
লিট ফেস্ট
আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে ভাঙল মিলনমেলা
প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২৩ । ০৪:২৫ | প্রিন্ট সংস্করণ
হামিম কামাল

লিট ফেস্টের শেষ দিনে রোববার বাংলা একাডেমিতে 'পুরুষত্ব বনাম পুরুষতন্ত্র' শীর্ষক আলোচনায় অতিথিরা - সমকাল
কুয়াশার চাদর সরিয়ে মিষ্টি রোদ। হাড়কাঁপানো শীতের প্রভাব কমার সঙ্গে সঙ্গে উষ্ণতা যেন অনেক বেড়ে গেল ঢাকা লিট ফেস্টে। গতকাল রোববার মিলনমেলার শেষ দিনে বেলা যত গড়িয়েছে, দর্শক-শ্রোতা ততই বেড়েছে। সকাল ৯টায় বাংলা একাডেমির লনে ঐতিহ্যবাহী কীর্তন সংগীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠানমালা। শেষ হয় বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে আলো ঝলমলে সন্ধ্যায় কোক স্টুডিও বাংলার সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে।
নোবেলজয়ী কথাসাহিত্যিক আবদুলরাজাক গুরনাহের শৈশবের গল্প থেকে শুরু করে জীবনের অনুধাবন ও তাঁর শেষ হাসিটুকু, সংগীতশিল্পী নবনীতা চৌধুরীর নারীবাদবিষয়ক নান্দনিক কথামালা, বিশ্বায়নের কালে ভবিষ্যতের কবিতা নিয়ে জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার আলাপ, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক কোচ গর্ডন গ্রিনিজের হাস্যোজ্জ্বল উপস্থিতি, সে সঙ্গে ২০২২ সালে বুকারজয়ী লঙ্কান কথাসাহিত্যিক শেহান করুণাতিলাকার নিজ উপন্যাস নিয়ে উচ্ছল আলাপে উষ্ণ পরিবেশ ছিল পুরো দিন।
তানজানীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সাহিত্যিক আবদুলরাজাক গুরনাহ হলেন প্রায় চার দশকের ব্যবধানে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ। ২০২১ সালে নোবেল পান তিনি। এর আগে ১৯৮৬ সালে নাইজেরীয় সাহিত্যিক ওলে সোয়িঙ্কা এ সম্মান অর্জন করেছিলেন। সময়ের এমন ব্যবধানের মাঝে লুকিয়ে আছে কালোদের ওপর যাবতীয় নিষ্পেষণ, দেশত্যাগে বাধ্য করা, কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি, চাপিয়ে দেওয়া দারিদ্র্যের শত প্রকার আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে গুরনাহের প্রায় একক সংগ্রামের তীব্রতার গল্প। স্বদেশ ছেড়ে নতুন দেশে স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত হয়ে ওঠা নোবেল বিজয়ী মানুষটি যখন অনুষ্ঠানের শেষ প্রশ্নে মিষ্টি হেসে বলেন" নাহ, কোনো অভিযোগ নেই। সবকিছু ভীষণ সুন্দর ছিল, তখন মানুষের ইতিবাচকতার এক শাশ্বত দৃষ্টান্ত তৈরি হয়ে যায়। গুরনাহের সঙ্গে আবেগমথিত হয়ে পড়েছিলেন হলভরা দর্শক-শ্রোতা। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে 'ডেজারশান' শীর্ষক গুরনাহের সঙ্গে এই বৈঠক সবার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। অনুষ্ঠানে গুরনাহ লিখিত ডেজারশান, বাই দ্য সি, মেমোরি অব ডিপারচার, পিলগ্রিমজ ওয়ে প্রভৃতি গ্রন্থ নিয়ে আলাপ উঠে আসে।
একই সময়ে অনুষ্ঠিত 'বিশ্বায়নের কালে ভবিষ্যতের কবিতা' শীর্ষক আলোচনায় কবি আশরাফ জুয়েলের সঞ্চালনায় প্রাজ্ঞ অভিমত রেখেছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ও পশ্চিমবঙ্গের বিনয় মজুমদার পুরস্কার বিজয়ী কবি গৌতম গুহ রায়। নূরুল হুদা বাংলাকে পৃথিবীর শক্তিময় ভাষাগুলোর একটি হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, বিশ্বায়নের কবিতা হবে মুক্ত কবিতা। নিজ ভাষার গভীরে চেতনার শিকড় বিস্তৃত করতে হবে এবং নিজ সাহিত্য অনূদিত করে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে হবে। গৌতম গুহ রায় মনে করেন, বিশ্বায়নে পৃথিবীর ভাষাগুলো, মূলত ভাষার মানুষগুলো আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, যা মন ও মননের অসংখ্য দরজা খুলে দেবে।
সকাল সোয়া ১১টায় লেখক ও গবেষক ফারহানা মান্নান ও তাঁর দল মঞ্চায়িত করে 'শৈশব'। বিখ্যাত রুশ উপকথা আইভানের নাট্যরূপ অভিনীত হয়। শিশুরা উপভোগ করে আনন্দঘন মুহূর্ত। তাঁদের উপস্থাপনা শিশু ও অভিভাবক উভয়ের জন্যই বার্তাবাহী ছিল। শিশুরা আরও আনন্দের সঙ্গে পাঠে ও শরীরচর্চায় অনুপ্রাণিত হয়। আর বড়রা পান শিশুদের সুন্দর শৈশব উপহার দেওয়ার দিকনির্দেশনা।
বাংলা একাডেমির লনে দুপুর সাড়ে ১২টায় অনুষ্ঠিত হয় 'পুরুষত্ব বনাম পুরুষতন্ত্র' শীর্ষক প্রাণবন্ত আলোচনা। সাংবাদিক অভিনেত্রী বন্যা মির্জার সঞ্চালনায় আলাপে অংশ নিয়েছিলেন সংগীতশিল্পী ও ব্র্যাকের জেন্ডার কর্মসূচির পরিচালক নবনীতা চৌধুরী, অভিনেতা ইরেশ যাকের, অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন, ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি প্রোগ্রামের অ্যাডভোকেসি লিড তাকবির হুদা, ব্র্যাকের সেন্টার ফর জেন্ডার অ্যান্ড সোশ্যাল ট্রান্সফরমেশনের ভিজিটিং ফেলো মাহীন সুলতান, ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেটিকস ডেভেলপমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাঈদ আহমেদ এবং মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী তাসাফি হোসেন। এতে উঠে আসে সম্পদে ও সন্তানে নারীর সমঅধিকারের কথা, ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টির গুরুত্ব প্রভৃতি। নবনীতা বলেন, নারীবাদ পুরুষতান্ত্রিকতার বিপরীতে মাতৃতান্ত্রিকতার কথা বলে না, সমতার কথা বলে। অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন তাঁর বিয়েবিচ্ছেদের পর সন্তানকে লালনপালনের অধিকার নিয়ে লড়েন এবং শরিয়াহ আইনে কিছু বাধার সম্মুখীন হন। পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থার সঙ্গে শরিয়াহ আইনে যথাযথ মানবিক পরিমার্জন আনা যেতে পারে বলে মত ব্যক্ত করেন তিনি।
বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে বিকেলে অনুষ্ঠিত হয় 'অনুবাদ :সাহিত্যের ছায়া' শীর্ষক আলোচনা। স্প্যানিশ ভাষা বিশেষজ্ঞ, অনুবাদক ও শিক্ষক রফিক-উম-মুনীর চৌধুরীর সঞ্চালনায় আলাপে অংশ নিয়েছিলেন বিশিষ্ট অনুবাদক ও শিক্ষক জি এইচ হাবীব ও আফসানা বেগম। উপস্থিত ছিলেন লেখক, অনুবাদক ও পরিব্রাজক ফারুক মঈনুদ্দিন। অনুবাদ সাহিত্যের ছায়া কথাটির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন জি এইচ হাবীব। তিনি মনে করেন, অনুবাদ বহুমাত্রিক; এবং সাহিত্য তো বটেই।
এ ছাড়া নিজ উপন্যাস নিয়ে আলাপে বরাবরের মতোই সপ্রতিভ ছিলেন বুকারজয়ী লঙ্কান সাহিত্যিক শেহান করুণাতিলাকা। সেভেন মুনস অব মালি আলমেইদা উপন্যাসের চরিত্র, চরিত্রের পেশাগত ও অতি ব্যক্তিগত জীবন, রাজনীতি এবং এমন চরিত্র সৃষ্টির প্রেরণা নিয়ে আলাপ করেন প্রখ্যাত বুক এজেন্ট কনিস্ক গুপ্তের সঙ্গে। ব্রিটিশ রন্ধনশিল্পী ভ্যালেন্টাইন ওয়ার্নার বৈশ্বিক খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস নিয়ে প্রাণবন্ত আলাপ করেন লিট ফেস্টের অন্যতম আয়োজক সাহিত্যিক আহসান আকবরের সঙ্গে।
বেলা যত গড়াতে থাকে, ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয় নিরাপত্তাকর্মীদের। তরুণ-তরুণীদের বিপুল সমাগমে সংগীত পরিবেশনের জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে কোক স্টুডিও বাংলার মঞ্চ। মূর্ছনা ওঠে- বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিস নে আজি দোল। দর্শক-শ্রোতার উল্লসিত অভিব্যক্তির ভেতর দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে লিট ফেস্টের দশম আসরের। আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে ভাঙল মিলনমেলা।
গত বৃহস্পতিবার শুরু হয়েছিল চার দিনের এ আয়োজন। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ সাহিত্য সম্মেলনে ১৭৫টির বেশি সেশনে পাঁচ মহাদেশের বিভিন্ন অঙ্গনের পাঁচ শতাধিক আলোচক অংশ নেন।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com