শ্রদ্ধাঞ্জলি

নাটকবিষয়ক প্রবন্ধের সমান্তরাল চিন্তায়

প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

লুৎফর রহমান

সেলিম আল দীন [১৮ আগস্ট ১৯৪৯-১৪ জানুয়ারি ২০০৮]

প্রবন্ধের শিরোনাম- বাংলা নাটকে আঞ্চলিক ভাষা:নাট্যকার সেলিম আল দীনের নাটক 'হাতহদাই' ও 'কিত্তনখোলা'। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিবেচনা করুন, বিষয়টির প্রথম শর্ত 'বাংলা নাটকে আঞ্চলিক ভাষা'। দ্বিতীয় শর্ত- সেলিম আল দীনের নাটকে আঞ্চলিক ভাষার বিশিষ্টতা। তৃতীয় ও চতুর্থ শর্ত- 'কিত্তনখোলা' ও 'হাতহদাই' নাটকে সেলিমের ভাষা এবং পঞ্চম শর্ত- বাংলা নাটকের আঞ্চলিক ভাষার ইতিহাসে তাঁর অবস্থান নির্ণয়। এতোগুলো সমস্যার সমাধান একটি প্রবন্ধের আয়তনে অকল্পনীয়। পাঁচটি অধ্যায়ে বিশিষ্ট একটি পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় এটি। 

আধুনিক বাংলা নাটকে প্রারম্ভকাল থেকেই আঞ্চলিক ভাষার নানামাত্রিক ব্যবহার রয়েছে। এই রচনায় কিছু নাট্যকারের নাম আছে বটে, কিন্তু তার বাইরে রয়েছেন আরও অনেকে। তাঁরা হলেন- বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, বাদল সরকার, মনোজ মিত্র, আবদুল্লাহ আল-মামুন, মামুনুর রশীদ, এস এম সোলায়মান প্রমুখ। হতে পারে তাঁরা একটি স্বতন্ত্র ভাষারীতির জনক নন, কিন্তু 'বাংলা নাটকে আঞ্চলিক ভাষা' এই শিরোনামের পরিধিতে তাঁরাও অগ্রাধিকার পাবার দাবিদার। আঞ্চলিক ভাষার শক্তি; তার শব্দসম্পদ, জনপদবাসীর জীবন-সংগ্রামের হাতিয়ার তাদের ভাষায় অধিবাসীগণের মনস্তত্ত্বের রূপটি; ভাব, আবেগ প্রকাশের ভঙ্গি, তার গতি-প্রকৃতি কীরূপে ধরা পড়েছে তার বৈজ্ঞানিক, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যসমেত উপস্থাপন করা হয়েছে বাংলা ভাষায় এমন পুস্তক দুর্লভ। আঞ্চলিক ভাষা যেমন অঞ্চল বিশেষের প্রতিনিধিত্ব করে, তেমনি ভাষাভাষীর অস্তিত্বেরও। সেই বিশেষ অঞ্চলের ঐতিহাসিক সমাজতাত্ত্বিক বিকাশের, তার ধর্মবিশ্বাস, পুরাণ, লোকাচার ও লোকসংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশে সেই ভাষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নাট্যকার জীবনের রূপকার; সমাজের বিরোধী শক্তি, কায়েমি স্বার্থবাদীর সঙ্গে গণমানুষের জীবন-সংগ্রামের দ্বান্দ্বিক রূপটি তিনি সর্বসমক্ষে বিশেষভাবে মূর্ত করেন। সুতরাং রচয়িতা নাট্যকারের সমাজদর্শন, গণমানুষের সামাজিক-আর্থনীতিক অবস্থা উপস্থাপনায় তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের অভিব্যক্তি হোক ভাষিক কিংবা শারীর ভাষা- তার অবয়বটি; ব্যাকরণটি তার বিবর্তন রেখাটি দেখানোর মাধ্যমেই গবেষণা একটি পরিণতি পায়।

অনস্বীকার্য যে, নাটকের ভাষাবিষয়ক আলোচনা কেবল একটি বা দুটি চরিত্রের বাছাইকৃত সংলাপের উদ্ধৃতি দান বা তার ব্যাখ্যা নয়। ব্যবহূত প্রতিটি শব্দের অর্থসংকেত যাচাই করা; প্রতীক, রূপক, সংকেতের অর্থগত তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা এবং তা নাটকের প্রতিপাদ্যের সঙ্গে কোন বিশেষ অর্থে অন্বিত তা অনুসন্ধানও। নাটকের আখ্যানের উত্থান-পতন, চরিত্রের আত্মিক, পরমার্থিক এবং সমাজমনস্তাত্ত্বিক অবস্থা প্রকাশে ভাষার ভূমিকা অনুসন্ধানও গবেষকের কর্তব্যের অন্তর্গত। শুধু তাই নয়, নাটকের ভাষা, নাট্যকারের ভাষা এবং চরিত্রের ভাষার ব্যবধি চিহ্নায়নও গবেষকের দায়িত্বের অঙ্গীভূত। শাস্ত্রীয় বিবেচনায়, ভাষাতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ, সম্পূর্ণতই 'ভাষাবিজ্ঞানে'র (philological) দৃষ্টিকোণ। এর প্রধান বিবেচ্য আবার রূপতত্ত্ব (morphology), শব্দার্থবিজ্ঞান (semantics), সংকেতবাদ (semiotics), নন্দনতত্ত্ব (aesthetics), সমাজমনোবিদ্যা (socialpsychology) ইত্যাদি জ্ঞানকাণ্ডের পর্যবেক্ষণ। যেকোনো সাহিত্যকর্মের ভাষা সম্বন্ধীয় অর্থবহ গবেষণা তাই শ্রমসাধ্যকর্ম।

আঞ্চলিক ভাষার গবেষণা উল্লিখিত বিবেচনায় অপেক্ষাকৃত জটিল। কেউ প্রশ্ন করতেই পারে, একটি গবেষণার জন্য এত শ্রমস্বীকার করা? আঞ্চলিক বাংলা ভাষার আত্মার শক্তিকে আবিস্কার করে তাকে সৃজনশীল সাহিত্যের বাহন করবার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি করতে হবে। নাটক গণমানুষের সমবপদ হলে তা তাদের ভাষায়ই লেখা উচিত। জীবন তাদের, যাপন ও সংগ্রাম তাদের ভাষা কেন ভদ্রলোকের, ক্ষমতাবানের হবে? তাই নাটকের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব আলাদা। সাধারণের জীবনের সংকটগুলো নাটক দেখায়, ব্যাখ্যা করে এবং বিদ্যমান দ্বন্দ্বের অবসানের উদ্দেশ্যেই সে তা করে। 

ধরুন-নাটকে আঞ্চলিক ভাষা :নাট্যকার সেলিম আল দীনের 'হাতহদাই' ও 'কিত্তনখোলা' শিরোনাম ঠিক হলো। এই প্রকল্পটিও কিন্তু সহজ নয়। 'কিত্তনখোলা'র ক্যানভাসটি আসুন ধরে নিই, অঙ্কন করেছেন আয়াসখুলুস। এ-কথা বলবার অর্থ অচেনার প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি উদার হয়ে থাকে। অজানাকে জানার প্রয়াস থেকেই অনুসন্ধান চলে গভীরতলে, সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণভাবে- তাই উচ্চতার সঙ্গে বিস্তার এবং বোধের সূক্ষ্ণত্ব ধরা পড়ে। সেই অচেনার বিন্দু থেকে আপনার মননের পরিধিকে দিগন্তে বিস্তৃত করে দেখুন তো 'কিত্তনখোলা'র বিস্তারটি বিস্ময় উদ্রেক করে কী না! একটি গ্রামীণ মেলার ক্যানভাসে অসংখ্য ছবি, বিচিত্র বিন্যাস, বহুমাত্রিক কর্মযজ্ঞ। প্রত্যেক মানুষ তার ভৌগোলিক, সমাজতাত্ত্বিক, মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, বৈশিষ্ট্যসমেত মেলায় উপস্থিত। ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যে এসেছে তারা- কিন্তু পেছনের দুঃখতাড়িত, বঞ্চিত, পরপীড়িত জীবন ও যাপনের অভিজ্ঞতা ও অবিস্মরণীয় স্মৃতি সঙ্গে এসেছে তাদের। এনেছে উৎপন্ন পণ্যসামগ্রীও। কিনতে এসেছে সখের আলতা, রেশমি চুড়ি, যৌনসক্ষমতার ওষুধ, বাচ্চার খেলনা, চরিত্র বদলের, রূপবদলের মুখোশ। তাড়ি খেতে, মৃগীরোগের চিকিৎসার ষুধ খুঁজতে। ফাঁদে ফেলতে, জিঘাংসা চরিতার্থ করতে, রংবিহীন নিজের দুঃখভরা জীবনের কথা ভুলে বায়স্কোপের ভেতরকার রঙিন জীবন দেখতে। আধ্যাত্মিক জ্ঞানের আলোয় অন্তর আলোকিত করতে এসে বসেছে মেলার কবিগানের আসরে। অন্যের জীবনের আয়নায় নিজের ভাঙা-বেঁকা-তেড়া জীবনকে দেখে নিতে যাত্রাদলের প্যান্ডেলে ভিড় করেছে গ্রামীণ খেটে খাওয়া মানুষ। 

বৃত্তিভেদে, শ্রেণিভেদে বিভক্ত মানুষগুলোর জীবন কোনো বিবেচনায়ই অকিঞ্চিৎকর নয়। তাদের জীবনের মতোই বৈচিত্র্যপূর্ণ তাদের ভাষা। মেলার জীবনের এক একটা অংশে এক-একজন নায়ক হয়ে ওঠে- সেটা অবশ্য সামাজিক জীবনেরও এক-একটা অংশ। প্রতিরোধ সৃষ্টির চেষ্টায় মরিয়া তারা। যাত্রার প্যান্ডেলে তার রূপ, তার ভাষা এক রকম; তাড়ির দোকানে অন্য রকম; জুয়ার পটে তা থেকে ভিন্ন; কবির লড়াই আর এক ভুবন যেন- সে ভুবনের ভাষা আলো-আঁধারি; লাওয়াদের মেয়েদের দোকানের চেহারা এক, ভাষা এক- কেনাবেচা সত্য-মিথ্যার বাঁধনে বাঁধা সে ভাষা; তাদের বাসস্থান নৌকার ভাসমান আধিপত্যবাদী সমাজের চেহারা, শাসন, ভাষার আরেক রূপ; জীবনের প্রকৃত অভিব্যক্তি প্রকাশের ভাষা তাদের গোষ্ঠীভাষা। সোনাইয়ের অন্তরের, আর ইদু কন্ডাকদারের অন্তরের ভাষা ভিন্ন ভিন্ন। জীবনের সেই বিশাল বিস্তারের জন্যই একে বলা হয়েছে মহাকাব্যিক নাটক।

ভিন্ন ভিন্ন সমাজ থেকে আসা এই নাটকের সকল চরিত্র আবার মেলায় উপস্থিত হয়ে অন্য এক সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে- তারা সকলেই নাট্যকারের উদ্দেশ্যের স্রোতে বাহিত হচ্ছে এক মহাজীবনের সাগরসঙ্গম অভিমুখে। একটি বা দুটি দৃষ্টান্ত সেই মহাজীবনের অন্তর্গত অস্তিত্ব এবং তার সুরভি প্রকাশের জন্য যথেষ্ট বিবেচিত হতে পারে না। প্রাত্যহিক জীবনের প্রয়োজনের ভাষা শিশুর মতো শিল্পের কোলে উঠতে চাইলে তখন তা কেজো ভাষার গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে না; তা শিল্পীর সৃজন-যুদ্ধের হাতিয়ারে পরিণত হয়; শিল্পী তাঁর সৃজনকল্পনা, উদ্ভাবন কৌশলে, মাজা-ঘষা, তেল-প্রসাধনে তাকে চোখ ধাঁধানো রূপে উপস্থিত করেন তাঁর রচনার অঙ্গরূপে। সেই ভাষার উপাদানগুলো ভাষাভাষীর কিন্তু রচয়িতার প্রয়োজনের চাপে, প্রয়োগের কারিগরি দক্ষতায়, সৃজনকল্পনার কামারশালায় এসে ঘটেছে তার রূপান্তর। তা আঞ্চলিক শব্দে, কথন-ভঙিতে গড়া শিল্পের ভাষা, শিল্পীর ভাষা। তার বাক্যকাঠামো, শব্দবিন্যাস, অন্তর্গত ধ্বনি-তরঙ্গ, অর্থ-সংকেত, চিহ্নায়ন প্রক্রিয়া শিল্পীর; রচয়িতা তাঁর প্রয়োজনের সাপেক্ষে লোকভাষার এক স্বতন্ত্র গড়ন দান করেন। 'কিত্তনখোলা'র নিচের সংলাপটি দৃষ্টান্ত হিসেবে পরীক্ষা করা যেতে পারে- 

'চতুর্থ সর্গ'

আজিব পঙ্খীর ডিম ও সোনাই

কবির লড়াই-এর আসর। চারপাশে গোল হয়ে বসেছে মেলায় আগত মানুষেরা। বছির-মংলা ও অন্য একজন দোয়ারকির সারিতে। লড়াই-এর মাঝামাঝি সময়। বছির ঢাক কুড়কুড় ঢোল বাজাচ্ছে। কান ফাটানো রক্ত উথাল করা শব্দ। জুৎ-মতো সারা আসরে হর্ষোৎফুল্ল জনতা চিৎকার করে ওঠে। সোনাইও আছে একেবারে সামনের সারিতে। শামছল বয়াতির পক্ষে ধ্রুপদ। হাশেমরে করি মানা- এমন প্রেম আর কইরো না। রূপবান ছাড়া বিরথা তুমি রহিম বাশ্‌শা সাইজো না।

হাশেম। আপনে যদি কৃষ্ণ হবেন। আমি রাধা হইতে রাজি। মিঞা বাইরা অক্ষণে যান - ডাইকা আনেন এট্টা কাজী।

শামছল। রাধা হওনের অনেক জ্বালা- গলাতে কলঙ্কের মালা- আরে তাইতো তোমায় করি মানা - 

এমন প্রেম আর কইরো না-" [সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র ২, ২০০৬, ১০৯-১১০]

উদ্ধৃতাংশে দুটি ভাষারূপ বিদ্যমান। প্রথমটি মান বাংলা, লেখকের উপস্থাপনার ভাষা। শব্দবাহুল্য, আবেগবর্জিত এ-ভাষা আসরের পরিবেশ বোঝাবার জন্য সৃষ্ট। আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহারের কোনো প্রয়াস নেই। নাট্যাংশে উপস্থিত চরিত্রদের কে, কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ তাই বলা হয়েছে শুধু। পরের অংশের ভাষা চরিত্রের ভাষা। তারা একটি প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে বিবদমান। এবং লোকপুরাণের একটি আখ্যানকে গানে কথায় তাত্ত্বিকভাবে উপস্থাপন করছেন কবিরা। গান বলা হলেও তা আসলে অভিনয়- দু'জন দুটি চরিত্র রূপায়ণের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করেছেন। সংলাপগুলো তাই ভাবপ্রধান। মুখ্য বিষয় প্রেম- রাধা-কৃষ্ণের লোকপুরাণ কথিত প্রেমোপাখ্যানকে আধ্যাত্মিকতার আলোয় দেখা, দেখানো। চৈতন্যোত্তর অচিন্ত্যদ্বৈতাদ্বৈতবাদী চেতনা এর মর্মে স্থিত। সুতরাং রচয়িতা ভাষাকে আলো-আঁধারি একটি অবয়ব দান করেছেন। অবশ্যই একে বিশুদ্ধ আঞ্চলিক ভাষা বলে অভিহিত করা যৌক্তিক বোধ হয় না। কেবল আঞ্চলিক শব্দগুলো ছাড়া বাকি সকল বৈশিষ্ট্যে এর চারিত্র্য স্বতন্ত্র। 'কিত্তনখোলা'র আরেকটি সংলাপ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে আঞ্চলিক ভাষা কী করে চরিত্র বিশেষের বৈশিষ্ট্যের দ্যোতক হয়ে ওঠে। যেমন- 

রবিদাশ: মনের উপর জোর খাটে না।

বনশ্রী: আমার মনের কতটুকুন জানো রবি দা।

রবিদাশ: থাক সে কথা। দুকখু থাকে - মানুষের বিপজ্জয় আসে। কিন্তুক তারে সহ্য করনের ক্ষমতা নাই  তোমার।

- কাল মদ খেয়েছিলে ক্যান।

 বনশ্রী: এবার খিল খিল করে হাসে - সুখে রবি দা। কিত্তনখোলার আড়ং - এতো লোকজন - নাচগান 

দেইখা আর সুখ চাপতে পারি নাই। মন বদলাতে হলে রূপটাও বদলাতে হয়। নাইলে কাজ হয় না।" (পঞ্চম সর্গ, প্রাগুক্ত, ১১৯)



উদ্ধৃতাংশের ভাষা কেবলই কি আঞ্চলিক? আঞ্চলিক ভাষার শব্দের সাথে অনায়াস অসংকোচে মেশানো মান বাংলার শব্দ। আঞ্চলিক ভাষার শব্দ ও মান বাংলার শব্দ দ্বারা গঠিত এই ভাষা চরিত্রের বেদনাহত হৃদয়ের কান্নাভেজা অনুভবের অভিব্যক্তির সমান্তরাল আলাদা এক ভাষা, যা কেবল রবিদাশ, বনশ্রীর জীবনের কিংবা তাদের সমপর্যায়ের জীবনাভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞজনের ভাষা; নাট্যকার সৃষ্ট এক শিল্পিত ভাষা। জীবন বাস্তবতা যেমন শিল্পের বাস্তবতা নয়, তেমনি আঞ্চলিক ভাষাও সম্পূর্ণত ও প্রকৃত আঞ্চলিক ভাষা নয় - শিল্পসৃষ্টির অভিপ্রায়ে বিশেষভাবে সৃষ্ট শিল্পীর নিজস্ব এক ভাষা। চরিত্রের উক্তিপ্রত্যুক্তির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে এই ভাষা এক পর্যায়ে উচ্চতর দার্শনিক চিন্তার বাহন হয়ে ওঠে - যেমন,

বনশ্রী: ঠিক আছে। চুপ করবো। তা সকাল থিকা নাকার উঠতিছে - এট্টু টক খালি পরে আরাম  লাগতো। আমারে এট্টু লেমু নয় তো তেঁতুল দেও রবি দা।

  রবিদাশ: লও দুইটা আমলকী আছে। 

বনশ্রী: আমার খাওয়া খাবে- এঁটো খাবে। ছোটো জাতের এঁটো। হি হি হি।

রবিদাশ হাত বাড়িয়ে নেয়- ফলটা একই জাতের।

বনশ্রী: (খেতে খেতে) - এট্টা ফলের মদ্যি এত রঙের সোয়াদ ক্যান। কষটা লাগে - চুকা লাগে -

নোনতাও লাগে - বেশি চাবাতি গেলে তিতা -

রবিদাশ: ফলটা তোমার মতো। এক সোয়াদ থিক্যা আরেক সোয়াদে মিশা যায়। কোনটা যে আসল কওন যায় না।



বনশ্রী: কবিরাজে কয়- আমলকী রক্ত সাফ করে। আচ্ছা তুমি যখন ভিখিরির ছেলের মধ্যি জীবন জীবন জীবন রে বলে চিৎকার করো- তখন আমার ইচ্ছা করে মরে যাই। জীবন কিসের নাম। কোন পালাকার নিখেছে এই ডাইলগ। - যখন ডাকো কোনো মানুষ আসে না। বিবেক দেওয়ান- এনায়েত আসে না। শূন্যি আসরে কারে ডাকো তুমি। (প্রাগুক্ত, ১২০-১২১)



উদ্ধৃতির ভাষাটি আঞ্চলিক শব্দে রচিত কিন্তু আঞ্চলিক ভাষা নয়, মানবাংলার অনেক শব্দ রয়েছে এতে। নাটকের ভাষা কেবল সংলাপ নয়, তা চরিত্রের প্রতিরূপ- তার অন্তর্গত অস্তিত্বের অভিজ্ঞান। 'কিত্তনখোলা' নাটকে সমাজের ভিন্ন ভিন্ন পেশার গ্রামীণ মানুষ তাদের জীবন, যাপন ও জীবিকার বিশেষত্ব সমেত উপস্থিত। সমাজের প্রতিটি অংশের পেশাজীবীদের ভাষা বৈশিষ্ট্য আলাদা- চলচ্চিত্রের ভাষা, থিয়েটারের ভাষা, নাটকের ভাষার মতোই তারা যৌক্তিক কারণেই আলাদা। চরিত্রের মতো নাটকের ভাষাও সামাজিক শ্রেণির প্রতিনিধি- সুতরাং দু'একটি চরিত্রের উক্তি বিচার করে এমন একটি গ্রন্থের ভাষারীতির পূর্ণাঙ্গ পরিচয় জ্ঞাপক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অসমীচীন। 

প্রবন্ধের হ্রস্বকায় আয়তনে লেখক নির্বাচিত দ্বিতীয় গ্রন্থ 'হাতহদাই'য়ে ব্যবহূত ভাষাবিচার কষ্টকল্পনাজাত প্রয়াস বইকি। শেষোক্ত গ্রন্থের আখ্যান একাধিক মহাদেশে পরিব্যাপ্ত। ভিন্ন ভিন্ন ভূগোল, সমুদ্র, উপকূলবর্তী অঞ্চল, সমুদ্রবন্দর, ক্যাসিনো, ইত্যাদি পরিবেশে বহমান বিচিত্র জীবন; নানান জনপদের জীবনের নানারূপ- মুখ্যত নোয়ালী সমুদ্র উপকূলের মানুষ ও জাহাজীদের ভাষা 'হাদহদাই'য়ের অবলম্বন হলেও এর ভাষা সমুদ্রের; সমুদ্রগামী মানুষের; উপকূলবর্তী জীবনের নোনা গন্ধ তার ধ্বনি, শব্দ, বাক্যে এবং যাপনের জোয়ার-ভাটায় নিহিত। সে ভাষার স্বরূপ আবিস্কার আরও শ্রমসাধ্য। তা নিশ্চয়ই স্বতন্ত্র স্থান ও পরিধি দাবি করে। 

সেলিম আল দীন আমৃত্যু তাঁর সৃষ্টির বিভিন্ন দিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, এ-বিষয়টি এখন অতিকথনে ক্লিষ্ট। কেবল আঙ্গিক নিয়েই নয়, নাট্যভাষা তাঁর বিশেষ ভাবনার বিষয় ছিল। ছিল এ-কারণেই যে, তিনি নাটককে মঞ্চায়তনের বাইরে একটি স্বতন্ত্র আসন অবস্থান দিতে চেয়েছিলেন। নাটককে পাঠ্য-সাহিত্যের মর্যাদা ও মহিমায় উন্নীত করবার পক্ষপাতি ছিলেন। তাই বিষয়ের উচ্চতা, চরিত্রের বলিষ্ঠতা এবং আখ্যানের মধুকোষ রচনার জন্য সবকিছুর বাহন ভাষাকে সমুন্নত বিষয়-ভাব-শৈলীর উপযোগী করবার সক্রিয় চিন্তা তাঁর ছিল। এতদ্বিষয়ে, 'দিনলিপি'গ্রন্থের এক জায়গায় তিনি লিখেন- 

"আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই 'আমার ভাষা এই ১৩৯৫ সালে লৌহ যুগে প্রবেশ করল।' আমার কৈশোরে বোধ শিকারে যে ভাষাঅস্ত্র ব্যবহার করতাম সে ছিল প্রত্নপ্রস্তর যুগের পাথর। জন্ডিস নামের আধো-আলো অন্ধকারে যে অস্ত্র শানালাম সে থেকে আমার ভাষার জন্য প্রস্তরযুগের শুরু। শকুন্তলায় ব্রোঞ্জের কাল অতিক্রম করেছি- কিত্তনখোলায় হোল আমার লৌহ যুগের শুরু। আমি খুব টের পাই আজকাল ভাষা আমার ভীষণ বন্ধু। সব বিষয়েই একমত হতে পারি ওর সঙ্গে। আমার মনে হয়, এমন কোনো দৃশ্যমান অথবা অদৃশ্য কিছুই নেই যা আমি তৎক্ষণাৎ ভাষায় রূপান্তরিত করতে পারি না। সমুদ্রের শঙ্খ, আকাশের মেঘ, কুষ্ঠের ক্ষত সব যেন ভাষার বন্ধনে ধরা দেয়। (১৯৮৮ সালে রচিত দিনলিপি) "

নিজ ভাষার যে-বিবর্তনরেখাটি তিনি দেখিয়েছেন তা এই ইঙ্গিত প্রদান করে যে, ভাষা তাঁর কাছে প্রিয়তম বন্ধুর মতো, যেমন খুশি তিনি তার সাথে খেলা করেন। বলা যায়, খেলতে পছন্দও করেন তিনি। কাজেই লৌহ যুগের পর সেলিমের ভাষা কোন্‌ যুগে প্রবেশ করেছে, আর কোনো নতুন দিগন্ত খুঁজে পেয়েছে কি-না সেটা অনুসন্ধান করাই সেলিম আল দীন গবেষকের অন্বিষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com