
সুশাসন
সরকারি হাসপাতালে বেসরকারি ফি কেন?
প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২৩ । ০৫:০৯ | প্রিন্ট সংস্করণ
কল্লোল মোস্তফা

জনগণের অর্থে পরিচালিত সরকারি তথা পাবলিক হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ কম হবে- এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু সরকারি হাসপাতালের অবকাঠামো ব্যবহার করে যদি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উচ্চ ফিতে চিকিৎসাসেবা প্রদান করে, তাহলে সেটা পাবলিক চিকিৎসার ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। এ ঘটনাই ঘটছে ঢাকার জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এ দুই হাসপাতালে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় ২০১৭ সাল থেকে ডায়ালাইসিসসহ কিডনি রোগীদের বিভিন্ন সেবা দিচ্ছে ভারতীয় মালিকানাধীন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্যান্ডর মেডিকেইডস প্রাইভেট লিমিটেড (ডায়ালাইসিস ফি বাড়ানোয় চমেক হাসপাতালে রোগীদের বিক্ষোভ, সমকাল, ৮ জানুয়ারি ২০২৩)।
এত দিন প্রতিবার ডায়ালাইসিস ফি ছিল ভর্তুকিতে ৫১০ এবং ভর্তুকি ছাড়া ২ হাজার ৭৮৫ টাকা। দরিদ্র রোগীরা তাদের প্রয়োজনীয় ডায়ালাইসিস সেশনের সবক'টিই ভর্তুকি মূল্যে করাতে পারতেন। কিন্তু নতুন বছর থেকে ডায়ালাইসিস ফি বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং যারা এত দিন শতভাগ ভর্তুকি মূল্যে ডায়ালাইসিস সেবা পেতেন, তাদের অর্ধেক ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তা ছাড়া ডায়ালাইসিস ফি ভর্তুকিতে ৫১০ টাকার জায়গায় ৫৩৫ এবং ভর্তুকি ছাড়া ২ হাজার ৭৮৫ টাকার জায়গায় ২ হাজার ৯৩৫ টাকা করা হয়েছে।
মাসে ৮ থেকে ১২ বার ডায়ালাইসিসের ব্যয় এমনিতেই দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত রোগীদের জন্য দুঃসাধ্য ছিল; এখন খরচ হবে তিন গুণ। আটবার ডায়ালাইসিসের জন্য যেখানে আগে মাসে ৪ হাজার ৮০ টাকা খরচ হতো, এখন সেখানে খরচ হবে ১৩ হাজার ৮৮০ টাকা। নিরুপায় হয়ে ডায়ালাইসিস ফি কমানোর দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন চট্টগ্রামের কিডনি রোগী ও তাদের স্বজনরা।
প্রথমদিকে হাসপাতালের নিচতলায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্যান্ডরের সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়। তাতে সুরাহা না হওয়ায় ১০ জানুয়ারি হাসপাতালের সামনের রাস্তা অবরোধ করেন। পুলিশ এ সময় মারধর করে তাঁদের রাস্তা থেকে তুলে দিয়েছে বলে অভিযোগ। শুধু তাই নয়, রোগী ও তাঁদের স্বজনদের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলা ও কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে মামলাও হয় (মারধরের শিকার রোগী ও স্বজনদের বিরুদ্ধে মামলা দিল পুলিশ, প্রথম আলো, ১১ জানুয়ারি ২০২৩)। বিক্ষোভরত দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত কিডনি রোগী ও তাঁদের স্বজনরা আহামরি কিছু চাননি। স্বল্পমূল্যে চিকিৎসাসেবা চেয়েছেন মাত্র, যেটা তাঁদের মৌলিক অধিকার।
জনগণের করের অর্থে চিকিৎসার আয়োজন এবং খরচ এমন হতে হবে যেন অর্থের অভাবে কারও চিকিৎসাসেবা বন্ধ না হয়। কিন্তু ক্যান্সার কিংবা কিডনির জটিল চিকিৎসা সুলভ না হওয়ার কারণে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক রোগী যথাযথ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হন। ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে বেশির ভাগ রোগীই অর্থসংকটে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দেন। দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি; যার মধ্যে প্রতিবছর ৪০ হাজার রোগীর কিডনি বিকল হয়। এই রোগীদের ৭৫ শতাংশ বিভিন্ন সময়ে ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজন চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান (অর্থসংকটে ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দেন রোগীরা, সমকাল, ২৬ নভেম্বর ২০২২)।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে ব্যক্তির ওপর স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপ কমাতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টোটাই ঘটছে। গত এক দশকে স্বাস্থ্য খাতে বাণিজ্যিকীকরণ বেড়েছে, বাণিজ্যিক চিকিৎসাকেন্দ্রের ওপর মানুষের নির্ভরতা বেড়েছে এবং চিকিৎসার প্রয়োজনে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণের ফলে ব্যক্তির চিকিৎসা খরচ বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের হিসাব অনুসারে, বর্তমানে স্বাস্থ্য ব্যয়ের তিন-চতুর্থাংশ বহন করছেন ব্যক্তি নিজেই। ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারের অংশ ছিল যথাক্রমে ২৮, ২৬ ও ২৩ শতাংশ এবং ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ছিল যথাক্রমে ৬৪, ৬৬ ও ৬৯ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারের অংশ ক্রমান্বয়ে কমছে এবং ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বাড়ছে।
বছর বছর মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারের ভাগ কমে আসার এবং ব্যক্তির ভাগ বেড়ে যাওয়ার এই প্রবণতা দীর্ঘদিনের। ১৯৯৭ সালে একজন ব্যক্তিকে তাঁর চিকিৎসা ব্যয়ের ৫৫ শতাংশ বহন করতে হতো, আর সরকারের ব্যয় ছিল ৩৭ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে, গত দুই যুগে স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে ব্যক্তির ব্যয় ১৪ শতাংশ বেড়েছে আর সরকারি ব্যয় ১৪ শতাংশ কমেছে। অথচ ব্যক্তির ওপর স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপ কমাতে ২০১২ সালে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট প্রণীত ২০ বছর মেয়াদি কৌশলপত্রের লক্ষ্য ছিল ক্রমান্বয়ে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় কমিয়ে ২০৩২ সালে ৩২ শতাংশে নিয়ে আসা। ২০১২ সালে কৌশলপত্র প্রণয়নের সময় ব্যক্তির ব্যয় ছিল ৬৩ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত ব্যক্তির ব্যয় কমার বদলে উল্টো আরও ৬ শতাংশ বেড়েছে (চিকিৎসা ব্যয়ের বোঝা বেড়েছে জনগণের, সমকাল, ১২ ডিসেম্বর ২০২১)। এভাবে নিজের পকেট থেকে চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে প্রতিবছর ৫২ লাখ মানুষ দরিদ্র হচ্ছে (বছরে ৫২ লাখ মানুষ দরিদ্র হচ্ছে স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে, প্রথম আলো, ৭ এপ্রিল ২০১৮) এমন প্রেক্ষাপটেই কিন্তু চট্টগ্রামের কিডনি রোগীদের আন্দোলনকে দেখতে হবে। তাঁদের এই আন্দোলন চিকিৎসার নামে নিঃস্বায়নের বিরুদ্ধে, মৌলিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার যে গল্প প্রচার করা হয়, তা যে কতটা বিভ্রান্তিকর, সেটাও এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হয়েছে। বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হলে কিডনি ডায়ালাইসিসের রোগী ও স্বজনদের ২ হাজার ৯৩৫ টাকার বদলে ৫১০ টাকায় ডায়ালাইসিসের দাবিতে আন্দোলন করতে হচ্ছে কেন! সরকারি হিসাবেই দেশের মাত্র ৪০ শতাংশ মানুষকে কমিউনিটি ক্লিনিকসহ সরকারি চিকিৎসা সেবাকেন্দ্রের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে (চিকিৎসা ব্যয়ের বোঝা বেড়েছে জনগণের, সমকাল, ১২ ডিসেম্বর ২০২১)। দেখা যাচ্ছে, এই ৪০ শতাংশ মানুষও আসলে ক্যান্সার কিংবা কিডনি ডায়ালাইসিসের মতো জটিল ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা বিনামূল্যে পাচ্ছেন না।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে পিপিপির নামে সরকারি হাসপাতালে বেসরকারি কোম্পানির চিকিৎসা ব্যবসা বন্ধ করা এবং শুধু কিডনি ডায়ালাইসিসই নয়, দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য জটিল ও ব্যয়বহুল সব ধরনের চিকিৎসাই বিনামূল্যে প্রদানের আয়োজন করা জরুরি।
কল্লোল মোস্তফা: লেখক; প্রকৌশলী; নির্বাহী সম্পাদক, সর্বজনকথা
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com