
হ্যারির আত্মজীবনী
নিছক দুই ভাইয়ের মল্লযুদ্ধ নয়
প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২৩ । ০৪:১৩ | প্রিন্ট সংস্করণ
গ্যাবি হিনস্লিফ

আমার ছোট বোন যখন খুব অল্পবয়স্ক ছিল, তখন একদিন আমি তাকে ধাক্কা মেরেছিলাম। সৌভাগ্যবশত সে তখন প্রত্যাঘাত করার মতো শক্ত-সামর্থ্য ছিল না। তবে ওটা ছিল আমাদের মধ্যে মারামারির শুরু, সমাপ্তি নয়। আমরা পরস্পরকে চিমটি কাটতাম, চড় মারতাম, সামান্য কারণেই মারামারি শুরু করতাম। আমরা ভাইবোনেরা খেলনা নিয়ে, পুডিংয়ের বড় অংশের দখল নিয়ে মারামারি করতাম; নতুন জামাকাপড় নিয়েও আমরা পরস্পরের সঙ্গে মারামারিতে লিপ্ত হতাম। বড় হয়ে ভুলেও গেছি ওই সব মারামারি আসলে কী নিয়ে ছিল। তবে একটু গভীরে গিয়ে ভেবে দিখেছি, ওইগুলো আসলে ছিল কে বেশি ভালোবাসা পাবে তা নিয়ে। সৌভাগ্যক্রমে, আমাদের পরিবারে আমরা কেউ কারও প্রিয়পাত্র ছিলাম না; সম্ভবত যে কারণে আমরা বড় হয়েও 'এমনকি আমৃত্যু' একে অপরকে ভালোবাসতে পেরেছি। কিন্তু প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্স হ্যারি আমাদের মতো ভাগ্যবান নন। এ কারণেই হ্যারির নতুন বই 'স্পেয়ার' অনুসারে; বইয়ের শিরোনামটিও কি সাংঘাতিক- তিন বছর আগেও 'যখন দুজনেই পূর্ণবয়স্ক' তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে মারামারিতে লিপ্ত হয়েছিলেন।
মারামারিটাও ছিল স্পষ্টতই হ্যারির স্ত্রী মেগানকে নিয়ে। হ্যারি বেশ ক্ষোভের সঙ্গে লিখেছেন- তাঁর ভাই মেগানকে বলতেন, 'অসুবিধাজনক', 'বদমেজাজি' ও 'বাতিলযোগ্য'; অনেকটা আমরা কানাঘুষায় ইতোমধ্যে যা শুনেছি; সংবাদমাধ্যমেও যা এসেছে। তবে বিষয়টি আরও গুরুতর হয়ে ওঠে যখন উইলিয়াম সিংহাসনের উত্তরাধিকার হিসেবে ভাব দেখাচ্ছেন বলে হ্যারি অভিযোগ তোলেন। উইলিয়াম এমন একজন, যাঁকে কেন্দ্র করেই সবকিছু আবর্তিত হবে। উইলিয়ামের বিরুদ্ধে হ্যারি যেসব অভিযোগ করছেন সেগুলো যে কোনো সহোদর যুগলের মধ্যেই ঘটতে পারে; তবে যে কারণে এসব একটা বিশেষ মনোযোগ দাবি করে তা হলো, এর মাঝখানে আছে সিংহাসনের উত্তরাধিকার।
পছন্দ করুন বা না করুন, অথবা আপনি আর একমুহূর্ত এসব শুনতে না চাইতে পারেন; তবে এটা মানতে হবে, হ্যারি ও মেগান সাম্প্রতিক সময়ে এমন কিছু প্রশ্ন তুলেছেন, যেগুলো একটু বেখাপ্পা লাগলেও সত্যি সত্যিই জনস্বার্থবাহী। মিশ্র বর্ণের রাজকীয় এক বিয়ে সম্পর্কে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া তুলে ধরে তাঁরা দেশের সামনে একটা দর্পণ তুলে ধরেছেন। তাঁরা রাজপরিবারের সঙ্গে মিডিয়ার দীর্ঘ 'মাঝে মাঝে কুজ্ঝটিকাময়' সম্পর্কের বিষয়েও কিছু তেতো সত্য তুলে ধরেছেন, যেখানে রাজপরিবারের কোনো কোনো বিষয়ে মিডিয়াকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনধিকার চর্চা করতে দেওয়া হয়েছে স্রেফ জনগণের কথা ভেবে, যারা রাজপরিবারটিকে সোনায় মুড়ে রেখেছে আর পরিবারটিও তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু হ্যারির বইটি তাঁকে এমন এক অসুস্থ পরিস্থিতিতে নিয়ে গেছে, যেখানে প্রকাশ্যে লিনেন কাপড় ধোয়াটাকে মোটেও পরিবর্তনের সম্ভাবনার স্মারক বলে মনে করা যায় না এবং রাজনীতিটা একেবারেই ব্যক্তিগত কিছু হয়ে যায়।
প্রাসাদের এক কুটিরে দুই ভাইয়ের ঘুসাঘুসিটা দুঃখজনক সন্দেহ নেই; তবে তা হাস্যকরভাবে খুবই তুচ্ছ একটা বিষয়; কোনো ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই এমনটা বলা যায়। তাঁদের মায়ের মৃত্যুর সময় তাঁরা ছিলেন খুবই ছোট। তবে তখনও অন্তত এটুকু বলা যেত, তাঁরা একজন অপরজনের সঙ্গে যূথবদ্ধ। আর এখন আমরা বলতে পারি, আসলে তাঁরা তা ছিলেন না। হ্যারির কষ্টটা যে রয়ে গেছে তা বোঝা যায় যখন তিনি এ সপ্তাহে প্রচারিতব্য সাক্ষাৎকারের ট্রেলারে তাঁকে যেমনটা বলতে দেখা গেছে, তাঁর বাবা ও ভাইকে ফেরত পেতে চান। তবে তা যে হবে না, তাও বলে দেওয়া যায়। ছোট যুবরাজের ট্র্যাজেডি হলো, কোনো কিছু পাওয়ার জন্য তিনি যত কঠিন যুদ্ধ করছেন, বিষয়টা তাঁর পরিবারের মতো তাঁর বড় ভাইয়ের কাছেও গুরুত্ব পাওয়ার কথা, ততই তা হাত ফসকে দূরে চলে যাচ্ছে।
উইলিয়াম সবকিছু ঠিকঠাক চলছে এমন একটা ভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না; হ্যারিকেও শৈশব থেকেই 'রাজপরিবারের নিয়ম অনুসারে' সব সমালোচনাকে নীরবে হজম করে আসতে হয়েছে, যেগুলো অন্যথায় তাঁর ভাইয়ের ওপর বর্তাতো। এসবের পেছনে উদ্দেশ্য একটাই- রাজপরিবারের অস্তিত্ব টেকানো; যে কোনো মূল্যে তা করতে হবে, এমনকি এর ফলে সেই অতিরিক্ত যন্ত্রাংশ 'ছোট ভাই হ্যারি' বাতিলের খাতায় নাম লেখাতে বাধ্য হলেও। হ্যারির জন্মই হয়েছে প্ল্যান বি বা মূল খেলোয়াড়ের অনুপস্থিতিতে বিকল্প খেলোয়াড় হিসেবে। উপরন্তু, এ অবস্থানটাও তিনি ততদিন পেয়েছেন, যতদিন বড় ভাইয়ের কোনো সন্তান হয়নি। গত কয়েক শতাব্দী ধরে সেখানে দেখা গেছে এত কিছুর পরও রাজপরিবারের সদস্যরা মিলেমিশে থেকেছেন; কিন্তু ওই প্রায় সামন্ত রীতিনীতি হ্যারিকে রাজপ্রাসাদের স্থান করে দিতে পারেনি। হ্যারির এই দুঃখগাথা থেকে যদি আদৌ কিছু শিক্ষার নেওয়ার থাকে তা হলো, ক্ষমতার উত্তরাধিকার যেখানেই আছে সেখানেই গভীর অসুস্থ কিছু আছে; অন্তত অভিভাবকদের এ শিক্ষাটা মনে রাখতে হবে।
মনস্তত্ত্ববিদ ডরোথি রোই একবার লিখেছিলেন, সহোদরদের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে শেষ কথা হলো, একজন আরেকজনকে স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে মেনে নিচ্ছে কিনা। কারণ তারা এমন এক পরিবেশে বেড়ে ওঠে, যেখানে ক্ষোভ-প্রতিদ্বন্দ্বিতা, জয়-লজ্জা, ভালোবাসা ও ঘৃণা সবই অমোচনীয় শিক্ষা হিসেবে পাওয়া যায়। এগুলো আরও তীব্র হয়ে ওঠে যখন কে কাকে অধিকারহারা করবে এ নিয়ে উভয়ের মধ্যে মল্লযুদ্ধ বাধে; আর রাজমুকুটের মধ্যে যে অপরিসীম ক্ষমতা লুক্কায়িত থাকে তা নিয়ে এ যুদ্ধ বাধলে তো কথা নেই। সহোদরেরা সবকিছুর ওপর যা পেতে চায় তা হলো ন্যায্যতা; আরও সূক্ষ্ণভাবে বললে, তারা চায় অন্যজন যাতে পিতামাতার মনোযোগের আকর্ষণের যুদ্ধে এগিয়ে না থাকে। যে কোনো সন্তানের জন্য অন্য সহোদরের চেয়ে কম ভালোবাসা প্রাপ্তি আসলেই বিপর্যয়কর। এর নেতিবাচক প্রভাব অনেক গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী হয়। অন্য সব অতিরিক্ত সন্তানের জন্য যেমন, তেমনি হ্যারির জন্যও আমার প্রার্থনা তিনি যাতে শান্তি খুঁজে পান, যা তিনি স্পষ্টতই খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
গ্যাবি হিনস্লিফ গার্ডিয়ান পত্রিকার কলামিস্ট; দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তরিত
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com