
শ্রদ্ধাঞ্জলি
আগুনপাখি: সম্পর্কের বিচিত্র বয়ান
প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২৩ । ০৩:০২ | প্রিন্ট সংস্করণ
মিল্টন বিশ্বাস

হাসান আজিজুল হক [২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯-১৫ নভেম্বর ২০২১]
হাসান আজিজুল হক [২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯-১৫ নভেম্বর ২০২১] ৬৫ বছর বয়সে লিখেছেন 'আগুনপাখি'। তার জন্য তিনি পশ্চিমবঙ্গের আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন। কেন্দ্রীয় চরিত্রের জবানিতে যে নারী 'আগুনপাখি' উপন্যাসের কাহিনি বর্ণনা করেছেন তাঁর বাল্যকালে মাতৃবিয়োগের ঘটনা দিয়ে সূচনাংশটি প্রতীকী তাৎপর্য পেয়েছে। তিনি অবশ্য ছোটগল্পের স্বল্প পরিসরে দেশবিভাগের মর্মন্তুদ কাহিনি বর্ণনা করেছেন। 'পরবাসী' গল্পে দেশবিভাগজনিত পরিস্থিতিতে হিন্দু-মুসলমানের হিংস্র নিষ্ঠুর আচরণের বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। ষাটের দশকে লেখা এই গল্পে হিন্দু কর্তৃক মুসলমান হত্যা এবং তার প্রতিক্রিয়ায় হিন্দু হত্যা দেখিয়ে লেখক শেষ পরিণতিতে মানুষের মৃত্যুকে রক্তাক্ত, বীভৎস যন্ত্রণাময় রূপে তুলে ধরেছেন। ২০০৬ সালে প্রকাশিত 'আগুনপাখি' দেশবিভাগের পটভূমিতে এক নারীর বাস্তুর প্রতি মমত্ববোধের মানবিক আখ্যান। বর্ধমানের উপভাষার সহজ-কঠিন পথ অতিক্রম করে উপন্যাস কাহিনির ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে লেখক অতি স্মৃতিকাতর এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর অবস্থান পার্টিশনের বিরুদ্ধে। বর্ধমানের একটি গ্রামে হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থান দাঙ্গার অভিঘাতে ভেঙে যাবার পরে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভারতভাগের অনিবার্য পরিণতিতে বাস্তুচ্যুত মানুষের মাটির টানের কথা 'আগুনপাখি'র গভীরতর ব্যঞ্জনাকে অভিষিক্ত করেছে। বর্ধমানের একটি মুসলিম পরিবারকে কেন্দ্র করে উপন্যাসটিতে উঠে এসেছে দেশভাগের পূর্বাপর ইতিহাস। মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দাঙ্গার প্রতিক্রিয়া, দেশভাগ, দেশভাগের প্রতিক্রিয়া সমস্ত কিছুই এক নিরক্ষর গৃহস্থ নারীর দৃষ্টিতে বর্ণিত হয়েছে। 'আরে কী মুশকিল? পাকিস্তান যাব কেন? নিজের দেশ ছেড়ে?' জন্মভূমির প্রতি এই সাধারণ নারীর সহজ প্রকাশের মাহাত্ম্যে উপন্যাসটি গভীরতা অর্জন করেছে।
অবিকল লেখক তাঁর মাকে বসিয়ে দিয়েছেন উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রে, যার বিষয়বস্তু দেশভাগ।
দেশভাগ [১৯৪৭] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে ট্র্যাজিক ঘটনা। উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের সহাবস্থান দেশভাগের ফলে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। এ সময় মৃত্যু ঘটে প্রায় পাঁচ লাখ ভারতবাসীর, পঁচাত্তর হাজার নারী নিপীড়িত হয়; আর গৃহহীন, বাস্তুচ্যুত দেড় কোটি মানুষ নতুন দুটি দেশে উভয় দিক থেকে অভিপ্রয়াণ করে। কিছু পরিবার পারস্পরিক গৃহ বিনিময় করে উভয় রাষ্ট্রে বসতি স্থাপন করলেও অভিপ্রয়াণকারী অধিকাংশ মানুষকে উদ্বাস্তু হয়ে পড়তে হয়। দেশভাগের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হিসেবে লেখকরা অর্জন করেন হত্যা, দুর্ভোগ, ধর্ষণ; আর মানবিক বিপর্যয়ের রক্তাক্ত ইতিহাস। পাঞ্জাব আর সীমান্ত প্রদেশের মর্মস্পর্শী ঘটনাগুলি সে সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত পৃথিবীর তাবৎ মানুষকে আলোড়িত করে চলছে। খুশবন্ত সিং, সালমান রুশদি, আর. কে. নারায়ণ ইংরেজিতে রচনা করেন দেশভাগের ভয়াবহ বাস্তবতার আলেখ্যময় উপন্যাস। কৃষণ চন্দর, ভীস্ম সাহীন, সাদত হাসান মান্টোর হিন্দি-উর্দু রচনায় এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র সেন, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, স্বপ্নময় চক্রবর্তী প্রমুখ লেখকের উপন্যাসে স্মরণীয় হয়ে আছে দেশভাগ। দেশভাগকে নিয়ে বাংলাদেশের লেখকদের একইভাবে বেদনার্ত চিত্র অঙ্কন করতে দেখা যায়।
চারের দশকের পটভূমি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, পাকিস্তান আন্দোলন, রাজনৈতিক ফটকাবাজি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং দেশভাগ, যা 'আগুনপাখি' উপন্যাসের পটভূমি। 'ভাষা-প্রয়োগে এবং সংলাপ-নির্মিতি'তে হাসান আজিজুল হকের নিরীক্ষা-প্রবণতা শিল্পীসত্তার পরিচয় পাওয়া যায় 'আগুনপাখি' উপন্যাসে। উপন্যাসে ব্যক্ত হয়েছে বিচিত্র রকমের সম্পর্ক। যে নারীর জবানিতে পুরো উপন্যাসের কাহিনি এগিয়েছে পরিণতির দিকে, তার সঙ্গে পারিবারিক-সাংসারিক সম্পর্কগুলো বিভিন্ন চরিত্রের পরিচয় হিসেবে আবির্ভূত। কেবল ব্যক্তি নয়, ব্যক্তির সূত্রে পরিবারের গণ্ডি ছেড়ে সমাজের ও রাষ্ট্রের ভেতর প্রবেশ করেছে সম্পর্কের নানামাত্রিক সূত্র। আখ্যানে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রান্ত।
মেজো বউয়ের রাজনৈতিক চেতনা গড়ে উঠেছে স্বামীর সান্নিধ্যে। একটু লেখাপড়া শেখার পরে তার স্বামী পরাধীন ভারতের কথা বলেছে। সে কিছু বুঝতে না পারলেও পাঠক বুঝতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তৎকালীন ভারতবর্ষের রাজনীতি লেখকের সচেতন প্রয়াসে আখ্যানে যুক্ত হয়েছে।
তাদের বড় ছেলে গ্রামের স্কুল ছেড়ে শহরে বোর্ডিংয়ে অবস্থান করে লেখাপড়া করতে গিয়েছে। কিন্তু সমকালীন রাজনৈতিক অভিঘাতের বাইরে থাকতে পারেনি। কত্তার সঙ্গে যে মুসলিম লীগের সম্পর্ক সৃষ্টি হচ্ছে তা টের পাওয়া যায় গৃহে দাড়ি-টুপি-পাগড়ি পরা মানুষের ঘন ঘন আসা যাওয়ার সংবাদ থেকে। একইসঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর আলাপে তৎকালীন হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের হৃদ্যতা চিহ্নিত হয়েছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, খেলাফত আন্দোলন, প্রীতিলতার আত্মাহুতি, ইংরেজ হটানোর লড়াইয়ে যুবসমাজের আত্মত্যাগ সবই উন্মোচিত হয়েছে। পরিবারের সকলের জন্য মোটা কাপড় আনা, কত্তার নিজের জন্য মোটা খদ্দর প্রভৃতি গান্ধীজির নির্দেশ গ্রামীণ জনজীবনে মান্য করার দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের ঢেউ থেকে এই নারী একসময় ভেবেছে- 'আমার ছেলেটি আমার শুদু লয়।'
গান্ধীজির নেতৃত্বে আইন অমান্য আন্দোলনের সরাসরি প্রভাব দেখা যায় কাহিনিতে গাঁয়ের স্কুলের ছেলেরা লেখাপড়া ছেড়ে আন্দোলনে যোগদান করার তথ্য থেকে। সরাসরি যুক্ত না থাকলেও রাজনীতি নারীকে সন্তানহীন করেছে। স্কুলপড়ূয়া ছেলের জেলে আটক ও পরে গৃহে ফিরে সান্নিপাতিক জ্বরে ২৭ দিন ভুগে মারা যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই মৃত্যুটি না হলে হয়তো তারাশঙ্করের 'ধাত্রীদেবতা'র শিবনাথ চরিত্র হয়ে যেত ছেলেটি। তবে সেই সম্ভাবনা কাজে লাগাননি ঔপন্যাসিক।
উপন্যাসে কত্তার ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার প্রসঙ্গে গ্রাম্য রাজনীতির অন্ধিসন্ধি উন্মোচিত হওয়ার বিষয়টি কাজে লাগাননি লেখক। হিন্দু-মুসলমানের নয়নমণি কত্তা জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, এমনকি হিন্দু নেতার প্ররোচনায় হত্যা করতে আসা নিম্নবর্গ আঘাত করতে পারে না তার সামনে এসে। তবে লেখক দেখিয়েছেন নির্বাচিত প্রতিনিধির প্রচেষ্টায় গ্রামের উন্নয়ন ত্বরান্ব্বিত হয়েছে। রাস্তা পাকা হয়েছে, স্টেশনে যাওয়ার সুবিধা হয়েছে। এ উপলক্ষে জেলার বড় ইংরেজ সাহেব গ্রামে এসেছে। হিন্দুপাড়ায় আগুন লেগে মানুষের সর্বস্ব খোয়া গেলে কত্তা অবস্থাপন্ন চাষিদের কাছে বাঁশ খড় কাঠ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে।
এই আগুনই প্রতীকী হয়ে ওঠে ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব এসে লাগে গ্রামের জনজীবনে। অর্থনৈতিক মন্দা, বস্ত্রসংকট, খরা প্রভৃতি বিপর্যয় গৃহস্থের গৃহে আবির্ভূত হয়। কাপড় চুরির হিড়িকের কথা জানা যায়। অর্থাৎ যুদ্ধের অভিঘাতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা একীভূত হয়েছে। এমনকি মেজো বউ পিতার মৃত্যুর চার বছর পর পিতৃগৃহে যাবার সময় রাস্তায় মিলিটারি দেখেছে। পিতার বাড়ি গিয়ে শুনেছে গ্রামে মেয়েমানুষের পিছু নিচ্ছে সেনারা। বুঝতে পেরেছে এবারকার যুদ্ধ এসে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
যুদ্ধের প্রভাবের সঙ্গে সঙ্গে উপন্যাসের গ্রামীণ পটভূমিতে মহামারি রোগের প্রাদুর্ভাবের কথা বর্ণিত হয়েছে। ওলাওঠায় মারা যায় অনেকে। নিম্নবর্গ-উচ্চবর্গ সকলেরই আবাসে যথা ডোমপাড়া, বাগদিপাড়া, মুচিপাড়া, বাউরিপাড়া, বামুনপাড়ায় ঢুকে যায় রোগ মহামারি আকারে।
যুদ্ধের প্রভাবে নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র দুর্লভ হয়ে পড়ে। নুন, কেরোসিন, চিনি দুর্লভ হয়ে দাঁড়ায়। যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ বিশেষত ১৯৪৩ সালের মন্বন্তর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে উপন্যাসে। একই সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বর্ষায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ১০ দিন চলে এই দুর্যোগ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে মানুষকে লড়াই করতে শিখিয়েছেন লেখক।
কলকাতার দাঙ্গায় রায়দের ছেলে মারা যায়। বিশ ঘর মুসলিমের একশ লোক অথচ গ্রামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। মেজো বউয়ের বড় ছেলের সমান বয়সী ছেলেটির মৃত্যু সংবাদ তাকে বিপন্ন করে। একদিকে দাঙ্গা, অন্যদিকে দেশভাগের প্রসঙ্গ বর্ণিত হয় আখ্যানে। বিশ্বযুদ্ধ শেষে পাকিস্তান আন্দোলন চাঙ্গা হয়ে ওঠে। দেশভাগের অনিবার্যতা বর্ণিত হয় উপন্যাসে- 'স্বাধীনতার জন্যে একটা আন্দোলন হচ্ছে, আবার সেই আন্দোলনের পেটের ভেতর মুসলমানদের জন্যে একটা আলাদা দেশের আন্দোলন হচ্ছে।'
এই পাকিস্তান আন্দোলনের হিড়িকে দাঙ্গার সূত্রপাত। কিন্তু গ্রাম্য সমাজে সুসম্পর্ক তখনও বজায় আছে। মেজোবউ রায় গিন্নিকে দেখতে গেছে এসব দাঙ্গা পরিস্থিতির মধ্যে। দাঙ্গার প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছে সে। 'আমি য্যাতোই আসি একজনা মা-কে সান্ত্বনা দিতে, সে আমাকে ভালো চোখে দেখতে পারবে ক্যানে?' কারণ রায় গিন্নি জেনেছেন কারা তার পুত্রকে মেরেছে। তবে গিন্নি তাকে বলেছে- 'দিদি! আর যেন কারু কোল এমনি করে খালি না হয়।'
কথক উপলব্ধি করে রাজনৈতিক কারণে সম্প্র্রীতি বিনষ্ট হয়েছে। 'তৌহিদি শক্তির সামনে হিন্দু মালাউন দাঁড়াতে পারবে না'- যখন শুনেছে মানতে পারেনি মেজো বউ। নিজের ল' দেওরের উন্মত্ত হয়ে পাকিস্তান হাসিলের চিন্তাও তাকে অনুপ্রাণিত করেনি। দেশভাগের প্রতিক্রিয়ায় সে দেখে সকলে চলে যাচ্ছে। দাঙ্গা বাধছে অনর্থক। তার নিজের গ্রামে কিছু হয়নি কিন্তু সে বুঝতে পেরেছে- 'দাঙ্গা লাগানোর এমন সুযোগ কি কেউ ছাড়ে? চেরকাল দেখে আসছি দুনিয়ায় একটি দুটি মানুষই সব লষ্টের মূল।'
উপন্যাসের শেষাংশে দেশভাগের ঐতিহাসিক তথ্য প্রদান করতে হয়েছে লেখককে কর্তার দৃষ্টিকোণ থেকে। 'হিন্দু-মুসলমান দুই জাতকে চিরদিনের মতো একে-অপরের শত্রু করে দিলে। পাকিস্তানের নাম করে জিন্নাহ ইংরেজদের কাজটিকেই করে দিলে আর ক্ষমতার লোভে পড়ে নেহরু-রাও তাই করলে। প্যাটেল, শ্যামা মুখুজ্জে মুসলমানদের আলাদা করে দিতে চেয়েছিল, তাই হলো। গান্ধী এখন একঘরে। দরজায় দরজায় তাকে কেঁদে মরতে হবে।'
সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনা ধারা এবং ব্যক্তি চরিত্রে তার প্রভাব সবই মেজো বউ-কেন্দ্রিক হয়ে আখ্যানে উপস্থাপিত হয়েছে। এজন্য ইতিহাসের সন-তারিখ উল্লেখ করে পাঠককে সচেতন করার প্রয়াস লক্ষ করা যায়নি। বরং বোদ্ধা পাঠকের কল্পনাকে অবারিত করতে মূল কাহিনির ভেতর সযত্নে লিপিবদ্ধ হয়েছে গল্পের গল্প।
উপন্যাসটির নামকরণ নিয়ে হাসান আজিজুল হক বলেছেন-
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের ইতিহাসের যে মহাবিপর্যয় এটাকেই সিগনিফায়েড করব এবং এমন একটা মানুষ তৈরি করব যে ওই মিসরীয় উপকথার মতো; যে নিজেই নিজেকে ৫০০ বছর আগুনে পুড়িয়ে মরে যায়, পরে তার ভস্ম থেকে ওই পাখিটাই আবার তৈরি হয়। সে কখনো হারে না। একটা মানুষ, তাকে কোথাও কোনোভাবেই মাথা নত করা চলবে না। বাস্তব জীবনে সে যত যাই করে থাকুক না কেন, তাকে যত অধীনতা স্বীকার করতে হয়ে থাকুক, তাকে যত সংকীর্ণতার ভেতর দিয়ে যেতে হোক, তার ভেতরের যে মানুষ পৃথিবীর প্রায় সব মানুষের মতোই সে খাড়া থাকুক। মেরুদণ্ড সোজা রাখুক এবং সেই জিনিসটা করার চেষ্টাই আগুনপাখি।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত উপন্যাসটির বর্ণনা যে বিষয়বস্তু অবলম্বন করে রূপায়িত তা সংগতিপূর্ণ ও সাবলীল। বক্তা নিজের জবানিতে নিজের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে দেশভাগ ও তার প্রতিক্রিয়ায় দেশত্যাগে অনিচ্ছুক নিজের জীবনকথা বর্ণনা করেছে। এই নিরক্ষর নারীর কাছে দেশত্যাগের বিষয়ে তার স্বামী, পুত্রের কারও যুক্তি গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তার সরলতা বুঝতে পারে না রাজনীতির জটিল মারপ্যাঁচ। এজন্য প্রতিকূলতা, দাঙ্গাভীতি সবকিছু জয় করে মৃত্তিকা সংলগ্ন নারীর নিজ বসতিতে থেকে যাওয়ার আকুতি মর্মদাহী। একাকী একজন নারীকে সর্বংসহা করে নির্মাণ করে লেখক দেখিয়েছেন 'বাঙালি জাতির ভেতরকার অবিনাশী সেই সত্তাকে, যা জেগে ওঠার সুযোগ পেলে ফের পূর্ণ সামর্থ্যে জেগে উঠতে পারে।' নিজের মাটিতে দাঁড়িয়ে নিজের বোধে বেঁচে থাকার এই বোধ পেয়েছেন হেমিংওয়ের কাছে বিশেষত 'ম্যান ক্যান বি ডেস্ট্রয়েড বাট নট বি ডিফিটেড' চেতনা থেকে।
উপন্যাসে গৃহস্থ পরিবারের জীবন কাহিনি বর্ণনা করার ফাঁকে তাদের পরিবারে আশ্রিত গ্রামীণ নিম্নবর্গের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন লেখক। 'গরিব পাড়া-পড়শি, ভাই-ভায়াদ, আত্মীয়, বেধবা কিম্বা গরিব বউরা বাড়িতে এসে থাকত, এটো ওটো করত। দুটো খেতে পেত।' খামারের পাশে ঘর বেঁধে আশ্রয় গ্রহণকারী পরিবার, দৈনিক মজুরিতে মুনিশ, বর্ষাকালে ধান রোপা এবং হেমন্তে ধান কাটার সময় ছোট নাগপুরের সাঁওতালসহ অনেক নিম্নবর্গ এই গৃহস্থের আঙিনায় আসত। কৃষিভিত্তিক জীবনে নিম্নবর্গের কৃষিশ্রমিকদের সঙ্গে গৃহস্থের সম্পর্ক ছিল স্বাভাবিক ও মধুর। এই সমাজের সংস্কার-বিশ্বাস-প্রথার বিচিত্র কথনও ব্যক্ত হয়েছে কাহিনিতে। একটি উদ্ধৃতি-
বিয়ের এক বছরের মাথায় আমার একটি খোকা হলো। সি দিনই লিকিনি দোপরবেলায় এক কড়াই দুধ উথুলে পড়ে গেয়েছিল। গাই দুয়ে এনে জ্বাল দেবার লেগে দুধ চুলোয় বসিয়েছিল। কেউ আর খেয়াল করে নাই, আঁতুড়ঘরে আমাকে আর লতুন খোঁকাকে নিয়েই সবাই বেস্ত ছিল। এই ফাঁকে সেই উজ্জ্বলন্ত দুধ সব উথুলে উঠে কড়াই থেকে পড়ে গেল। তাই দেখে আমাদের বুবু, সেই বেধবা ননদ হায় হায় করে উঠলে শাশুড়ি শুধু বললে, দুধ নষ্ট হয়েছে হয়েছে। কেউ কোনো কথা বলো না। বাড়িতে নতুন মানুষ এল- এ সোংসারের পেথম খোঁকা- আর দুধ উথুলে পড়ে গেল। এ বড্ড সুখের কথা। এবার সোংসারে ধন-দৌলত, সুখ আনন্দও উথুলে পড়বে। তোমরা কেউ এই নিয়ে আর কথা বলো না।
হাসান আজিজুল হক বাংলা ভাষা নিয়ে পরীক্ষা করেছেন এই উপন্যাসে। তাঁর লেখায় প্রবাদ-প্রবচন-বাগধারা নতুন বাস্তবতায় আত্মপ্রকাশ করেছে। ভাষা ও প্রতীকের ব্যবহারে তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর কথন বিশ্বে মানুষের মনের গহিন গহ্বরে ডুব দিয়ে মুক্তা খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা রয়েছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের নিম্নবর্গ জীবনের অসামান্য রূপকার তিনি। বর্তমানে অনেকেই কথ্য ভাষা ব্যবহার করেছেন। অনেক তরুণই কথ্য ভাষা ব্যবহার করে লিখছে, কিন্তু ঠিক তাঁর মতো করে এ ব্যাপারটা কেউ করেনি; তাঁর কাছে যেটা মনে হয়েছিল। তিনি ব্যবহার করেছেন পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কাটোয়া অঞ্চলের কথ্য ভাষা। কথকের একক কথনে পুরো উপন্যাস আঞ্চলিক ভাষায় লেখা। তবে তিনি দুরূহ করে তোলেননি আঞ্চলিক ভাষার সম্পূর্ণ রূপটি তুলে ধরে। বিষয়বস্তুর সঙ্গে সংগতি রেখে তিনি শব্দ ও বাক্য নির্মাণ করেছেন। যেমন- পারিবারিক ভাঙনের মধ্যে আঞ্চলিক ভাষার কাব্যিক বর্ণনা রয়েছে। 'বৈকাল গেল, সারা বাড়িতে কারুর দেখা নাই। দেখলাম সূয্যি ডুবল, দেখলাম সাঁঝ নামল, দেখলাম আঁদার ঘোনো হলো। আর একটু বাদে ঝিঁঝি পোকা ডাকতে লাগল। অন্যদিন জোনাকি দেখতে পাই না। বাড়িতে লম্ম্ফ-হেরিকেন জ্বলে, জোনাকি পোকা কে খেয়াল করে; আজ বাড়িতে কোথাও আলো নাই, বাড়িময় আঁদারে জোনাকি ঘুরে বেড়াইছে।'
বস্তুত ঔপন্যাসিক ব্যক্তিজীবনের ঘটনা ও অভিজ্ঞতার নিজস্ব পাদপীঠ থেকে 'আগুনপাখি' রচনা করেছেন। উপন্যাসের পশ্চাৎপটে দেশকালের সামাজিক-রাজনৈতিক-প্রাকৃতিক চিত্র বিধৃত হয়েছে; চিরন্তন মানবিক আখ্যান জীবন্ত হয়ে উঠেছে; ঐতিহাসিক পটভূমিগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে; পটভূমির সঙ্গে চরিত্রের মনোভঙ্গি সম্পর্কিত হয়েছে। ঘটনার চড়াই উতরাই এবং চরিত্রের আবেগ-অনুভূতি প্রতিবেশের অমোঘতায় ও কুশলতায় অভিব্যক্ত। কাহিনির বিবর্তনে চরিত্রের অগ্রগতিতে, ভাষার কুশলী উপস্থাপনায় উপন্যাসটি অনিবার্য গতি সঞ্চার করেছে। কখনও সংলাপ, কখনাও কথোপকথন, বর্ণনা এগিয়ে গেছে বিচিত্র গতিতে। লেখক সমাপ্তিতে জীবনদৃষ্টির প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। মানুষ সব ছেড়ে, সব হারিয়ে একাকী হলেও সে আসলে একা নয় যদি মৃত্তিকার প্রেম তাকে আবিষ্ট করে রাখে। সর্বজনীন ও সমগ্র সত্যে উপনীত হয়েছেন ঔপন্যাসিক। স্মৃতিবাহিত ঘটনা বলতে বলতে মেজো বউ আমাদের সমকালে উপস্থিত হয়েছে। তার ব্যক্তিজীবনের নানা দিক উপস্থাপিত হয়েছে একটি সত্যে পৌঁছানোর জন্য। উপন্যাসে দেশভাগের ঘটনাসমূহের আলোড়ন রয়েছে তবে তা বিশৃঙ্খল নয় চিরন্তন মূল্যবোধে প্রোথিত। মেজো বউ সেই মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমের প্রতীক।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com