মেট্রোরেলে ১০ মিনিট

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২৩ । ১১:৪৮ | প্রিন্ট সংস্করণ

দ্বিতীয় সৈয়দ-হক

বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশে মেট্রোরেলের সেবা পরিচালিত হচ্ছে। যানজটের নগরীতে স্বস্তির যাত্রার স্বপ্ন দেখিয়ে বাংলাদেশও মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করেছে। সমকালের জন্য মেট্রোরেল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন কথাসাহিত্যিক দ্বিতীয় সৈয়দ-হক


অবশেষে চড়া হলো ঢাকার নতুন মেট্রোরেলে। তাও আবার স্বেচ্ছায় নয়, যদিও মনে মনে অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম পরিবারসহ একটি ছোট্ট সফর করা হোক। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হওয়ার আগেই সমকাল থেকে ডাক এলো আমাকে একটু চড়ে নিজের অনুভূতি লেখার জন্য। সেই উদ্দেশ্যে আমার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন সমকালের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক শাহেরীন আরাফাত ও ফটোগ্রাফার ফয়সাল সিদ্দিক কাব্য। কথামতো আমরা তিনজনে হাজির হলাম আগারগাঁও স্টেশনের বাইরে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, আগারগাঁও থেকে মেট্রো ধরে একদম উত্তরার শেষ পর্যন্ত গিয়ে সেই একই পথ ধরে ফিরে আসা।

আসলে আমাদের যাওয়ার কথা ছিল মঙ্গলবার কিন্তু শেষ মুহূর্তে খেয়াল করলাম, মঙ্গলবার মেট্রোরেল বন্ধ থাকে। ব্যাপারাটা আমার কাছে কিছুটা আশ্চর্য লাগল। একটি ওয়ার্কিং ডে, অর্থাৎ যখন লোকজনের যানবাহনের সবচেয়ে প্রয়োজন হবে, তেমন একটি দিনে মেট্রোরেল বন্ধ থাকবে কেন? পরে মনে করলাম, হয়তোবা এখন নতুন নতুন খুলেছে বলে শুক্রবারের দিনে লোকজনের একটু সাইটসিইংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যে কারণেই হোক না কেন, বুধবারে আমরা তিনজনে মিলে রওনা হলাম মেট্রোরেলে করে উত্তরার দিকে।

প্রথমেই বলতে হয়, মেট্রোরেলে চড়ে আমার একটি মিশ্র অনুভূতি হয়- উভয় ভালো এবং খারাপ। তবে এটিও বলতে হয় যে, খারাপ অনুভূতির চেয়ে ভালো অনুভূতি অধিক অংশে ভালো। একটি দেশে প্রগতি হুট করে রাতারাতি হয় না- সময় লাগে, ভুলত্রুটি হতে বাধ্য এবং সেই ভুলত্রুটি থেকে শিক্ষা পেয়ে এগিয়ে চলাই আসল প্রগতি। আমাদের দেশে মেট্রোরেল ছাড়া নানা প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডে এই একই অবস্থা। সর্বদা মনে রাখতে হয়, একটি দেশে প্রগতি সেই মুহূর্তে থেমে থাকে যখন আমরা এগিয়ে চলা থামিয়ে দিই। সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হাজারো বিপর্যয়ের মুখে এগিয়ে চলেছে। এটি অবশ্যই প্রশংসনীয় এবং আমাদের বর্তমান সরকারের দুঃসাহস ও দূরদর্শনের প্রমাণ।

ফিরে আসা যাক, মেট্রোরেলে চড়ার অভিজ্ঞতায়। আমাদের তিনজনের সাক্ষাতের স্থান ছিল আগারগাঁওয়ে। প্রথমেই লক্ষ্য করলাম, রাস্তার দু'পাশে দুটি বিশাল সিঁড়ি উঠে গেছে স্টেশনে। পরে জানতে পারলাম, এক পাশের সিঁড়ি দিয়ে উঠলে অন্য পাশে যাওয়া সম্ভব নয়। এটি একই সঙ্গে অসুবিধাজনক ও বিরক্তিকর ভ্রমণকারীদের জন্য। আগারগাঁওয়ের রাস্তার এক পাড় থেকে আরেক পাড় হেঁটে চলা চাট্টিখানি কথা নয়। যাত্রীরা ভুল সিঁড়ি দিয়ে উঠলে মহাবিপদের মুখে পড়বেন। যা-ই হোক, আমরা একত্রে হওয়াতে একই সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম মূল স্টেশনের ভেতরে।

অটোম্যাটিক মেশিনে টিকিট কাটতে গিয়ে আরেক ঝামেলার সম্মুখ হলাম। মেশিনটা সব ধরনের বাংলাদেশি নোট নিতে অক্ষম। যেমন- নতুন ২০০ টাকার নোট সে চেনে না। তার ওপর যেগুলো নোট সে চেনে, যেমন পুরোনো ১০০ টাকা, কেবল 'সঠিকভাবে' ঢোকালে। এই প্রশিক্ষণ আমাদের দেওয়ার জন্য খুবই ক্ষমাপ্রার্থী একজন কর্মচারী হাতের কাছে অবশ্য ছিলেন। অবশেষে টিকিট হাতের কাছে পেয়ে দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, সেগুলো বানানো প্লাস্টিক দিয়ে। প্লাস্টিকের কারণে পরিবেশগত বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে যখন দাঁড়িয়ে আছি আমরা, দেখে একটু কষ্টই লাগলো সেই প্লাস্টিকের টিকিটটি হাতে ধরে। তবে গন্তব্যস্থানে পৌঁছে দেখলাম যে, সেই টিকিটগুলো আবারও মেট্রোরেলের মেশিন নিয়ে গেল। যাক, তাহলে অন্তত সেগুলোকে পুনর্ব্যবহার করার কোনো একটি প্রকল্প রয়েছে। তাই যদি হয়, তাহলে কাগজের টিকিট ব্যবহার করা এর চাইতে অনেক ভালো পরিকল্পনা।

এবারে আসি আসল ট্রেনে ওঠার অভিজ্ঞতায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মেট্রো চড়ে আমার বলতে হবে যে, আমাদের মেট্রো কোনো অংশে কম নয়। সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, যা ঠান্ডা দেশে দেখা যায় না, আমাদের ক্যারেজ ছিল ছিমছাম, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, যা আশা করা যায় একটি নতুন জিনিস থেকে। একমাত্র সময়ই বলবে আমরা এই ছিমছাম ভাব ও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে পারি কিনা। আজকের ছোট্ট সফরে দেখলাম ক্যারেজ প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ খালি। যে কয়টা লোক দেখলাম, তাদের মধ্যে অধিকাংশই আমাদের মতো একটু বেড়াতে এসেছেন। বেশ কয়জন মিডিয়া ও টিভির লোকও চোখে পড়ল, অর্থাৎ ঢাকার নতুন মেট্রোরেল এখনও খবরযোগ্য জিনিস বটে।

মেট্রোতে চড়ে আমার সবমিলিয়ে খারাপ লাগেনি। বরং আনন্দিত হলাম বাংলাদেশের দ্রুত প্রগতির কথা ভেবে। আরও আনন্দিত হলাম ফেরার পথে যখন লক্ষ্য করি যে, আমাদের ট্রেনের ড্রাইভার দু'জনই মহিলা। অর্থাৎ আমরা শুধু প্রগতির দিক থেকে এগিয়ে চলছি না, নারীর সমতার দিকেও লাফ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। একটি দেশের তৃণমূল থেকে উন্নতি হওয়ার এটি একটি প্রধান চিহ্নিতকারী। এ ছাড়া আমাদের যাত্রায় দু'একটি ছোট্ট অভিযোগের কথা বলতে গেলে উল্লেখ করতে হয়, স্টেশনের একজন কর্মচারীকে পেলাম না, যিনি আমাদের সঙ্গে একটু ভালোভাবে কথা বলবেন। সবার ভাব ছিল যেন আমরা মূর্খ, কিছুই বুঝি না, খামাখা ঝুঁকি নিই ট্রেন আসার সময় বা টিকিট কেনার সময়। এগুলো ভুলত্রুটি মাফ করে দেওয়া যায় দুটি কারণে। প্রথমত, তাঁরাও নতুন একটি চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। অতিরিক্ত লোকের ভিড়ের চাপে যে কোনো মানুষ হিমশিম খেয়ে যাওয়ার কথা। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মতো একটি দেশ, যেখানে একাধিক সামাজিক শ্রেণি আছে, সেখানে সবার সঙ্গে এক ব্যবহার করাও কঠিন।

আরেকটা বিষয় লক্ষণীয়, উত্তরার যেখানটায় মেট্রোরেল থামে সেখানে উত্তরা বা সেখান থেকে অন্যদিকে যাওয়ার কোনো শাটল বাস নেই। আবার আগারগাঁও থেকে মতিঝিলের দিকে যাওয়ার বাস থাকলেও, আজিমপুরের দিকে যাওয়ার পর্যাপ্ত বাস নেই। সেদিকে যেতে যাত্রীদের আবার সিএনজি অটোরিকশা বা উবারে উঠতে হচ্ছে। এতে সাশ্রয়ী মূল্যে ভ্রমণের বিষয়টি এখনই ফলপ্রসূ হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের নজরদারির প্রয়োজন রয়েছে।

বাড়ি ফেরার সময় আমার অটোরিকাশাওয়ালা থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁর বেয়ারাকে পর্যন্ত জিজ্ঞেস করলাম তাঁদের মেট্রোরেল সম্পর্কে ধারণা কী! কেননা, একমাত্র আমার নিজস্ব ধারণা নিয়ে লিখলেই একটি নিবন্ধ সম্পন্ন হলো না। প্রায় সবারই মুখে একটি কথা- মেট্রোরেল যেদিন মতিঝিল পর্যন্ত পৌঁছবে, তখনই না সেটি জনগণের আসল কাজে লাগবে। আপাতত আগারগাঁও থেকে উত্তরা চালু হয়েছে বটে, তবে সেটি এখনও কোনো অফিস-আদালতের পাড়ায় গিয়ে পৌঁছাতে পারেনি। তবেই না মানুষ মেট্রোরেলের আসল মূল্য বুঝবে। আশা করি, বর্তমান সরকার থাকাকালীনই জনগণের এ স্বপ্নটি পূরণ হবে।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com