
ডিজিটাল অর্থনীতি
নিরাপদ ও সহজ লেনদেনে ক্যাশলেস বাংলাদেশ
প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২৩ । ০৪:৪৬ | প্রিন্ট সংস্করণ
আনোয়ার ফারুক তালুকদার

ডিজিটাল বাংলাদেশের পরবর্তী ধারা 'স্মার্ট বাংলাদেশ' গড়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে সরকার। সেই উদ্যোগের সঙ্গে সমন্বয় করে ক্যাশলেস বাংলাদেশের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গত ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এর শুভ সূচনা করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে ১০টি ব্যাংক, তিনটি মোবাইল ব্যাংকিং সেবা এবং তিনটি আন্তর্জাতিক পেমেন্ট স্কিম এই কাজে প্রাথমিকভাবে যুক্ত ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বয়ে এ উদ্যোগে যেসব ব্যাংক সম্পৃক্ত রয়েছে, সেগুলো হলো- ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, পূবালী ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংক। এ ছাড়া মোবাইল আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান বিকাশ, এমক্যাশ, রকেট এবং আন্তর্জাতিক পরিশোধ স্কিম মাস্টারকার্ড, ভিসা ও অ্যামেক্স এ সেবায় যুক্ত হয়েছে। শুরুতে ঢাকার বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলকে নগদ লেনদেনমুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে প্রায় ১২০০ প্রান্তিক থেকে মাঝারি ব্যবসায়ীকে এই সেবার আওতায় আনা হয়েছে। শিগগিরই বিভিন্ন বিভাগীয় শহরকে এর আওতায় আনা হবে। পর্যায়ক্রমে এই সেবা সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
স্পর্শবিহীন মূল্য পরিশোধ পদ্ধতির কারণে, করোনা মহামারি চলাকালে বিভিন্ন ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারাদেশে ১১ হাজার ২৯টি সম্পূূর্ণ অনলাইন ব্যাংক শাখা, ১৩ হাজারের বেশি এটিএম বুথ, ১ হাজার ২২১টি ক্যাশ ডিপোজিট মেশিন এবং ২ হাজার ২৫৬টি ক্যাশ রিসাইক্লার মেশিন রয়েছে; বিভিন্ন মার্চেন্ট পয়েন্টে পস টার্মিনালের সংখ্যা ১ লাখ ২ হাজার ৪৮৮। দেশে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি ডেবিট, ক্রেডিট এবং প্রিপেইড কার্ড গ্রাহক রয়েছে। ৬০ লাখেরও বেশি ইন্টারনেট ব্যাংকিং গ্রাহক রয়েছে। মোবাইল আর্থিক সেবা গ্রাহক রয়েছে অনেক। তাছাড়া ১ কোটি ৭০ লাখের বেশি গ্রাহক এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করছেন। প্রতি বছর এই সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে।
এই পরিসংখ্যানগুলো একটি ক্যাশলেস বা নগদবিহীন অর্থনীতি গঠন করার সব উপাদান নির্দেশ করে। যেমন- তরুণ জনগোষ্ঠী, ক্রমবিকাশমান ভোক্তা শ্রেণি, দেশব্যাপী বিস্তৃত মোবাইল নেটওয়ার্ক কাভারেজ, বিশাল সংখ্যক মোবাইল ফোন গ্রাহক, যাচাইকৃত মোবাইল আর্থিক সেবা গ্রাহক এবং সর্বোপরি একটি নগদবিহীন অর্থনীতি কার্যকরভাবে পরিচালনা করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে। বর্তমান সরকার একটি 'ক্যাশলেস সোসাইটি' বা নগদ লেনদেনমুক্ত সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বহুবিধ ফলপ্রসূূ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ইন্টারঅপারেবল ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা 'বিনিময়' উদ্বোধন করেন, যেটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ক্যাশলেস বাংলাদেশ উদ্যোগের আওতায় বাংলা কিউআর নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত যে কোনো ব্যাংক বা মোবাইল আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানের মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারকারীরা অন্য যে কোনো ব্যাংক বা এমএফএস অ্যাকাউন্টধারী ব্যবসায়ীদের কিউআর (কুইক রেসপন্স) কোড স্ক্যান করে পণ্য বা সেবামূল্য পরিশোধ করতে পারবেন। পণ্য বা সেবার দাম পরিশোধের ক্ষেত্রে বর্তমানে নগদ অর্থ, চেক, কার্ড, ব্যাংক/মোবাইল আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানের মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহূত হয়ে থাকে। নগদ অর্থে পরিশোধ ঝুঁকি এবং ঝামেলাপূর্ণ, চেকে পরিশোধ সময়সাপেক্ষ, জটিল। অন্যদিকে কার্ড ব্যবহারের জন্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রযুক্তিভিত্তিক অবকাঠামো নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে বিপুল বিনিয়োগ করতে হয়। তাই কার্ডভিত্তিক মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থা ছোট বা প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের জন্য অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল। এ ছাড়া এতদিন বাংলাদেশে কিছু ব্যাংক ও মোবাইল আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানের কিউআর কোড থাকলেও সর্বজনীন কিউআর ছিল না। ফলে, শুধু ওইসব প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকরা পারস্পরিক লেনদেনেই সীমাবদ্ধ ছিল।
এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বজনীন বাংলা কিউআর প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিউআর পরিশোধ পদ্ধতি একটি কম খরচের পরিশোধ সেবা হওয়ায় বিশ্বের অনেক দেশে এটি প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের মাঝে পরিশোধ সেবা হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশেও এ উদ্যোগের মাধ্যমে কম খরচের পরিশোধ পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল লেনদেনের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। ফলে এই প্রান্তিক ব্যবসায়ীরাও আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারবেন। এর মাধ্যমে ক্যাশলেস বাংলাদেশ গড়ার যে লক্ষ্য আছে আমাদের, সেটাও অর্জিত হবে।
'ক্যাশলেস ইকোনমি' বা নগদবিহীন অর্থনীতির বহুবিধ সুবিধা রয়েছে। নগদমুক্ত ডিজিটাল লেনদেন প্রক্রিয়ায় দ্রুত লেনদেন করা যায়, এটি নগদ টাকা বহনের খরচ এবং সময় অপচয় কমায় এবং দ্রুত আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সম্ভব হয়। এ ছাড়া এই ব্যবস্থা রাজস্ব সংগ্রহে সহায়তা করে, সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং অপরাধ হ্রাস করতে সহায়তা করে। জয় হোক ক্যাশলেস বাংলাদেশ এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের উদ্যোগ।
আনোয়ার ফারুক তালুকদার: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্নেষক
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com