
সাক্ষাৎকার: সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
পরিবেশবাদী রাজনৈতিক দল গঠনের সম্ভাবনা এ মুহূর্তে দেখছি না
প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২৩ । ০৩:৩৩ | প্রিন্ট সংস্করণ
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: শেখ রোকন ও মিজান শাজাহান

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ফ্রেন্ডস অব আর্থ ইন্টারন্যাশনাল এবং আইইউসিএনের নির্বাহী সদস্য। ১৯৯২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক, পরের বছর স্নাতকোত্তর এবং ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আইজেনহাওয়ার ফেলোশিপ সম্পন্ন করেন। পরিবেশবিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টির স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৭ সালে জাতীয় পরিবেশ পদক, ২০১২ সালে র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার এবং প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ২০০৯ সালে 'পরিবেশের নোবেল' খ্যাত গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্টাল প্রাইজে ভূষিত হন তিনি। ২০০৯ সালে টাইম সাময়িকী তাঁকে হিরোজ অব এনভায়রনমেন্ট খেতাবে ভূষিত করে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কার্যকর উদ্যোগের জন্য তাঁর নেতৃত্বাধীন বেলা সম্মানজনক ট্যাংগ পুরস্কার লাভ করে। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের জন্ম ১৯৬৮ সালে, ঢাকায়।
সমকাল: নতুন বছরে পা দিয়েছি আমরা। বিদায়ী বছরে বাংলাদেশের পরিবেশগত চিত্র কেমন ছিল?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: আশান্বিত হওয়ার মতো কিছু ছিল না। বৈশ্বিক বিবেচনায়ও ১৮০টি দেশের মধ্যে পরিবেশগতভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৯। বায়ুদূষণের কথা বললে আমরা সবচেয়ে বেশি দূষণের নগরীতে ছিলাম। বন উজাড়ের দিক থেকেও আমাদের খুবই করুণ অবস্থা। এখন যদি পরিবেশের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কথা বলেন, পরিবেশের জন্য অর্থ বরাদ্দের কথা বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক সম্পৃক্ততার কথা বলেন- কোনো দিকেই কিন্তু আমরা এগোতে পারিনি। দেশের দিকে খেয়াল করলে দেখবেন, বেশ কিছু বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মধ্য দিয়ে আমরা গেছি। একটি আশার কথা হলো কপ টোয়েন্টিসেভেনে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে বারবার ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার লক্ষ্যে লস অ্যান্ড ডেমেজ তহবিল গঠনের ঘোষণা এসেছে।
সমকাল: সেটি তো বৈশ্বিক অর্জন।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: ঠিকই বলেছেন। যদিও সেই তহবিল এখন শূন্য, সেখানে এক টাকাও জমা পড়েনি। তারপরও এটিকে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশের জন্য প্রাথমিক নৈতিক ও আইনি বিজয় হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। এটি অভ্যন্তরীণ অর্জন না হলেও যদি আমরা উন্নত বিশ্ব থেকে লস অ্যান্ড ড্যামেজের অর্থ আদায় করতে পারি, তাহলে এটি অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলবে। এখানে আরেকটি উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, এই তহবিল গঠনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল বড় ভূমিকা রেখেছে।
সমকাল: বিদায়ী বছরের বৈশ্বিক পরিবেশগত পরিস্থিতি কেমন ছিল?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: সবচেয়ে বেশি গরমের বছর ছিল ২০২২। ইউরোপের দেশগুলোতে যেভাবে তাপদাহ হয়েছে, এমনকি যুক্তরাজ্যের মতো দেশ থেকে বলা হচ্ছিল, তাওয়া নিয়ে বাগানে বসে ডিম পোচ করা যাচ্ছিল। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানে ভয়ংকর বিপর্যয়কর বন্যা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতি রোধে আমরা যে পিছিয়ে পড়েছি- গত বছরের তাপদাহ, বৃষ্টিপাতহীনতা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় সে কথাটা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে। আমাদের তাত্ত্বিক অর্জন হয়েছে। লস অ্যান্ড ড্যামেজের কথা, যেটি আগেই বলেছি। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আন্তর্জাতিক কনভেনশনের অধীনেও একটি গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজি প্রণীত হয়েছে।
সমকাল: ওই কপ তো কানাডায় হলো। আপনি গিয়েছিলেন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: না, আমি যাইনি। কিন্তু নিবিড়ভাবে নজর রেখেছিলাম। ওই কৌশলে বলা হয়েছে- ভূখণ্ডের জীববৈচিত্র্য ও সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ২০৩০ সাল নাগাদ ৩০ শতাংশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। কারণ ইতোমধ্যে জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাওয়ার বৈশ্বিক হার সীমা ছাড়িয়েছে।
সমকাল: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে কি বৈশ্বিকভাবেই পরিবেশের প্রতি ফোকাস কমে গেছে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: আমরা আশঙ্কা করেছিলাম, এবারের জলবায়ু-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত দেশগুলো অংশ নেবে না। কিন্তু আমাদের আশঙ্কা যে পর্যায়ে ছিল, সে পর্যায়ে তা ঘটেনি; বরং তাদের অনেক বিষয়ে বাধ্য করা গেছে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খোদ ইউরোপে যে তাপদাহ দেখা দিয়েছিল, সেটি তাদের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না। তবে যদি যুদ্ধটা না হতো, তাহলে ফসিল ফুয়েলের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি হচ্ছিল সেটি আরও মাইলফলক স্পর্শ করত। যেমন- কয়লা থেকে অনেক দেশ মুখ ফিরিয়ে নেবে বলেছিল, সে ক্ষেত্রে আমরা একটু পিছিয়ে পড়লাম। কারণ জার্মানি কয়লাতে ফিরে গেছে; আপৎকালীন কারণে তারা কিছু কিছু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করেছে। ফলে ফসিল ফুয়েলের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল, সেখানে আমরা একটি বড় ধাক্কা খেয়েছি।
সমকাল: বিদায়ী বছরে বাংলাদেশে বোধহয় কৃষিক্ষেত্রে পরিবেশ বিপর্যয়ের মাত্রা আরও বেড়েছে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: বাংলাদেশে কৃষির ক্ষেত্রে বিপর্যয় তো বেড়েছেই। আমরা প্রতি হেক্টরে ৮ দশমিক ৫ কেজি সার দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম। সেটি বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৬৭ কেজি প্রতি হেক্টরে। সরাসরি এক অর্থে বলে দেওয়া যায়- আমরা বিষ খাওয়ার মধ্যে আছি। এ দেশে আশঙ্কাজনক হারে কৃষিজমি কমছে। বন উজাড় আটকানোর সম্ভাবনা দেখছি না। কক্সবাজারে দেখেছি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রচণ্ড আগ্রাসন। ওখানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হতে হবে। ফিফার ফুটবল স্টেডিয়াম হতে হবে। সেন্টমার্টিন নিয়েও আগের মতো কথা বলা যাচ্ছে না। আমরা পরিবেশের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ২০২২ সালে দেখিনি। আদালত থেকে আমরা আগে যেমন প্রো-একটিভ ও প্রোগ্রেসিভ সিদ্ধান্ত পেতাম, ২০২২ সাল সে তুলনায় বেশ ঝিমিয়ে পড়া ছিল। যদিও আমরা অনেক মামলা নিয়ে আদালতে গিয়েছি। উচ্চ আদালতেও এক ধরনের সিদ্ধান্তহীনতা বা নমনীয়তা পরিলক্ষণ করেছি।
সমকাল: ২০১৬ সালে সমকালে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন, বন রক্ষায় বিশেষ মনোযোগ দেবেন। গত পাঁচ বছরে সেটা কতটুকু এগিয়েছে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: এ ব্যাপারে আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু প্রশাসন থেকে সহায়তা পাইনি। আসলে রাজনৈতিক প্রত্যয় না থাকার কারণে প্রশাসন থেকে সহযোগিতা পাই না। আদালত থেকে যেসব নির্দেশনা পাই, সেগুলো বাস্তবায়িত হয় না। আমরা বলেছি ভালুকার বনাঞ্চল রিজার্ভ ফরেস্ট, তারা দেখিয়ে দিয়েছে ব্যক্তিগত সম্পত্তি। সেটি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি। শালবনে আমরা ভালো আদেশ পেয়েছি। সেখানে উচ্চ আদালত বলেছেন, উচ্চ পর্যায়ের কমিটি হবে। শালবন কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায়, সে ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেবেন। বনবাসীর বনের অধিকার কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, সে নির্দেশনা তাঁরা দেবেন। তিন বছর পার হয়ে গেল, এখনও কমিটিই আমরা পাইনি! কক্সবাজারে মামলা করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আটকাতে পেরেছি। এখন সেখানে ফিফা গিয়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করবে। ৩০ হাজার গাছ কাটতে হবে। ফলে বন রক্ষায় আমরা কাজ করেছি। আদালতের রায়ও পেয়েছি। কিন্তু রাজনৈতিক প্রশ্রয় থাকার কারণে আমরা প্রশাসনিক সহযোগিতা পাচ্ছি না। দিনশেষে আদালতের রায় তো প্রশাসনই বাস্তবায়ন করবে।
সমকাল: আপনি শুক্রবার বাপার সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে বলেছেন, দেশে উন্নয়নকে পরিবেশের ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি আরও ব্যাখ্যা করবেন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: এমন উন্নয়ন আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যেখানে আমাদের কোনো অংশগ্রহণ নেই। জনগণকে জিজ্ঞাসাও করে না, তারা তাদের মতো করেই উন্নয়ন করে। যেহেতু সত্যিকারার্থে দেশে কার্যকর গণতন্ত্র নেই, কাজেই আমাদের যে অংশগ্রহণ ক্ষমতা, সেটাও কমে গেছে। একটি উদাহরণ দিই, আমাদের সরকারের কাছে দু-একটা ইআইএ ডকুমেন্ট চেয়েছিলাম।
সমকাল: ইআইএ মানে বিভিন্ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন নথির কথা বলছেন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: হ্যাঁ, বিভিন্ন প্রকল্পের কারণে পরিবেশের ওপর যে প্রভাব, যার ভিত্তিতে সরকার হ্যাঁ বা না বলে। যেমন রিও ঘোষণাপত্রে সরকার বলে এসেছে, ইআইএ হচ্ছে পাবলিক ডকুমেন্ট। পরিবেশ বিষয়ে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতেই ইআইএ করা হয় এবং এটিকে পাবলিক করে দেওয়া হয়। এটির ওপর সবার অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ভারতের মতো দেশে ইআইএর ওপর যে গণশুনানি হয়, সেটির অডিও-ভিডিও রেকর্ড করতে হয়। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সেই আলোচনা করতে হয়। বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ১২/৩ ধারায় বলা আছে, ইআইএকে কেমন করে- জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। কেমন করে জনমত যাচাই করতে হবে, এ ব্যাপারে সরকার বিধি প্রণয়ন করবে। এখন, গত বছর আমরা যখন সরকারের কয়েকটা প্রকল্পের ইআইএ চাইলাম, তা এটিকে নাকচ করল এই যুক্তিতে যে ইআইএ হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি। এটি তো একটি হাস্যকর অজুহাত। এর মানে হচ্ছে, জনগণ যাতে প্রতিবাদ করতে না পারে কিংবা প্রকল্পের যৌক্তিক সমালোচনা করতে না পারে।
সমকাল: জনগণ কি পরিবেশ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হচ্ছে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: জনগণ অনেক সম্পৃক্ত হচ্ছে। আপনারা দেখবেন, প্রতিটি জায়গায় এখন নদী রক্ষার আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এটি তো জনগণের সম্পৃক্ততাই। কিন্তু জনগণ কথা বললে প্রশাসন বা সরকার শুনবে- সেই বাস্তবতা থেকে তো আমরা অনেক দূরে সরে গেছি। জনগণের মধ্যে ক্ষোভ যেমন দানা বাঁধছে, হতাশাও নেমে এসেছে।
সমকাল: নতুন বছর তো নির্বাচনেরও বছর। পরিবেশ আন্দোলনের দিক থেকে আমরা কী করতে পারি?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা শক্তিশালী করতে পারি। বসে থেকেও বিদ্যুৎকেন্দ্র ক্যাপাসিটি চার্জ নিচ্ছে। এক বছরে আমরা তাদের যে ক্যাপাসিটি চার্জ দিই, তা হচ্ছে আমাদের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক বছরের বাজেট। এতেই বোঝা যায়, গুরুত্বের দিক দিয়ে আমাদের মন্ত্রণালয়ের অবস্থান কোথায় আছে। সরকারকে বিশ্ব সভ্যতার উল্টোপথে হাঁটলে চলবে না। জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে উন্নয়নের এজেন্ডা ঠিক করতে হবে। সরকারকে পরিবেশের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পরিবেশবাদী বা পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীল রাজনৈতিক নেতৃত্ব শক্তিশালী করতে হবে।
সমকাল: ইউরোপের মতো পরিবেশবাদীদের রাজনৈতিক দল গঠনের সম্ভাবনা দেখছেন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: দেশে পরিবেশবাদী রাজনৈতিক দল গঠনের সম্ভাবনা এ মুহূর্তে দেখছি না। আবার রাজনীতিতে তো শেষ কথা বলে কিছু নেই। কিন্তু এটি স্বীকার করতেই হবে যে, পরিবেশ যে একটি রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে গেছে। যেভাবে গত বছর পরিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা দেখেছি, তাতে মনে হতে পারে পরিবেশবাদীরা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্ন যেন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। অনেক এলাকায় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক পক্ষ পরিবেশবাদীদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলছে।
সমকাল: উদাহরণ দিতে পারেন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: আপনি দেখবেন, ২০২১ ও ২০২২ সালে পরিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় মামলা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রাজধানীর কলাবাগানে মাঠ রক্ষার আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। নেত্রকোনা, সিরাজগঞ্জে একই চিত্র দেখেছি। এর আগে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়েও এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি দেখেছি। দেখা যাচ্ছে, যাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ, তাদের বিষয়ে সরকার তদন্ত করে না। অথচ যারা এসবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, তাদের ব্যাপারে সরকারি সংস্থা তদন্ত করা শুরু করে দেয় বা তদন্ত ছাড়াই গ্রেপ্তার করে ফেলে। বরিশালে আমরা দেখেছি একটি শিপবিল্ডিং ইয়ার্ড, যার লাইসেন্স বাতিল করে দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। সেই শিপবিল্ডিং ইয়ার্ড একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে যাচ্ছে অভিযোগকারীকে। এমনকি তারা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকেও মামলার তদন্তে যুক্ত করে ফেলেছে।
সমকাল: এক্ষেত্রে সরকার বা প্রশাসন কী করতে পারে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: সরকার ও প্রশাসন যদি সত্যিই ইতিবাচক পরিবর্তন চায়, তাহলে তাদের সতর্ক হতে হবে। কারণ, প্রকৃত অপরাধীদের ব্যাপারে তদন্তে পুলিশের দায় আছে। তারা যদি অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে তদন্তে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে প্রকৃত অপরাধীরা আইনের আওতায় আসবে না। পরিবেশ ও মানবাধিকার রক্ষায় যারা কাজ করছে, তাদের ওপর আক্রমণ বাড়তে থাকলে অপরাধীরাই উৎসাহ পেয়ে যাবে না?
সমকাল: পরিবেশ বা রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে নৈতিকতা একটি বড় ভিত্তি। এ কথা ঠিক, আমাদের পরিবেশ আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে, সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু পরিবেশবাদীদের নৈতিকতাবোধ কি শক্তিশালী হচ্ছে? আত্মসমালোচনার জায়গা থেকে যদি বলেন।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: আমি বলব, দেশের ৬৪ জেলার প্রতি জেলায় এখনও দু'জন করে চরম নৈতিক পরিবেশবাদী আপনি পাবেন। বাস্তবতায় সেটি কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু আমাদের সুশীল সমাজের যেটা সমস্যা অনেকের মধ্যে বিভাজন হয়ে আছে। এই বিভাজন কখনও প্রকাশ্য, কখনও মনস্তাত্ত্বিক। আমাদের সেই বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। বিভাজনটিকে অনৈতিক বলার সুযোগ নেই। কারণ, মানুষের রাজনৈতিক মতাদর্শ আলাদা হতেই পারে। কিন্তু বিভাজনের কারণে আপনার মূল কাজটি যখন দুর্বল হয়ে যায়, সেখানে আপনাকে কাজের সপক্ষে অবস্থান নিয়ে বিভাজনকে ভুলতে হবে। আর কিছু মানুষ থাকবেই, যারা সবকিছুর মধ্যে ব্যক্তিগত লাভ-লোকসান খুঁজবে। তাদের নিয়ে পড়ে না থেকে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
সমকাল: নতুন বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালে আপনার কাজের অগ্রাধিকার কী হবে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: আমার অগ্রাধিকার হবে, আমি যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করছি, তার সঙ্গে যুক্তরা আইনিভাবে সুরক্ষিত থাকছেন কিনা। যে পরিবেশ কাঠামো রয়েছে, তা আদালতের মাধ্যমে কতটা কার্যকর করতে পারি। সরকারের সঙ্গে প্লাস্টিকের ব্যবহার রোধ, বন ফিরিয়ে আনা- এসব ক্ষেত্রে কতটা অ্যাডভোকেসি করতে পারি। প্লাস্টিক দূষণ ঠেকানোসহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে নতুন আইন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এটি নিয়ে কাজ করব। পরিবেশের যেসব অধিকার খর্ব হয়েছে, তা আদালতে নিয়ে গিয়ে অধিকার ফেরানোর চেষ্টা করব। প্রতিকার পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা থাকবে। মাঠ পর্যায়ে কমিউনিটিকে সংগঠিত করা এবং তাদের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের সংযোগ তৈরি করে দেওয়া। নদী নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো কিছু করা যায় কিনা, সে বিষয়ে চিন্তা করব।
সমকাল: সামষ্টিক অগ্রাধিকার কী হতে পারে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: সামষ্টিকভাবে আমাদের উচিত হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দরকষাকষি করা। যেন তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। নাগরিক সমাজ ও সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে আমি বলব, বসে থাকলে বা হতাশ হলে চলবে না। আমাদের জীবনের ওপর আঘাত আসছে। বায়ু দূষিত হচ্ছে, পানি দূষিত হচ্ছে, নদী মরে যাচ্ছে, পাহাড় কাটা হচ্ছে, বন উজাড় হচ্ছে- এসবের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত লেগে থাকতে হবে। জনমত তৈরি করতে হবে।
সমকাল: এই সাক্ষাৎকার যেদিন ছাপা হচ্ছে, সেদিন আপনার জন্মদিন। সমকালের পক্ষ থেকে আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: সমকালকে ধন্যবাদ। আপনাদের জন্যও শুভকামনা।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com