কবি নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবলে কবিতা মানবিকতা হারায়: কামাল চৌধুরী

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২৩ । ১৫:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

--

কামাল চৌধুরী [২৮ জানুয়ারি ১৯৫৭]

সত্তর দশকের যে কবিদের হাতে আধুনিক বাংলা কবিতা নতুন রূপ লাভ করেছে তাঁদের একজন কামাল চৌধুরী। প্রেম ও বাঁচার দুর্মর আকাঙ্ক্ষা— এ দুয়ের মিশেল তাঁর কবিতাকে দার্শনিক স্বকীয়তা দিয়েছে। মুক্ত ছন্দের এক অভিনব কাব্যভাষা তিনি তৈরি করেছেন। সেই সঙ্গে বাংলা কবিতার সকল ছন্দেই তার দক্ষতা অপরিসীম। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ত্রিশ। প্রথম কাব্যগ্রন্থ মিছিলের সমান বয়সী (১৯৮১)। এরপর ক্রমশ প্রকাশিত হয়েছে টানাপোড়েনের দিন (১৯৯১), এই পথ এই কোলাহল (১৯৯৩), এসেছি নিজের ভোরে (১৯৯৫), এই মেঘ বিদ্যুতে ভরা (১৯৯৭), ধূলি ও সাগর দৃশ্য (২০০০), রোদ বৃষ্টি অন্ত্যমিল (২০০৩), হে মাটি পৃথিবীপুত্র (২০০৬), প্রেমের কবিতা (২০০৮) পান্থশালার ঘোড়া (২০১০) ঊড়ে যাওয়া  বাতাসের ভাষা(২০১৫) অন্যমনস্ক অনুপ্রাস(২০১৯), টুঙ্গিপাড়ী গ্রাম থেকে(২০২০), স্তব্ধতা যারা শিখে গেছে (২০২২) ইত্যাদি গ্রন্থ। এছাড়াও কন্যাকে নিয়ে লেখাসহ তাঁর  কয়েকটি গদ্য গ্রন্থ , বঙ্গবন্ধু শেখ  মুজিবকে নিবেদিত কবিতা নিয়ে ‘মহাকালের তর্জনী ‘ সংকলনসহ  বেশকটি সংকলন তিনি  সম্পাদনা করেছেন।। সাহিত্যে অবদানের জন্যে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০১১) ও একুশে পদকে (২০২২) ভূষিত হয়েছেন। সম্প্রতি কালের খেয়ার মুখোমুখি হন। কথা বলেন মানুষ হিসেবে সমাজে কবির অবস্থান, কবিতার প্রতি ব্যক্তিগত অন্বেষা, লেখালেখির পথে জীবনের গভীরতর অনুধাবনসহ নানা দিক নিয়ে। আলাপে ছিলেন হামিম কামাল

আপনার জীবনদর্শন দিয়ে শুরু করতে চাই। কবি হিসেবে মানুষকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করেন? 

কামাল চৌধুরী: কবি, লেখক বা সমাজের সাধারণ মানুষ- প্রত্যেকেই সমাজের অংশ। মানুষ এবং যে সময়ে আমরা বাস করি সেই সময়- এই দুটো হলো কবিতার শ্রেষ্ঠ অনুষঙ্গ। মানবজন্মকে আমি কিভাবে দেখতে চাই? একজন কবিকে সবসময় তাঁর সময়ের ভেতর থেকে , যাপিত  জীবন থেকে অভিজ্ঞতা  নিতে হয়। সমাজের  ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ অনেক উপাদান তার কবিতার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। তাকে ব্যক্ত করাটাই কবির কাজ। কাজটি করতে গেলে কবিকে নিজ সমাজ ও সময় ভালোভাবে অনুধাবন করতে হয়। নিজেকে আমি তাই কবিতার  অংশ হিসেবেও দেখি। কবি সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষ নন। কবি যদি নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবেন, তাঁর লেখা  মানবিকতা হারায়। কবিকে নিজ ঐতিহ্য , সময় ও আবহের সঙ্গে কল্পনা শক্তির  মিশেল দিয়ে আগামির পঙক্তিমালা  রচনা করতে হয়। 

মানুষ হিসেবে কি আপনি কখনো বিচ্ছিন্নতা অনুভব করেন না সমাজের কাছ থেকে?

কামাল চৌধুরী: শেলী বলেছেন, কবি হলো নাইটিঙ্গেলের মতো। তিনি আপন নিঃসঙ্গতাকে উদযাপন করেন। মানুষ হিসেবে বিচ্ছিন্নতাবোধ কাজ করলেও তাতে উদযাপনের একটা বিষয়ও আছে। ওদিকে সোরেন কিয়ের্কেগার্দ বলছেন, কবির কাজ হলো তার যন্ত্রণাকে সংগীতে রূপান্তরিত করা। কবির এই যন্ত্রণা তার পরিপাশ থেকে আসে। কবি তখনই বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেন যখন সৃষ্টির প্রয়োজনে তিনি তাঁর অনুধাবনকে একটা নৈব্যক্তিক রূপ দিতে চাইবেন। এর বাইরে যে বিচ্ছিন্নতা, এলিয়েনেশন, আমি সেই ধরনের বিচ্ছিন্নতা অনুভব করি না। কবি কিন্তু রবিনসন ক্রসোর মতো কোনো মায়াবী দ্বীপে জনবিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করবেন না। তাঁকে একটা  সামাজিক পরিমণ্ডলের ভেতর বাস করতে হয়। তাঁর ক্ষুণ্নিবৃত্তির ব্যাপার আছে, জৈবিক চাহিদা আছে। শীতরাত্রির প্রার্থনা নামে বুদ্ধদেব বসুর একটা কবিতা আছে, আমার প্রিয়। সেখানে কবি প্রচণ্ড শীতের ভেতর কবিতা লিখছেন, আবার একটু পর পর শীত তাড়ানোর জন্যে চা খাচ্ছেন। একজন বলছিলেন, কবি যখন জীবনে থাকেন, তখন কবিতায় থাকেন না; যখন কবিতায় থাকেন, তখন জীবনে থাকেন না। আমি বলেছিলাম, বুদ্ধদেব বসুর শীতরাত্রির প্রার্থনাই বলে দেয়, কবি জীবনেও থাকেন, কবিতায়ও থাকেন। অতএব বিচ্ছিন্নতা অনুভব করা কবির পক্ষে সম্ভব হয় না। 

মানুষ তো কবিকে একা করে দেয়।

কামাল চৌধুরী: একাকীত্বের যে স্বাভাবিক ধারণা সেটা এক ধরনের শ্রেণিচরিত্র থেকেও  এসেছে। একজন কবিও কোনো না কোনো শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। তবে অন্যান্য শ্রেণির সঙ্গেও তার সংযোগ তৈরি হয়। এটা কেন হয়? কারণ সংস্কৃতি একটা জঙ্গম, গতিশীল বিষয়। ফলে একজন শ্রমিক শ্রেণির  মানুষও তাঁর স্বপ্নকে অন্য শ্রেণির মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারেন। সুতরাং আপনি কেবল শ্রেণিচরিত্রের ভেতর অবস্থান করছেন না। মানব চরিত্র  তাই বহুমুখী। পাঠকের চাহিদা কী? সমগ্র জনগোষ্ঠী কবিতার পাঠক নয় যদিও তারাই কবিতার উদ্দিষ্ট পাঠক। সমাজে ভাষা দ্রুত বদলে যাচ্ছে। মুখের ভাষা, কবিতার ভাষা সব । প্রত্যেক  কবি ভাষায় স্বাতন্ত্র তৈরি করতে চান।  কবি  আলাদা চিত্রকল্প, রূপক  তৈরি করতে চান। স্বাভাবিকভাবেই কবিতার শৈলী, প্রকরণ ও বদলে যাওয়া ভাষার নিহিতার্থ অনুভব করতে না পারলে পাঠকের পক্ষে কবিতার রস আস্বাদন সব সময় সম্ভব হয়না। সে জন্য পাঠকের সচেতনতার প্রয়োজন। কবি খুব কাছ থেকে কবিতাকে দেখেন , তাই তার সঙ্গে আবেগ , অনুভূতির সরাসরি সম্পর্ক থাকে। কিন্তু পাঠক দেখেন দূর থেকে। তাকে কবির আবেগ থেকে কবিতার অনুভব কে ধারণ  করতে হয়। কবি ও পাঠক, দুয়ের এ দূরত্ব কবিতার মাধ্যমে ঘোচাতে  হয়। সে জন্যই পাঠকের সচেতনতার কথা আমরা বলি।আবার কবিতাকে মানুষের সচেতনতার অংশ হতে হলে, কবিতাকেও মানুষের সচেতনতা ও উপলব্ধির কাছে নিতে হবে। নাহলে সেই পাঠকের কাছে কবিতার অস্তিত্ব অর্থপূর্ণ হবে না। সে ধরনের  কবিতাতেই মানুষ নিজের মনে করে উদযাপন করে।  এটা শিল্পসাহিত্যের  বস্তুগত ও শিল্পজগত দিকের সমন্বয়ের  অনিবার্য দিক। আরেকটি দিক আছে। এখনও দু ধরনের কবিতা লেখা হয়ে থাকে মূলত। এলিটিস্ট পোয়েট্রি, আর পিপল’স পোয়েট্রি। এলিটিস্ট পোয়েট্রিতে আমি সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে থাকছি কিন্তু মনে হচ্ছে  কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি যাকে  বলেন বিচ্ছিন্নতা  , অনেকটা সেরকম- শুধু নান্দনিকতায়ই সব কিছু নয়। পিপলস পোয়েট্রিতে আমি মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষাকে মূর্ত হিসেবে পাচ্ছি, সেখানে পথ দেখতে পাচ্ছি। এই শ্রেণির কবিতা রচনার সময় শব্দকে আরো বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর উপযোগী করে চয়ন করতে হচ্ছে। এ কাজ করতে গিয়ে যদি ন্যারেটিভ বেশি এসে যায় কবিতার আলো আধারির চেয়ে তাতে তা পদ্যগন্ধী হয়ে পড়তে পারে। আমার বিশ্বাস কবির কাজ ওই দুটি দিকের সমন্বয় গড়ার চেষ্টা করা। একেবারে এলিটিস্ট পোয়েট্রি করলে একসময় আপনি নিছক টেক্সট হয়ে যাবেন। অধ্যাপকরা আপনাকে পড়াবে। সাধারণ মানুষ সংযোগ অনুভব করবে না। আমি কবিতার ভেতর সাধারণ মানুষের কাছে স্মরণযোগ্য হয়ে থাকার গুণ চাই। এই দাবিকে বাদ দিতে পারব না। নজরুল, জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য স্মরণযোগ্য কবিতা কেন আমরা আওড়াই? লেখককে বস্তসত্ত্ব ও শিল্পসত্ত্ব-  দুই সত্ত্বের ভেতর সমন্বয় করতে হয়। এই সমন্বয়টুকু করা সম্ভব হলে মানুষ  কবি আর একা, বিচ্ছিন্ন থাকেন না — তিনি তার জনগণের আবেগ ও ভালবাসার অংশ হয়ে যান।

আরেকটা ব্যাপার ভাবায়। ভাষার শব্দভাণ্ডার থেকে একই শব্দ চয়নের পরও কিভাবে আলাদা স্বর তৈরি হয়? যেমন নজরুল, সুকান্ত দুজনই বিদ্রোহী কবি। কিন্তু দুজনের স্বর আলাদা। তাঁরা একই ভাষার অভিন্ন ভাণ্ডার থেকে শব্দ নিলেও তার চয়ন আলাদা। এভাবে মৌলিকত্বে বৈচিত্র্য তৈরি হয়। কবিতা মানুষের কাছে স্মরণযোগ্যতা পায়, কিন্তু আলাদা আলাদা পথে। 

কবিই হতে চেয়েছিলেন?

কামাল চৌধুরী: আমরা প্রত্যেকেই কিছু স্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাই। একসময় লক্ষ করি, ভেতরে কোনো বিশেষ প্রবণতা তৈরি হয়েছে। কৈশোরে আমার ভেতর লেখার প্রবণতা তৈরি হয়। কিন্তু এমন মনে হয়নি যে, লেখা দিয়ে অতি বড় কেউ হয়ে যাব। অমন স্বপ্নযাত্রা ছিল না। কিন্তু স্কুলজীবন থেকে যে প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছিল, একসময় দেখলাম তা আমার ওপর রীতিমতো চেপে বসেছে। এতোটাই যে, একটা ভালো লেখার অন্বেষণ আমার স্বপ্ন হয়ে উঠল। অন্বেষণের তীব্র প্রণোদনা অনুভব করলাম। স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, অনুভবের  এই তীব্র রসায়নে একসময় কবিতাপথের পথিক হয়ে উঠলাম।

লেখক জীবনের কোনো বাঁকে কোনো ভুল চোখে পড়ে?

কামাল চৌধুরী: কলেজ জীবনে  কবিতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়ি। সঙ্গে কবিবন্ধুরাও ছিলেন। এখন মনে হয়, প্রত্যেকেই  সৃষ্টিশীলতীর পাশাপাশি অনেক সময়ও অপচয় করেছি। এরপরও ঝোঁকটা সৃজনশীলতার দিকে বেশি ছিল বলেই বোধয় ক্রমশ লেখার সঙ্গেই থাকতে পেরেছি। ৮২ সালে আমি বিসিএস দিই। সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করি। সেই সময়টায় পেশাগত দিক গুছিয়ে উঠতে লেখার সামান্য বিরতির ঘটে— অর্থাৎ কম লিখেছি তখন ।যে কারণে আমার প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থের ভেতর সময় ব্যবধান প্রায় দশ বছর। এই দীর্ঘ  সময়টাকে নিয়ে আমি ভাবি । হয়তো চাইলে আরো বেশি লিখতে পারতাম। যদি আগের লেখার ভাণ্ডারে আরো কিছু সম্পদ যুক্ত হতো। 

প্রকৃতির সান্নিধ্যে সবচেয়ে সুন্দর সময় কোথায় কাটিয়েছেন? তাঁর সঙ্গে কোনো কবিতার স্মৃতি?

কামাল চৌধুরী: আমার চাকরিজীবনের প্রথম পদায়ন হয় রাঙামাটিতে। রাঙামাটির নান্দনিকতা আমাকে আজও দোলা দেয়। অরণ্যে বিলীন নামে আমার একটা কবিতা আছে। কবিতাটি রাঙামাটির অপার্থিব সুন্দরের মাঝে তাঁবুতে বসে লেখা। এর পেছনে একটা গল্প আছে। আমি তখন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে একটা সীমান্ত-পিলার টেকওভার করতে গিয়েছিলাম। এটা ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বের ভেতর পড়ে। কিছুদূর আমাকে হেলিকপ্টারে পৌঁছে দেওয়া হয়। এরপর পিলারের কাছে যাওয়াটা অত্যন্ত কষ্ট সাধ্য ছিল। পাহাডি ঝর্ণার তৈরী ছড়া দিয়ে হেটে গেছি। কখনো হয়ত সামনে পাহাড় পড়েছে। আমাকে ছড়ার জলে নেমে যেতে হয়েছে। গলা পর্যন্ত ডুবে গেছি জলে। উঠে আবার গভীর অরণ্যে হাঁটাপথ, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সাথে গাইডরা ছিলেন, তাঁরা পথ দেখিয়েছেন। কোথাও কোথাও বন্য হাতির পায়ে চলা পথে চলেছি। বেলা বারোটায় রওনা হয়েছিলাম, মাঝখানে এক ঘণ্টার মতো সীমান্ত-পিলারের সেখানে থাকতে হয়। এরপর ফিরতে রাত নয়টা-দশটা। আশির দশকের সেই অচেনা, দুর্গম অপরূপা রাঙামাটি। পাহাড়ের ওপর হেলিপ্যাডে আমার তাঁবুতে ফিরে এলাম যখন, ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীর। শুয়ে আছি। মাথার ওপর তারাজ্বলা আকাশ, অপার্থিব জোছনা। কিন্তু আমার শরীর বুঝি জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সেই সময়  দুদিন পর তাবুতে লেখা হলো অরণ্যে বিলীন কবিতাটি । 

তবে আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় কোন প্রাকৃতিক পরিবেশে আমি সবচেয়ে তৃপ্ত হয়েছি, তো বলব, আমার গ্রামের পরিবেশে। আমি পৃথিবীর অনেক স্থানে ভ্রমণ করেছি। সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছি, কবিতার প্রেরণা পেয়েছি। কিন্তু আমার গ্রামের জলকাদার ভেতর যে প্রেরণা, তেমনটা আর কোথাও পাইনি। 

আপনার পড়াশোনার বিষয় ছিল নৃবিজ্ঞান। কবিতায় নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ- ভাবনা-দর্শন নিশ্চয়ই ছায়া ফেলেছে?

কামাল চৌধুরী: ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের একটা কথা আছে—নদ নদী আমাদের প্রাণ, নদনদীই আমাদের তৈরি করেছে। প্রতিটি ভৌগলিক পরিমণ্ডলেই এমন আলাদা কিছু অনুষঙ্গ থাকে যেগুলোর ওপর সেখানকার জনগোষ্ঠীর নৃতত্ত্বের ভাবনাগুলো দাঁড়ায়। তার ওপর ভিত্তি করে সৃষ্ট হয় ঐ অঞ্চলের মানুষের মৌলিকত্ব,  ভাষা, জাতিসত্তার  স্বাতন্ত্র। আমাদের জাতিসত্তারও স্পষ্ট নির্ণায়ক বেশিষ্ট্য আছ। আমাদের  মাছ- ভাতের ঐতিহ্য আছে।  আর মাছ ধরার যন্ত্রপাতি ও চাষের সরন্জামই আমাদের প্রথম প্রকৌশল। আমাদের এসব ভুলে গেলে চলবে না। বিশ্বায়নের যুগেও কবিতা জাতীয় সংস্কৃতিকে ধারণ করে। আমাদের সেই সব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথাও আমি কবিতায় বলতে চেয়েছি । বর্তমানের আমরা অনেক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ হয়ত বাহ্যিকভাবে হারিয়ে ফেলেছি, কিন্তু ভেতরে আত্মীয়তার সেই সূত্রগুলো আজও কাজ করছে। সেসব আমাদের যেমন স্বতন্ত্র করেছে, তেমনই আমাদের একত্রিত করে রেখেছে। ‘ধীবরকালের নৃতত্ত্ব ‘নামে আমার একটি কবিতা আছে। বাঙালির নৃতত্ত্বের সাংস্কৃতিক রূপ সেখানে আমি তুলে ধরতে চেয়েছি।

পরবর্তী লেখা নিয়ে কী ভাবছেন?

কামাল চৌধুরী: এখন আমি কবিতা বিষয়ে একটি সৃজনশীল গদ্য নিয়ে ব্যস্ত। আসা করি বইমেলায়’ কবিতার অন্বেষণ কবিতার কৌশল’  নামে বইটা বের হবে।কবিতা রহস্যময়। এটা কাউকে শেখানো যায় না। কিন্তু যেটা শেখানো যায় না, সেটা শিখে নিতে হয়। প্রকরণসহ কবিতার আঙ্গিকগত কিছু বিষয় আছে। ঐতিহাসিকভাবে যেসমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে, সেসবের সঙ্গে পরিচিতি হওয়ার ব্যাপার আছে। নতুন প্রজন্মের লেখকদের এসব ভালভাবে জানা প্রয়োজন। আমরা যে ভাষা ব্যবহার করি, তা বহুব্যবহারে জীর্ণ হয়ে ওঠে। কবিতা কী, কবিতার ভাষার কী, কেন কবিভেদে এটি আলাদা, কেন স্পেস দিই কবিতায়, পঙক্তি বলতে কী বুঝি, উপমা-রূপক কী, চিত্রকল্পটা শব্দে বাক্যে কিভাবে প্রতিস্থাপিত হয়, রূপকের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী- কবিতার এ ধরনের কিছু প্রায়োগিক বিষয় নিয়ে লিখেছি এতে। আমাদের দেশে এমন বই  কিছু আছে, তবে যথেষ্ট নেই। পাশ্চাত্যে সৃজনশীল লেখালেখি সংক্রান্তে  এ ধরনের বই পর্যাপ্ত। এতে করে কেবল লেখক নয়, পাঠকও দীক্ষিত হয়ে ওঠেন। আমেরিকাসহ ইওরোপের কিছু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নিয়ে আলাদা বিষয়ই পড়ানো হয়। তারই একটা ধারা আমাদের দেশে তৈরি হওয়া দরকার।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com