
চাই পারিবারিক বন্ধন, সুস্থ মনন
প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২৩ । ০৫:৩২ | প্রিন্ট সংস্করণ
সমকাল প্রতিবেদক

দেশে গত বছর ৫৩২ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে স্কুল পর্যায়ের ৩৪০ জন, কলেজ পর্যায়ের ১০৬, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৬ জন। এ ছাড়া মাদ্রাসাগামী শিক্ষার্থী ৫৪ জন। এর আগের বছরের তুলনায় গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার হার কমেছে। ২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিলেন।
গতকাল শুক্রবার সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে 'স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা :সমাধান কোন পথে' শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এ সময় বলা হয়- হতাশা, একাকিত্ব ও নেতিবাচক ভাবনা থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে রাখতে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ বাড়ানো প্রয়োজন। সন্তানদের মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করতে এবং তাদের কথা সহানুভূতির সঙ্গে শুনতে অভিভাবকদের জন্য প্যারেন্টিং কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষক-কর্মচারীদের আচরণ ও পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে কৌশলী ও সহানুভূতিশীল হতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা ও সন্তানদের সুস্থ মনন গড়ে তোলায় যত্নবান হতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক তাহমিনা ইসলাম, আঁচল ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সামিরা আক্তার সিয়ামসহ অনেকে অংশ নেন। আঁচল ফাউন্ডেশনের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ইউনিটের টিম লিডার ফারজানা আক্তার লাবনী বলেন, দেশের দেড় শতাধিক জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টাল থেকে শিক্ষার্থীদের আত্মহননের তথ্য নেওয়া হয়েছে।
আত্মহনন করা বেশিরভাগই উঠতি বয়সী: সমীক্ষা অনুযায়ী ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। আত্মহত্যা করা ৪০৫ জনের মধ্যে ৭৬.১২ শতাংশই উঠতি বয়সী। তাদের মধ্যে ৬৫.৯৩ শতাংশ মেয়ে ও ৩৪.০৭ শতাংশ ছেলে। আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের ৪৩ জন অর্থাৎ ৮.০৮ শতাংশের বয়স ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। তাদের মধ্যে ৪৬.৫২ শতাংশ মেয়ে, ছেলে৫৩.৪৮ শতাংশ।
আত্মহননের বড় কারণ অভিমান: আত্মহত্যা- কারী স্কুল ও কলেজগামী শিক্ষার্থীদের তথ্যে জীবদ্দশায় নানা ধরের জটিলতার মুখোমুখি হওয়ার বিষয় এসেছে। সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী এ পথ বেছে নিয়েছে 'মান-অভিমান' থেকে। আবার অনেক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার সঠিক কারণ জানা যায়নি। ২৭.৩৬ শতাংশ স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন অভিমানে। তাঁদের বড় অংশেরই অভিমান পরিবারের সঙ্গে। অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রেমঘটিত ২৩.৩২ শতাংশ, পারিবারিক কলহ ৩.১৪ শতাংশ, হতাশাগ্রস্ততা ২.০১ শতাংশ, মানসিক সমস্যা ১.৭৯ শতাংশ, আর্থিক সমস্যা ১.৭৯ শতাংশ, উত্ত্যক্ত, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথে গেছে ৩.১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া, শিক্ষকের হাতে অপমানিত হওয়া, গেম খেলতে বাধা দেওয়ায়, পরীক্ষায় অকৃতকার্য, মোবাইল ফোন, মোটরসাইকেল কিনে না দেওয়ায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে বলে তথ্য এসেছে সমীক্ষায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মানিয়ে নিতে প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হতে হয়। তবে পারিবারিক ও সামজিক শিক্ষা না থাকায় পরিস্থিতি মোকাবিলার কৌশল সেভাবে শেখানো হয় না। তাই ওই বয়সে আত্মহত্যার হার বেশি।
সর্বোচ্চ ঢাকা বিভাগে :আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে; মোট আত্মহত্যার প্রায় ২৩.৭৭ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৩.৯০ শতাংশ, অর্থাৎ ২৮৫ জনই মেয়ে; বাকি ১৬১ জন, অর্থাৎ ৩৬.১ শতাংশ ছেলে।
আশা জাগাচ্ছে সরকারি পদক্ষেপ :প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের নানা পদক্ষেপের ফলে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটার আশা জাগছে। এর মধ্যে একটি হলো, মানসিক স্বাস্থ্য আইন প্রণয়ন। এ ছাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য 'মানসিক স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক ফাস্ট এইড (পার্ট-১)' নামে একটি অনলাইন প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতি-২০২২ এর গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার।
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, শিশু কিশোরদের মন হয় 'ভঙ্গুর প্রকৃতির'। এ বয়সে ছোট ছোট বিষয়গুলোও তাদের আন্দোলিত করে। বয়ঃসন্ধিকালে মানসিক বিকাশের সঙ্গে অনেকেই খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে প্রত্যাশার ক্ষেত্রে ছোটখাটো ঘাটতিও তাদের আত্মহত্যার মতো বড় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। এই বয়সে শিক্ষার্থীর সঠিক পরামর্শ পাওয়ার জায়গা অপ্রতুল।
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট শাহরিনা ফেরদৌস সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা বেশি। এ বয়সে সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন এবং সচেতনতা তৈরির কোনো বিকল্প নেই। এ ছাড়া করোনা বড় প্রভাব ফেলেছে, যা কাটিয়ে উঠতে আরও সময়ের প্রয়োজন। বয়ঃসন্ধিকালীন মনের যত্ন বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার সুযোগ ভীষণ প্রয়োজন। স্ট্ক্রিন বা মোবাইল আসক্তি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারিবারিক বন্ধন, পরিবারের সঙ্গে ভালো সময় কাটানোর চর্চা বাড়াতে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই আত্মবিশ্বাসী এবং সুস্থ মনন গড়ে তুলতে এই পদক্ষেপগুলো নেওয়া প্রয়োজন। জাতীয় মানসিক ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, আত্মহত্যা পরিরোধে সন্তানের সঙ্গে গুণগত সময় দিতে হবে। পরিবারের কারও মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা থাকলে মানসিক চিকিৎসকের মাধ্যমে কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন। রাষ্ট্রের উচিত আত্মহত্যা প্রতিরোধে জরুরি পরিষেবা চালু করা।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার বলেন, তরুণদের মধ্যে আত্মহননের হার সর্বোচ্চ। এ বয়সে চাপ মোকাবিলা ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অনেক কম। আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ ও ধৈর্যশীলতার কৌশল শেখাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে পরিবার। সন্তানের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত করা ও অনেক বেশি বন্ধু-বান্ধবী তৈরি করে দেওয়া পরিবারের দায়িত্ব। সন্তানকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দেওয়া ও কঠিক শাসনে রাখা উচিত নয়। সন্তানদের খেলাধুলা করা এবং সামাজিক মেলামেশা করার সুযোগ বাড়িয়ে দিতে হবে। তাদের চাপ মোকাবিলার কৌশল শেখাতে হবে, খেলাধুলা নিয়ে সন্তানের ওপর চাপ প্রয়োগ করা উচিত নয়। এ ছাড়া যদি কোনো শিক্ষার্থী জীবনের কোনো সময় একবার আত্মহননে চেষ্টা করে, তা প্রতিরোধে মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলার পরিবেশ বৃদ্ধি করা। সব প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ তৈরিতে চাপ প্রয়োগ করা।
আঁচলের সুপারিশ :হতাশা, একাকিত্ব ও নেতিবাচক ভাবনা থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে রাখতে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ বৃদ্ধি করা। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে আত্মহত্যা প্রতিরোধী পোস্টার প্রদর্শন। প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনায় পরিবারের ভূমিকা খতিয়ে দেখতে ও দায় বৃদ্ধিতে তাদের আইনি বাধ্যবাধকতার বিষয় নিশ্চিত করা। স্কুল-কলেজের ছাত্রকল্যাণ ফান্ডের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করে তা সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আর্থিক সমস্যা সমাধান অনেকাংশে সম্ভব। এতে আর্থিক সংকটজনিত আত্মহত্যার হার কমে আসবে।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com