রাজনীতি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঘোড়া বেচাকেনার লাভ-লোকসান

প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২৩ । ০৪:৪৯ | প্রিন্ট সংস্করণ

সাইফুর রহমান তপন

সংসদীয় গণতন্ত্রে হর্সট্রেডিং বা ঘোড়া কেনাবেচা- সরকার গঠন বা ফেলে দেওয়ার লক্ষ্যে বিপক্ষ দলের সংসদ সদস্যকে ভাগিয়ে আনা- অপরিচিত কিছু নয়। তবে প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানে আকছার তা ঘটতে দেখা গেলেও আমাদের দেশে মূলত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে খুব একটা দেখা যায় না।

এখানে একবারই তা দেখা গিয়েছিল- ১৯৯৬ সালে। ওই বছর- ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার টানা ২১ বছর পর- বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়; কিন্তু তা সরকার গঠনে যথেষ্ট ছিল না- আওয়ামী লীগ তখন পেয়েছিল ১৪৬টি আসন, যেখানে সরকার গঠনের জন্য দরকার ১৫১ আসন। এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ (রব)-কে সঙ্গে নিয়ে তারা সরকার গঠন করলেও কিছুদিনের মধ্যেই এরশাদ রহস্যজনক কারণে পল্টি খান। তাঁর দলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু- যিনি ওই সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন- অবশ্য দল ভেঙে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে গেলেও তা সরকারের জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল না।

এ প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সদ্য ক্ষমতাচ্যুত বিএনপিদলীয় দু'জন সংসদ সদস্যকে ভাগিয়ে নিয়ে আসে। এ দুই সংসদ সদস্য ছিলেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থেকে নির্বাচিত হাসিবুর রহমান স্বপন ও রাজশাহী থেকে নির্বাচিত ডা. আলাউদ্দিন। আলাউদ্দিন অবশ্য তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই আওয়ামী লীগে ছিলেন; ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিএনপির টিকিটে সংসদ সদস্য হন; ফলে বিএনপি ছেড়ে তাঁর আওয়ামী লীগে যোগদান ছিল স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন। যা হোক, ৭০ অনুচ্ছেদের কোপে দু'জনই পদ হারান; উপনির্বাচনে আলাউদ্দিন উতরে গেলেও স্বপন পরাজিত হন; তবে দু'জনই শাসক দলে ভেড়ার পুরস্কারস্বরূপ মন্ত্রিত্ব পান।

বড়সড় ভূমিকাটা দিতে হলো বিএনপির প্রবীণ নেতা ও পাঁচবারের সংসদ সদস্য উকিল আবদুস সাত্তার ভুঁইয়ার সম্প্রতি সংসদ থেকে পদত্যাগ এবং একই আসনে- ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের 'সর্বাত্মক' সহায়তায় অংশগ্রহণের বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেওয়ায়। ধ্রুপদি সংজ্ঞায় না পড়লেও এটাও এক ধরনের ঘোড়া কেনাবেচা। ১৯৯৬ সালের ঘটনা দুটির সঙ্গে এর শতভাগ মিল না থাকলেও শতভাগ অমিলও নেই।

প্রথমত, সরকারি দল আগামী ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় আরও চারটি উপনির্বাচনে দলীয় বা জোটের একক প্রার্থী দিলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনটি উন্মুক্ত রাখে। দ্বিতীয়ত, ২০১৮ সালের নির্বাচনে যে আওয়ামী লীগ নেতা উকিল আবদুস সাত্তারের ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছিলেন, তিনিসহ আরও দুই সরকারদলীয় নেতা চলমান উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন নির্দলীয় হিসেবে। কিন্তু তিনজনকেই রীতিমতো দলীয় সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়েছে। তৃতীয়ত, এমনকি সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির এক বহিস্কৃত নেতাও- যিনি এর আগে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে এ আসন থেকে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন- কোনো এক অদৃশ্য হাতের ইশারায় সরকারদলীয় ওই তিন নেতাকে অনুসরণ করেছেন। সব মিলিয়ে সরাইল ও আশুগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত ওই আসনের নির্বাচনী ময়দান এখন প্রায় পুরোপুরিই উকিল আবদুস সাত্তারের অনুকূলে।

এতেও কিন্তু স্বস্তি পাচ্ছে না সরকারি দল; দলটির নেতাকর্মী দলবেঁধে সাত্তার সাহেবকে নিয়ে নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। শুধু তাই নয়, কিছুদিন আগে ওই আসনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী- যিনি সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন এবং সাত্তার সাহেবের সঙ্গেই একযোগে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন- ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা এলাকায় গিয়ে দলীয় নেতাকর্মীকে শুধু ভোট বর্জন নয়, ভোট প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়েছেন; এতেও শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের ঘুম যেন হারাম হয়ে গেছে। তাঁরা নির্বাচনের দিন রীতিমতো পাহারা বসানোর জন্য স্বদলীয় নেতাকর্মীর প্রতি আহ্বান রেখেছেন। যেন উকিল আবদুস সাত্তারকে জিতিয়ে আনাটা শাসক দলের জন্য ফরজ হয়ে পড়েছে।

এদিকে এসব দেখে অনেকে- এমনকি শাসক দলের অনেক নেতাকর্মীও তাজ্জব বনে প্রশ্ন তুলেছেন, এর পেছনে রহস্যটা কী? ১৯৯৬ সালে না হয় দলের সাংসদ সংখ্যায় ঘাটতি ছিল, কিন্তু এখন তো নিয়মিত ও সংরক্ষিত মিলে ৩৫০টির মধ্যে ৩০২টি আসন সরকারদলীয়; তা ছাড়া সংসদে এমন কোনো সংকটও নেই যে শাসক দলের আরও দল ভারী করা জরুরি হয়ে পড়েছে; তারপরও কেন প্রায় জীবনসায়াহ্নে উপস্থিত উকিল আবদুস সাত্তারের পেছনে এত এত বিনিয়োগ?

এটা ঠিক, ১৯৭৩ সালের পর এ আসনে আওয়ামী লীগ একবারও জয় পায়নি; দেশের প্রথম সংসদে যিনি দলটিকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনের সঙ্গে জড়িত থেকে তিনি পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষদেরই সুবিধা করে দিয়েছিলেন। সেদিক থেকে আসনটি পুনরুদ্ধারের একটা আকাঙ্ক্ষা শাসক দলের মধ্যে থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু তার জন্য দলছুট এবং চলতে-ফিরতে প্রায় অক্ষম একজন নেতার ওপর ভর করতে হবে! সারাদেশে এত দাপট দেখানোর পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে কম্পমান হয়ে গেল শাসক দল?

কথাটা এ জন্য বলছি, প্রার্থিতা প্রত্যাহারকারী এক আওয়ামী লীগ নেতাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি অনেকটা এমন উত্তর দিয়েছিলেন- উকিল আবদুস সাত্তারের বিজয় অবশ্যম্ভাবী; তাই সরকারি দলের প্রার্থীরা মাঠে থাকা মানে গোহারা হেরে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা।

আসন হিসেবেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ নয়, অর্থাৎ এ আসনে জয়-পরাজয় রাষ্ট্রক্ষমতার প্রশ্নে কোনো পার্থক্য তৈরি করবে না। তারপরও আসনটি পরোক্ষভাবে হলেও নিজেদের দখলে রাখার একটা উদ্দেশ্য হতে পারে শাসক দলের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শিবিরে কিছুটা হতাশা তৈরি করা। কিন্তু এটাও সত্য, একজন উকিল আবদুস সাত্তারকে ভাগিয়ে ও জিতিয়ে এনে বিএনপির বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির খুব একটা ক্ষতিবৃদ্ধি ঘটবে না। মাঝখান থেকে সরকারদলীয় বহু সংসদ সদস্য হওয়ার স্বপ্নদেখা নেতাকে হতাশ করা হলো। আর ঘোড়া বেচাকেনার কলঙ্ক আরেকবার শাসক দলের গায়ে লাগল। তার মানে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় 'হর্সট্রেডিং' করে লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি।

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com