে ১৫ জনের বেশি নেতাকর্মী বসছেন না। এর মধ্যেও বেশ কয়েকটি বৈঠকে হানা দিয়ে জামায়াতের অর্ধশত নেতাকর্মীর হাতে কড়া পরিয়েছে পুলিশ। তার পরও বন্ধুর পথ মাড়িয়ে সংসদ নির্বাচনের আগেই প্রকাশ্যে মাঠে নেমে সামর্থ্যের জানান দিতে চায় তারা। পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া-লোহাগাড়া, বাঁশখালী, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, সীতাকুণ্ড ও নগরীর ডবলমুরিং-হালিশহরের আসন নিয়ে অন্য দলগুলোর সঙ্গে দরকষাকষির ছকও কষছে জামায়াত।

সাংগঠনিক খুঁটি মজবুত করতে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরায় রাখা হয়েছে চট্টগ্রামের শীর্ষ আট নেতাকে। চট্টগ্রাম মহানগরের পাঁচজন, দক্ষিণ জেলার দু'জন ও উত্তরের একজন রয়েছেন দলটির নীতিনির্ধারণী এই সর্বোচ্চ ফোরামে। ২০১৯ সালের ২৯ নভেম্বর কঠোর গোপনীয়তায় এই নেতৃত্ব ঠিক করে জামায়াত। সারাদেশের রুকনরা ভোট দিয়ে মজলিসে শূরার এসব সদস্য নির্বাচন করেন। মজলিসে শূরার কমিটিতে চট্টগ্রাম থেকে স্থান পান নগরের আমির মুহাম্মদ শাহজাহান, সেক্রেটারি নজরুল ইসলাম, নায়েবে আমির শাহজাহান চৌধুরী, আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ ও অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অধ্যক্ষ নুরুল আমিন চৌধুরী। দক্ষিণ জেলা আমির জাফর সাদেক ও সেক্রেটারি ড. হেলাল উদ্দিন নোমান এবং উত্তর জেলা আমির অধ্যক্ষ আমিরুজ্জামান।

যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে দেশজুড়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ে জামায়াত। তবু আবদুল কাদের মোল্লা ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের পর চট্টগ্রামে বড় ধরনের তাণ্ডব চালায় দলটির নেতাকর্মীরা। বাঁশখালী, সীতাকুণ্ড, হাটহাজারী ও সাতকানিয়ায় এখনও সংগঠিত আছে জামায়াতের নেতাকর্মীরা। নগরীর ডবলমুরিংয়ে গোপনে নানা কর্মকাণ্ড চালায় দলটি। দলীয় নির্দেশনা মেনে সামাজিক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন নেতাকর্মীরা। সুযোগ বুঝে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে তাঁরা সক্রিয় থাকেন অনলাইনে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরও বাঁশখালী, সাতকানিয়াসহ কয়েকটি ঘাঁটিতে জনপ্রতিনিধিও নির্বাচিত হন জামায়াতের নেতারা। বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব তৈরির পর এখন কিছুটা বেকায়দায় নেতাকর্মীরা। চট্টগ্রামে বিএনপির বিভাগীয় মহাসমাবেশেও জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় কোনো নেতাকে মঞ্চের আশপাশে দেখা যায়নি। তবে সাকা চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীর 'আল্লাহু আকবর' স্লোগান নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলে অনলাইনে ফের সরব হয়ে ওঠে জামায়াত। এটি করে মূলত বিএনপির কাছে আসার চেষ্টা করে দলটি। তবে জামায়াতের এ ফাঁদে পা দেয়নি বিএনপি। পরের বিভাগীয় সভাগুলোতেও জামায়াতের কোনো শীর্ষ নেতাকে মঞ্চে রাখেনি তারা।

চট্টগ্রামে আগে থেকেই জামায়াতের ভালো অবস্থান ছিল। জামায়াতের শক্তি দুর্বল করতে 'কাঁটা দিয়ে কাঁটা' তোলার কৌশল নেয় আওয়ামী লীগ। সাতকানিয়ার দুর্গ তছনছ করতে জামায়াত ঘেঁষা আবু রেজা নদভীকেই এমপি করে আওয়ামী লীগ। 'ওষুধ' কার্যকরী হওয়ায় সাতকানিয়ায় এখন দ্বিধা বিভক্ত জামায়াত। নেতৃত্ব নিয়ে নগরেও বিভক্তি রেখা আঁকা হয়ে গেছে ভেতরে ভেতরে। শাহজাহান চৌধুরী ও সাবেক এমপি আ ন ম শামসুল ইসলামের মধ্যে অনেক আগে থেকেই 'সাপে-নেউলে' সম্পর্ক। সম্প্রতি শাহাজাহান চৌধুরীকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেওয়ার নেপথ্যেও শামসুল ইসলাম ছিলেন বলে মনে করে তাঁর অনুসারীরা।

চট্টগ্রামে মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা মিলিয়ে তিনটি সাংগঠনিক শাখায় বিভক্ত হয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে জামায়াত। তিন সাংগঠনিক জেলার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী চট্টগ্রাম মহানগর শাখা। তবে জনসমর্থন বেশি তাদের দক্ষিণ জেলায়। এই শাখার আওতায় আছে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও বাঁশখালী। এ তিন উপজেলা জামায়াত অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে আলোচিত। তবে ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতিতে এগিয়ে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা। ফটিকছড়ি ও হাটহাজারীকেন্দ্রিক শিবির ক্যাডাররা আছে উত্তরে। হেফাজতে ইসলামের ভেতরেও শিবিরের একটি অংশ ঘাপটি মেরে আছে ফটিকছড়ি ও হাটহাজারীতে।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম উত্তর, দক্ষিণ ও নগর মিলে প্রায় আড়াই হাজার রুকন রয়েছে জামায়াতের। এরা নীতিনির্ধারণী বিভিন্ন কাজে দলকে সহায়তা করে। জামায়াতের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ২৯০ রুকনের বিপরীতে একজন শূরা সদস্য নির্বাচিত হন। সব শেষ নির্বাচিত শূরা সদস্যদের মধ্যে মুহাম্মদ শাহজাহান শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। তাঁর বাড়ি কক্সবাজারে। চট্টগ্রাম নগর আমিরের দায়িত্ব পাওয়ার আগে তিনি কক্সবাজারের আমির ছিলেন। ২০১৯ সালে তিনি নগর সেক্রেটারি ও নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য নজরুল ইসলামসহ ১২ নেতাকর্মী নিয়ে সূবর্ণা আবাসিক এলাকা থেকে আটক হন।

সাংগঠনিক কার্যক্রমের বিষয়ে মজলিসে শূরার এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নগর জামায়াতের দুই নায়েবে আমিরের একজন সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী। আরেকজন শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি আ জ ম ওবায়দুল্লাহ। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ভোলায় হলেও স্কুলজীবন থেকে তিনি আছেন চট্টগ্রামে। দীর্ঘদিন সহযোগী সংগঠনগুলো দেখাশোনা করলেও নগর আমির হিসেবে আ ন ম শামসুল ইসলামের শেষ মেয়াদে ওবায়দুল্লাহকে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি করা হয়। পরের কমিটিতে আফসার উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে নায়েবে আমির করা হয় তাঁকে। শাহজাহান-নজরুল কমিটিতে তিনি নায়েবে আমিরের দায়িত্বে আছেন।

আরেক শূরা সদস্য অধ্যক্ষ নুরুল আমিন চৌধুরীর বাড়ি ফটিকছড়িতে। তিনি একসময় শিবিরের নগর শাখার সভাপতি ছিলেন। প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন শিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও। দীর্ঘদিন নগর জামায়াতের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করলেও সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রথমবারের মতো স্থান হয় তাঁর।

দীর্ঘদিন দক্ষিণ জেলা জামায়াতের আমির জাফর সাদেক একজন ব্যবসায়ী। সাতকানিয়া পৌর নির্বাচনে তিনি একবার হেরেছিলেন। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেও জমা দেননি। দক্ষিণ জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি ড. হেলাল উদ্দীন মোহাম্মদ নোমান চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক। অধ্যক্ষ আমিরুজ্জামান উত্তর জেলা জামায়াতে দীর্ঘদিন সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। আমির মফিজুর রহমানকে দল থেকে বহিস্কারের পর আমির পদে আসেন আমিরুজ্জামান।





© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com