নিজে পুড়ে অন্যের মশাল শেফালী

২০০৯ সালে হাইকোর্টে রিট, ২০২৩ সালে পূর্ণাঙ্গ রায়

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২৩ । ০৫:০৩ | প্রিন্ট সংস্করণ

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি

প্রতীকী ছবি

নাম তাঁর শেফালী (আসল নাম নয়)। ৩১ বছর আগে ঠাকুরগাঁও জেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরের অজপাড়াগাঁয়ে দুঃখিনী মায়ের গর্ভে তাঁর জন্ম। যাঁর ঔরসে শেফালীর জন্ম, সেই বাবা তাঁকে স্বীকার করেননি। তাঁর মা অসীম সাহসে নিজের পরিচয়ে মেয়েকে বড় করেন। সমাজ, পরিবারসহ সবার বাধা ছিল পদে পদে। রাষ্ট্রও শেফালীর শিক্ষার পথে পাহাড়সম বাধা হয়। এসএসসির নিবন্ধনে বাবার নাম না দেওয়ায় পরীক্ষা দিতে পারেননি। দশম শ্রেণিতেই থেমে যায় শিক্ষাজীবন। তবে থেমে যাননি শেফালী। তাঁর রিট মামলায় গত মঙ্গলবার যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। মা বা আইনগত অভিভাবকের পরিচয়ে পরীক্ষা দিতে পারবে শিক্ষার্থীরা।

২০০৯ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন শেফালী। ১৩ বছর পর প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে তাঁর জীবনে হয়তো পরিবর্তন আনবে না; কিন্তু জন্মদাতার স্বীকৃতি না পাওয়া আরও যত শিশু আছে, তাদের শিক্ষার পথ উন্মুক্ত হয়েছে। শেফালী নিজে জ্বলে অন্যের মশাল হয়েছেন।

২০০৭ সালে নবম শ্রেণিতে ওঠেন শেফালী। রাজশাহী বোর্ডের অধীনে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে ওই বছর নিবন্ধন করেন। ওই সময়ে শিক্ষার্থীর তথ্য ফরমে (এসআইএফ) মা ও বাবার নাম লেখা বাধ্যতামূলক ছিল। শেফালী তাঁর বাবার নাম লেখেননি। প্রধান শিক্ষকের চাপেও লেখেননি।

কেন লেখেননি- তা গত বৃহস্পতিবার শেফালীর মায়ের মুখ থেকে শুনলাম। নিজ ভিটায় বসে ওই নারী জানালেন, দরিদ্র পরিবারে জন্ম তাঁর। ভূমিহীন কৃষক বাবার পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। অভাবের কারণে, মানুষের বাড়িতে কাজ করতেন। ১৯৯০ সালে গ্রামের এক বিত্তবানের বাড়িতে কাজ করতেন।

ওই বাড়ির ছেলে তাঁকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সম্পর্ক স্থাপন করে। তিনি অন্তঃসত্ত্বা হলে সেই পুরুষ সম্পর্ক ও অনাগত সন্তানকে অস্বীকার করে।

সঙ্গী বিশ্বাসঘাতকতা করলেও শেফালীর মা সবার সঙ্গে লড়াই করে মেয়েকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন। ১৯৯১ সালে সন্তান জন্ম দেন। যদিও দিন-তারিখ আজ আর মনে নেই। মেয়েকে তিলে তিলে বড় করেছেন স্রোতের প্রতিকূলে বুক চিতিয়ে। কিন্তু সেই পুরুষ ৩২ বছরেও মেয়েকে স্বীকার করেনি।

এই ঘৃণাতেই শেফালী তাঁর পরীক্ষার নিবন্ধনে বাবার নাম দেননি। শুধু এ কারণে এসএসসি পরীক্ষার প্রবেশপত্র পাননি। পরীক্ষা দিতে না পারায় আর লেখাপড়া করা হয়নি। ২০১১ সালে ঢাকায় চলে যান তিনি। সেখানে গার্মেন্টে চাকরি করতেন। এক সহকর্মীকে বিয়ে করেছেন। তাঁদের সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। করোনায় চাকরি হারানোর পর শেফালী পঞ্চগড়ে স্বামীর বাড়িতে সন্তানদের নিয়ে স্থায়ী হয়েছেন।

তাঁর মায়ের দিন এখনও কাটছে অভাবে। ভাইয়ের ভিটাতে একটা ঘর তুলে থাকেন। আজও মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করেন। দুটি ছাগল ও কয়েকটি হাঁস-মুরগি তাঁর সম্বল। মেয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পেলে হয়তো তাঁকে জীবনভর এই কষ্ট করতে হতো না।

২০০৯ সালে শেফালীর স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন এনামুল হক। ২০১৯ সালে অবসর নিয়েছেন তিনি। এনামুল জানালেন, শেফালী মেধাবী ছাত্রী ছিল। একজন মেধাবী শিক্ষার্থী শুধু বাবার নাম না দেওয়ায় লেখাপড়া করতে পারেনি। এ কারণে তিনি আজও দুঃখিত, লজ্জিত ও মর্মাহত। তিনি সমকালকে বলেন, আর কারও সঙ্গে যেন এমন অবিচার না হয়।

আদালতের রায়ে খুশি শেফালী ও তাঁর মা। কিন্তু তাঁরা এ নিয়ে প্রচার চান না। তাই সমকাল তাঁদের বিস্তারিত নাম-পরিচয় প্রকাশ করছে না। শেফালীর মা বলেন, মেয়েটার বিয়ে হয়েছে। কষ্ট করে চললেও ভালো আছে। সে তো আর শিক্ষাজীবন ফিরে পাবে না। নাম-পরিচয় প্রকাশ হলে নতুন করে অশান্তি হবে। সমাজের সামনে আবারও হেয় হতে হবে।

শেফালী ও তাঁর মা সেই প্রতারক জন্মদাতার স্বীকৃতি চান না। শেফালীর বাবার পরিচয়ের মতো তাঁর সম্পদও চান না। সে কারণে পিতৃপরিচয় নিশ্চিতে লড়াই চালাতে চান না। শেফালীর হয়ে আদালতে রিট করেছিল ব্লাস্ট, মহিলা পরিষদ ও নারীপক্ষ। ২০০৯ সালেই আদালত তাঁর নিবন্ধন গ্রহণ করার আদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। পূর্ণাঙ্গ রায়ে অন্য শেফালীদেরও একই অধিকার দিয়েছেন আদালত।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com