
শোচনীয়
প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২৩ । ০৪:৫৯ | প্রিন্ট সংস্করণ
সম্পাদকীয়

দুই সপ্তাহেরও অধিক সময় ধরিয়া ঢাকার বাতাস বিপজ্জনক মাত্রায় দূষিত থাকাটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বাতাসের মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার সারাবিশ্বের বায়ুর মান বিষয়ে লাইভ আপডেট দিয়া থাকে।
সমকালের শুক্রবারের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ঐ সংস্থার ওয়েবসাইটে গত ১০ জানুয়ারি হইতে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিশ্বের ১০০টা দেশের মধ্যে ঢাকার নাম প্রায় প্রত্যহ কোনো না কোনো সময় শীর্ষে উঠিয়া আসিয়াছে। এমনকি সমকাল অনলাইনের এ প্রতিবেদন অনুসারে, শুক্রবার সকাল পৌনে ১০টায়ও একই ওয়েবসাইটে ঢাকার বাতাস দূষণের দিক হইতে বিশ্বে শীর্ষস্থানে অবস্থান করিতেছিল।
উক্ত সংস্থার হিসাবে, এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা একিউআই স্কোর শূন্য হইতে ৫০-এর মধ্যে থাকিলে একটা শহরের বাতাস ভালো বলিয়া গণ্য করা হয়; স্কোর ৫১ হইতে ১০০-এর মধ্যে থাকিলে মাঝারি এবং উহা ছাড়াইয়া গেলে বিপজ্জনক বলিয়া ধরা হয়। আর ঢাকার একিউআই শুক্রবার সকাল পৌনে ১০টায় ছিল ২৫৬, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টায় ৩৭২ এবং বুধবার একই সময়ে ছিল ৩১৯।
মোট কথা, একটা লম্বা সময় ধরিয়া প্রায় দুই ক্রোড় বাসিন্দার এই মহানগরী শোচনীয় বায়ুদূষণের শিকার হইতেছে বলিলে ভুল হইবে না। এহেন বায়ুদূষণ এমন এক সময়ে ঘটিতেছে যখন দূষণে মৃত্যুর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। উপরন্তু, গত মে মাসে বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, শুধু পরিবেশ দূষণের বলি হইয়া ২০১৯ সালে বিশ্বে ৯০ লাখের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করিয়াছে, যেখানে বাংলাদেশের ছিল দুই লক্ষ মানুষ।
ঢাকা শহরে বহু দশক ধরিয়া কোনো প্রকার নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করিয়া নানাবিধ নির্মাণকাজ চলিতেছে। উহা বিবেচনায় লইলে অবশ্য কথিত তিলোত্তমা এই নগরীর বাতাসের এহেন বিপজ্জনক দূষণে বিস্ময়ের কিছু নাই। দশ বৎসর পূর্বেও যেখানে একতলা বা দোতলা অট্টালিকা ছিল, সেখানে নিদেনপক্ষে ছয়তলা বা বহুতল ভবন উঠিতেছে। নগরীর ভূদৃশ্যের এই পরিবর্তনের স্বার্থে ভবন ভাঙা হইতেছে অনেকাংশে নূ্যনতম সুরক্ষা ব্যবস্থা ব্যতীত। ফলে শুধু ইষ্টক-লৌহ খণ্ড পড়িয়া মাঝেমধ্যে বিশেষত পথচারীরা আহত বা নিহতই হইতেছে না, ধূলা ছড়াইয়া পড়িতেছে নগরীর বায়ুমণ্ডলে। আবার যখন নূতন ভবন নির্মিত হইতেছে তখনও খুব স্বল্প ক্ষেত্রে সরকার নির্দেশিত নির্মাণবিধি মান্য করা হইতেছে। এমনকি বহু অভিজাত বলিয়া গণ্য আবাসিক এলাকা আছে, যেখানে ভবন নির্মাণকালে ফুটপাত বা ভবনসংলগ্ন রাস্তায় ইট-বালি-সুরকিসহ বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী স্তূপ করিয়া রাখা হয়।
এই সকল অনিয়ম প্রতিরোধে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ন্যায় সরকারি সংস্থা থাকিলেও উহারা খুব একটা সক্রিয় নয়; বরং নজরদারির দায় একজন অপরজনের উপর ফেলিবার প্রয়াস চালায়।
আসলে ইহারা সক্রিয় হইবে কি, বহু সরকারি সংস্থাই তো নগরীর এই দূষণযজ্ঞে অনেকাংশেই নেতৃত্ব দিতেছে। উন্নয়নের নামে বিভিন্ন সরকারি পরিষেবা সংস্থার পালাক্রমে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির আদি ও অকৃত্রিম চিত্র তো প্রায় গোটা বৎসর জুড়িয়া দেখিতে হয়। তদুপরি গত কয়েক বৎসর ধরিয়া চলিতেছে ফ্লাইওভার, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল ইত্যাদি নির্মাণযজ্ঞ। যেখানে পরিবেশরক্ষার বিষয়টা প্রায় অনুপস্থিত বলিলে অত্যুক্তি হইবে না।
নগরীর সৌন্দর্যবর্ধনের নামে বৎসরে একাধিকবার একই ফুটপাত ও রাস্তার মধ্যিখানের ডিভাইডার বা আইল্যান্ড ভাঙা-গড়া চলিয়াছে- এমন রেকর্ড বিরল নয়। আর পরিবেশ দূষণে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে চিহ্নিত ঢাকার চতুর্পার্শ্বে শত সহস্র ইটভাটার কথা তো নূতনভাবে বলার নহে!
আরও হতাশাজনক হইল, ২০২০ সালের নভেম্বরে একটা আবেদনের ভিত্তিতে উচ্চ আদালত এই শহরের বায়ুদূষণে লাগাম পরাইতে পরিবেশ অধিদপ্তর ও দুই সিটি করপোরেশনকে ৯ দফা নির্দেশনা প্রদান করিয়াছিলেন। সেইগুলিও অদ্যাবধি মান্যতা পায় নাই।
তবে আমরা মনে করি, এই বিষয়ে যদি উচ্চ আদালতের তরফ হইতে ফলোআপ থাকিত, তাহা হইলে সরকারি সংস্থাগুলির নিদ্রামগ্ন থাকিবার ফুরসত মিলিত না। নিজেদের অস্তিত্বের প্রতি মারাত্মক হুমকি সৃষ্টিকারী উক্ত সমস্যার বিরুদ্ধে একই সঙ্গে পরিবেশবিষয়ক বেসরকারি সংস্থাগুলির পাশাপাশি সচেতন নগরবাসীকেও সোচ্চার থাকিতে হইবে।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com