
শিশুকিশোর সাংস্কৃতিক উৎসবে শিক্ষার্থীদের প্রতিভার ঝলক
ফুলকির ফুল ওরা, আগামীর স্বপ্ন
প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২৩ । ১১:১৬ | প্রিন্ট সংস্করণ
মারজান আক্তার, চবি

ফুলকি-ইস্পাহানীর আয়োজনে শিশুকিশোর সাংস্কৃৃতিক উৎসবে নৃত্য পরিবেশন করে একদল শিক্ষার্থী - সমকাল
ফুলকি স্কুলের ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী তোহা ও আহনাফ। দুই বন্ধু মিলে থ্রিডি হলোগ্রাম তৈরি করে উপস্থাপন করেছে। সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, কীভাবে কাজ করে এই থ্রিডি হলোগ্রাম। পাশেই তাদের আরেক বন্ধু উপস্থাপন করেছে প্রাকৃতিক উপায়ে পানি পরিশোধনের পদ্ধতি।
খুদে বিজ্ঞানী ত্বাহা হামিদ শুদ্ধ গ্রহ-নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যুর জটিল আলোচনায় মগ্ন। কিন্তু জুনান এত কঠিন বিষয়ের গভীরে যেতে আগ্রহী নয় মোটেও। তার চেয়ে সামগ্রিক বিষয়টি উপভোগ করতেই বেশি ব্যস্ত সে। উৎসবের বিজ্ঞান অনুষ্ঠানে পাওয়া গেল এমন একটি চিত্র।
চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে তিন দিনব্যাপী শিশুকিশোর সাংস্কৃতিক উৎসব ছিল আনন্দ আয়োজনে ভরা। ফুলকি-ইস্পাহানীর আয়োজনে এই উৎসব উদ্বোধন হয় বৃহস্পতিবার, শেষ হয় শনিবার।
শিশুকিশোর সাংস্কৃতিক উৎসবকে ঘিরে ১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ২ হাজার শিশুকিশোরের মিলনমেলা হয়ে উঠেছিল শিল্পকলা একাডেমির প্রাঙ্গণ। নাট্যপালা, বিজ্ঞানভিত্তিক আয়োজন, পুতুল নাচ, আবৃত্তি, গান ও জাদু প্রদর্শনীসহ অনন্য সব আয়োজনে আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। ফুলকির এই বিশেষ আয়োজনে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অংশগ্রহণই ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। এতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিশুসাহিত্যিক সুকুমার বড়ুয়া ও সাহিত্যিক আনিসুল হক।
শিশুদের জন্য এই আয়োজন নিয়ে ফুলকির সভাপতি ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, '১৯৭৬ সাল থেকে ফুলকির যাত্রা শুরু হয় শিশুদের আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা দিয়ে যেতে। মঞ্চে এত ছোট ছোট শিশুদের নিখুঁত সাংস্কৃতিক পরিবেশনা দেখে বেশ আনন্দিত আমি। শিশুদের শুধু পাঠ্যবই থেকে বের করে সংস্কৃতির সঙ্গে আরও বেশি যুক্ত করতে এই ধরনের আয়োজন আরও বেশি বেশি করতে হবে।'
যান্ত্রিক ডিভাইসে আসক্ত হওয়া থেকে শিশুদের রক্ষা করতে শিশুদের সাংস্কৃতিক চর্চার পরিসর বাড়াতে অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আবুল মোমেন বলেন, 'আমাদের অভিভাবকরা বইয়ের মাঝে শিশুদের ডুবিয়ে রাখতে চায়। আর তারা শুধু এই একঘেয়ে পাঠ্যবই থেকে পরিত্রাণ পেতে চায়। তাই শিশুদের জন্য সাংস্কৃতিক পরিবেশ ঘর থেকেই তৈরি করতে হবে। তাহলে আমাদের সংস্কৃতি যেমন রক্ষা পাবে, শিশুরাও আনন্দিত পরিবেশে শিক্ষা অর্জন করতে পারবে।'
ফুলকি স্কুলের সর্বাধ্যক্ষ শীলা মোমেন বলেন, 'ফুলকিতে আমরা শিশুদের লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে কলা চর্চা, নৃত্য, আবৃত্তি, নাটক, বিজ্ঞানচর্চা শেখাই। ফলে ওরা দলভিত্তিক সামাজিক আচরণ শেখে, আনন্দে শিক্ষা অর্জন করে। আমার মনে হয় প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের এ আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা নিশ্চিত করা দরকার। এ ক্ষেত্রে আমাদের অভিভাবকদের সবসময় ইতিবাচক থাকতে হবে।'
উদ্বোধনকালে শিশুসাহিত্যিক সুকুমার বড়ুয়া বলেন, 'আমাদের সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে অনেকটাই। তার সঙ্গে এসেছে অনেক পরিবর্তনও। যেসব অভিভাবক শিশুদের এখনও সাংস্কৃতিক কাজে অনুপ্রেরণা দেয় তাদের আমি সাধুবাদ জানাই। শিশুদের মাঝে সেই ৭০ কিংবা ৫০ বছর পুরোনো সংস্কৃতির ছোঁয়া এখনও আছে, এটি আমাদের জন্য বেশ আনন্দের।'
যা ছিল তিনদিনের আয়োজনে :বৃহস্পতিবার প্রথম দিনে আয়োজন শুরু হয় ফুলকির শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে ব্রতচারী নৃত্যের মাধ্যমে। তারপর কারাতে, উদ্বোধনী সংগীত ও নৃত্য পরিবেশনের পর ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়ার ছড়া আবৃত্তি করে খুদে শিক্ষার্থীরা। এ সময় সুকুমার বড়ুয়াকে ফুল ও উত্তরীয় দিয়ে সম্মাননা জানানো হয়। পরে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী, ফুলকির চারুকলার শিক্ষার্থীদের আঁকা ছবির প্রদর্শনী এবং সন্ধ্যায় নাট্যপালা 'বক বধ' মঞ্চায়ন করা হয়।
উৎসবের দ্বিতীয় দিনের আয়োজন শুরু হয় শিশুকিশোর সমাবেশের মাধ্যমে। এ সময় শিশুদের সঙ্গে সময় কাটান সাহিত্যিক আনিসুল হক। বিকেল থেকে সাংস্কৃতিক উৎসবে যোগদান করে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিভিন্ন সংগঠনও। দ্বিতীয় দিনের আয়োজনে আরও ছিল ফুলকি আনন্দ বিজ্ঞানের প্রকল্প প্রদর্শনী, পাপেট শো, চারুকলা পদক প্রদান ও নাট্যপালা 'বক বধে'র মঞ্চায়ন।
শেষ দিন শনিবারের আয়োজনে শিশুদের সবচেয়ে বেশি সমাগম দেখা যায়। এদিন অন্যতম আকর্ষণ ছিল 'শিশু কিশোরের কর্মশালা'। এ আয়োজনে শিশুদের শেখানে হয় বাঁশি তৈরি, তালপাখা, শীতল পাটি, ছাপচিত্র, ক্র্যাফট ও মাটি দিয়ে পণ্য তৈরি। ৯ থেকে ১৬ বছরের প্রায় দুই শত শিশু কিশোর নিবন্ধনের মাধ্যমে এ কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে। শেষদিনের আয়োজনে আরও ছিল চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, বিজ্ঞানের মজার খেলা, জাদুশিল্পী রাজীব বসাকের জাদু প্রদর্শনী, প্লে উইথ ইংলিশ ও শাস্ত্রীয় নৃত্য পরিবেশন। সর্বশেষ ও অন্যতম আয়োজন ছিল ছোটদের জন্য বড়দের পরিবেশনায় রক্তকরবী।
ফুলকির এই বর্নাঢ্য আয়োজনে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অংশ্রগ্রহণের সুযোগ পাওয়ায় সাধুবাদ জানায় বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা। স্বপ্নবাগিচা বিদ্যানিকেতনের সংগঠক কামরুল ইসলাম বলেন, 'ফুলকির এই আয়োজনে আমার সংগঠনের শিশুরাও অংশগ্রহণ করেছে, তাই আমি বেশ আনন্দিত। আবার অন্য শিশুদের পরিবেশনা দেখেও তারা শিখতে পারছে।'
আনন্দিত শিশু ও অভিভাবকরা : যাদের নিয়ে ফুলকির এই আয়োজন সেই শিশুরা এই উৎসবের তিনদিন মেতে ছিল আনন্দে। ফুলকি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে সৌমিক চৌধুরী। সাথে আছে তার মা জয়া দত্ত। সৌমিক জানায় প্রথমবারের মতো মঞ্চে আবৃত্তি করেছে সে। ভীষণ আনন্দিত নিজের প্রথম কোনো উপস্থাপনায়। সৌমিকের মা জয়া দত্ত বলেন, 'বাচ্চাদের এই ধরনের সাংস্কৃতিক উৎসবের জন্য তৈরি করতে করতে আমরা অভিভাবকরাও শিখি। এখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিশুদের সাথে শিখছে, বন্ধুত্ব করছে এবং মঞ্চে নিজের সন্তানের উপস্থাপনা দেখতে খুবই ভালো লাগে।'
সরকারি ন্যাশনাল প্রাইমারী স্কুল থেকে এসেছে আবরার শাহরিয়ার। শাহরিয়ার ঘুরে দেখছিল শিশুদের প্রদর্শিত ছবির আর্ট গ্যালারি। শাহরিয়ার জানায়, এত শিশু ও দর্শকের সামনে আগে সে কিছু পরিবেশন করেনি। প্রথমে কিছুটা ভয় পেলেও আবৃত্তি শেষে তার আনন্দ লাগছে।
ফুলকির অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী তাসনুভা আজাদ। লেটস প্লে উইথ ইংলিশে ফ্রোজেন চলচ্চিত্রের স্ট্ক্রিপ্ট পাঠ করেছে সে। তাসনুভা বলে, 'ফুলকি এমন একটা জায়গা যেখানে সংস্কৃতিচর্চা নিয়মিত হয়ে থাকে। ছোটবেলা থেকে আমি এই ধরনের চর্চার সাথে আছি বলে বেশ ভাগ্যবান মনে করি নিজেকে।'
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com